শরী‘আত শব্দটি আরবী। এর মূলধাতু শার’উন। আভিধানিক অর্থ আইন, বিধান, পন্থা, পদ্ধতি ইত্যাদি। আরবী ভাষায় বিস্তৃত ও বড় সড়ক তথা রাজপথকে শারে’ বলা হয়। পরিভাষায় শরী‘আত বলা হয় এমন এক সুদৃঢ় ঋজু পথকে যে পথে চললে লোকেরা হেদায়াত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মপš’া লাভ করতে পারে। ফিক্ধসঢ়;হ বিদদের মতে শরী‘আত বলতে বুঝায় সেসব আদেশ-নিষেধ ও পথ নিদের্শ যা আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি জারী করেছেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, লোকেরা তার প্রতি ঈমান এনে তদানুযায়ী আমল করবে এবং তদনুরূপ জীবন যাপন করবে।
একেক নবী-রাসূলের একেক শরী‘আত : শরী‘আত সর্বপ্রথম প্রবর্তিত হয় হযরত নূহ (আ) এর প্রতি। তাঁর পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের কোন শরীয়ত ছিল না। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং অনৈক্য সৃষ্টি করো না (সূরা আশ শূরা- ১৩)। সকল নবী-রাসূলদের শরী‘আত এক ধরণের ছিল না। কারণ, শরী‘আত প্রণীত হয় উম্মতের অবস্থা, মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে। ফলে একেক নবী-রাসূলের শরী‘আত একেক ধরণের ছিল। যেমন- হযরত মুসা (আ) এর উম্মত ছিল খুবই দুষ্ট প্রাকৃতির, তাই আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে দিয়েছেন কঠিন শরী‘আত। তাদের উপর যাকাত ফরয ছিল সম্পদের এক চতুর্থাংশ, জামা বা দেহে নাপাকী লাগলে তা কেটে ফেলা, তাওবা হলো হত্যা ইত্যাদি কঠিন বিধান। আর হযরত ঈসা (আ) এর শরী‘আত ছিল উদার। মদ্য পান তাদের জন্য হালাল ছিল, নাপাকী নিয়ে ইবাদত করা নিষিদ্ধ ছিল না। শেষ নবী (স) যেমন শ্রেষ্ঠ আল্লাহ তা’য়ালা শরী‘আতও দিয়েছেন কঠিন ও উদার উভয়ের মধ্যবর্তী শরী‘আত। যেমন- গুনাহ করলে ক্ষমা চাওয়া, শরীর ও জামায় নাপাকী লাগলে ধুয়ে ফেলা ইত্যাদি। আল্লাহ তা’য়ালা সুষ্ঠ, সুন্দর, পরিমার্জিত ও উন্নত জীবন পরিচালনার জন্য শেষ নবীর উম্মতকে উপহার দিযেছেন এক উন্নতর শরী‘আত তথা জীবন-দর্শন।
শরী‘আতের উদ্দেশ্য : সব কিছুরই একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। এ হিসেবে ইসলামী শরীয়তের উদ্দেশ্য হলো- ১. দ্বীনকে রক্ষা করা : আল্লাহ তা’য়ালার একমাত্র মনোনীত দ্বীন হলো- ইসলাম। তিনি ইরশাদ করেছেন- নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন (সূরা আলে ইমরান- ১৯)। দ্বীন গ্রহণের পর ও শয়তানের প্ররোচনায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শরীয়ত তখন তার শাস্তি নিশ্চিত করে দ্বীনকে রক্ষা করেছে।
২. জীবন রক্ষা : আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন নেতৃত্বদানকারী হিসেবে। তাদের আবাসস্থল হলো এই বিশাল পৃথিবী। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- আমি তো আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলা চলের বাহন দিয়েছি; তাদেরকে দান করেছি উত্তম রিযিক এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি (সূরা আল ইসরা- ৭০)। আল্লাহ তা’য়ালার এ পৃথিবীর বাসিন্দারা যখন নিশ্চিন্তে, নির্বিগ্নে স্বাধীনভাবে চলা ফেরা করতে পারবে তখনই সৃষ্টির সার্থকতা কার্যকর হবে। তাই শরী‘আত অন্যায়ভাবে মানব হত্যা হারাম ঘোষণা করে এবং এর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করে সকল মানবের জীবন রক্ষার ব্যবস্থা করেছে। ৩. বংশ রক্ষা করা: মানবের বংশ বিস্তারের জন্য শরীয়ত বিবাহের ব্যবস্থা করেছে। বিবাহের ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় পৃথিবীতে সন্তান আসে। সন্তানের মাধ্যমে বংশ ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়।
বংশ রক্ষা করা প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। অবৈধ পন্থায় যৌনকার্য করার ফলে যে সন্তান আসে তাতে বংশ ধারা চালু থাকে না। তাই শরী‘আত একে হারাম ঘোষনা করেছে এবং এ কাজ যারা করবে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছে।
৪. সম্পদ রক্ষা করা : সম্পদ মানুষের অতীব প্রয়োজনীয় বস্তু। জন্মের পরই শিশুর দুধের প্রয়োজন হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন। সম্পদ অর্জনের পন্থা দু’টি। একটি বৈধ পন্থা আরেকটি অবৈধ পন্থা। শরীয়ত অবৈধ পন্থায় সম্পদ অর্জন করাকে হারাম ঘোষনা করেছে এবং শাস্তির বিধান নিশ্চিত করেছে। যাতে এক শ্রেণীর মানুষের কাছে সম্পদ পূঞ্জিভূত হয়ে থাকে। আল্লাহর বাণী- সম্পদ যে শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয় (সূরা হাশর- ৭)।
৫. মান-সম্মান, ইজ্জত-আব্রুত রক্ষা করা : মানুষের মান-সম্মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই ইসলামী শরী‘আত মানুষের মান-সম্মান রক্ষার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আল্লাহ তা’য়ালা সূরা হুজরাতের ১১ ও ১২নং আয়াতে ছয়টি বিষয় নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে। ছয়টি বিষয় হলো- ক. উপহাস না করা, খ. দোষারোপ না করা গ. মন্দ নামে না ডাকা, ঘ. অমূলক ধারণা বর্জন করা, ঙ. গোপন দোষ প্রকাশ না করা চ. গীবত না করা।
৬. মানবাধিকার রক্ষা করা: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। তাই ইসলামী শরী‘আত মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিচার-ব্যবস্থাসহ জীবনের সকল দিক ও বিভাগে উদ্ভূত সমস্যাদি সমাধানে ব্যবস্থা নিয়েছে। মানুষের যে সব ক্ষেত্রে অধিকার ভূলুন্ঠিত হয়, ইসলামী শরীয়ত সে সব ক্ষেত্রে অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছে।
৭. পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সর্ম্পক রক্ষা করা : সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। সকলেই একই ছাদের নীচে একটি বিছানায় বসবাস করছে। তাই ইসলামী শরী’আত আদম সন্তান হিসেবে ভেদাভেদ দূর করে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে। ফলে ইসলামী শরীয়ত ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবতাবোধ নিশ্চিত করেছে। মহানবী (স) মদীনা সনদ ও হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে তা দেখিয়ে দিয়েছেন।
৮. মানব জীবনকে গতিশীল করা : ইসলামী শরী‘আতের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানব জীবনকে গতিশীল করা। গতিশীল জীবন লাভের জন্য প্রয়োজন জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে কাজে লাগানো। আর এ জন্যে প্রয়োজন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। মানব জীবন কর্তব্য কর্মদ্বারাই জীবন্ত, গতিশীল ও প্রাণবন্ত হয়। ধর্মই মানুষকে গতিশীল ও কর্মময় করে। জীবনকে গতিশীল করার জন্য তিনটি গুণ আবশ্যক। তা’হলো- সংকল্প, ধৈর্য ও সততা। ইসলামী শরীয়ত ব্যক্তির মধ্যে এ সব গুণাবলী লালন করে।
৯. মানবিক গুণাবলী বৃদ্ধি করা : ইসলামী শরী‘আতের বিশেষ উদ্দেশ্য হলো মানুষের মানবিক গুণাবলী বৃদ্ধি করা। আর তা হলো- তাকওয়া, সততা, বিনয়-নম্রতা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, দানশীলতা, আমনতদারি, ন্যায়পরায়নতা, কর্তব্যপরায়ণতা ইত্যাদি। এ সব যাদের মধ্যে আছে তারাই দামী। ইসলামী শরীয়ত চায় মানুষের মধ্যে এ সব গুণাবলী যথাযথ ভাবে থকা।
১০. মূল্যবোধ জাগ্রতা করা : মূলবোধ বলতে বুঝায় এমন কতিপয় মৌলিক আদর্শ, বিশ্বাস, রীতি-নীতি বা দৃষ্টিভঙ্গি যা মানুষকে কোন কাজ করতে উৎসাহ ও অনুপ্রাণিত করে। ইসলামে মানবিক মূল্যবোধের মূলকথা হল ঈমান ও আমলে সালেহ। ঈমান ও আমলে সালেহ ব্যতীত মূল্যবোধ অর্জন করা সম্ভব নয়। মহা নবী (স) বলেন- মু’মিন তো ঐ ব্যক্তি যাকে তার ভালকাজ আনন্দ দেয় এবং তার মন্দকাজ কষ্ট দেয় (মুসনাদ আহমদ)। ইসলমী শরী‘আতের প্রধান উদ্দেশ্য হলো- মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করা।
১১. সাম্য ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা : ইসলামী শরী‘আতের আরেকটি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষের মাঝে সাম্য ও সমতা প্রতিষ্ঠ করা। ইসলাম সকলকে অন্যায়-অবিচার, খুন-খারাবী, সন্ত্রাস ইত্যাদি পরিত্যাগ করে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবার নির্দেশ দিয়েছে।
১২. ঝগড়া-বিবাদ রোধ করা : সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করা আবশ্যক। ইসলাম ইসলামী শরী‘আতের প্রতিটি মানুষকে ঝগড়া-বিবাদমুক্ত একটি আদর্শ সমাজ বির্নিমাণের প্রতি জোর তাকিদ দিয়েছে। কারণ ঝগড়া-বিবাদ অশ্লীল কথায় ভরপুর থাকে। যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট অত্যান্ত অপছন্দনীয়।
১৩. অন্যায় বন্ধ করা : অন্যায় হলো ন্যায়ের বিপরীত। ইসলাম ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়য়ের বিপক্ষে। ইসলাম সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার ও অসৎ কার্যকলাপ দূর করার পক্ষে কাজ করে। ইসলাম অন্যায়কে আদৌ সমর্থন করে না। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎকার্জের নির্দেশ দান কর, অসৎ কার্জে নিষেধ কর এবং আল্লাহকে বিশ্বাস কর (সূলা আলে ইমরান- ১১০)।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।