দৈনিক ফেনীর সময়

কোরবানি ঈদে আমাদের করণীয়

কোরবানি ঈদে আমাদের করণীয়

মুসলমানদের জন্য যেই দুইটি ঈদ উৎসব রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল কোরবানি ঈদ। উৎসবের পাশাপাশি এই ঈদের রয়েছে আলাদা সামাজিক গুরুত্ব। আমাদের অনেক চেষ্টা থাকে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের সবচেয়ে প্রিয় কোন কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সমর্পণ করা। পশু কোরবানির সাথে সাথে নিজেদের মধ্যকার পশুত্বকেও কোরবানের মাধ্যমে এবং সকলের মাঝে খুশির ভাগাভাগি করে আমরা অর্জন করতে চাই আল্লাহর সন্তুষ্টি। প্রকৃত ত্যাগের শিক্ষাতেই কোরবানি ঈদ এর মূল তাৎপর্য। আর আমাদের এই ত্যাগকে অর্থবহ করতে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আমাদের জানা উচিত কোরবানির উদ্দেশ্য, পশু নির্বাচন থেকে শুরু করে কোরবানির আগে ও পরে করণীয় কাজ সম্পর্কে।

কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য : কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। এ জন্য আমরা পশু কোরবানি করি এবং সাথে নিজের পশুত্ব ত্যাগ করে ইহজগৎ ও পরজগতের শান্তি সঞ্চয় করি। কিন্তু আমরা প্রায়শই কোরবানির আসল উদ্দেশ্য ভুলে যাই এবং লোক দেখানো কাজ করি। কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য আসে প্রকৃত ত্যাগের সাথে। আমরা জানি যে, পশু কোরবানি করার পর মোট মাংসের তিনটি ভাগ করে এক ভাগ গরিব-দুঃখীকে, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে এবং এক ভাগ নিজে খাওয়ার জন্য রাখতে হয়। খুশির এই সুষম বন্টন আমাদের যেমন ত্যাগ শিক্ষা দেয় তেমনি দৃঢ় করে সামাজিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন।তাই পশুটি কেনার সময় সুস্থ সবল কিনা নিশ্চিত করতে হবে। পশুর চামড়া যথাযথভাবে সংগ্রহ করে সেটি বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ টাকা গরীবদের মাঝে ভাগ করে দিতে হবে।

সুস্থ পশুর বৈশিষ্ট্য : পশু কেনার সময় পশুর মুখের সামনে কিছু খড়/ঘাস/কাঁঠালের পাতা ইত্যাদি ধরে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, পশুর খাবারের প্রতি রুচি আছে কি না? ১.পশু পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি খুব সংবেদনশীল এবং সজাগ থাকবে। চোখ উজ্জ্বল দেখাবে। ২.শরীরের পশম মসৃণ ও তেলতেলে অর্থাৎ পশুর শরীর লোম উজ্জ্বল মসৃণ ও চকচকে থাকবে। ৩.পশু সব সময় কান ও লেজ নাড়াচাড়া করবে। ৪.নাকের মধ্যখানের কালো জায়গাটি (মাজল) ভেজা থাকবে। ৫.পায়খানা-প্রস্রাব স্বাভাবিক থাকবে ও নিয়মিত করবে।

অসুস্থ পশুর বৈশিষ্ট্য : ১. জাবর না কাটা: খাবার মুখে ধরলে শুঁকে, শুঁকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। ২. খুঁড়িয়ে হাঁটা :পশু দুর্বল হয়ে গেলে ঢুলতে থাকা এবং হাঁটাচলা করতে অস্বীকার করা। ৩. মুখে ক্ষত থাকলে, খাদ্যের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকলে মুখ দিয়ে লালা পড়া। ৪. চোখের কোনায় ময়লা জমে থাকা। ৫. মাথা নিচের দিকে রেখে ঝিমানো। কান নিচের দিকে ঝুলে যাওয়া। ৬. নাকের মাঝখানের কালো অংশ (মাজল) শুকনা থাকা। ৭. পায়খানায় দুর্গন্ধ থাকা এবং পাতলা অথবা ভীষণ শক্ত পায়খানা করা।

পশুর যত্ন এবং খাবার : কোরবানি ঈদ এর দুই-তিন দিন আগে পশু কিনে আনা হলে পশুকে কোনো প্রকার জাউ ভাত বা পচা ভাত বা পচা খাবার খাওয়ানো যাবে না। দানাদার পিলেট খাবার পশুকে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়। ভালো মানের গমের ভুসি খাওয়ানো যেতে পারে। আর প্রচুর পরিমাণ পানি খাওয়ানো প্রয়োজন, এতে চামড়া ছাড়াতে সুবিধা হয়। তবে যাই খাওয়ানো হোক না কেন, তা জীবাণুমুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাত্রে খাওয়ানো এবং পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি পান করানো উচিত। হজমে সহায়তার জন্য পশুকে আদার রস বা ডিজিভেট/ডিজিটপ জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যেতে পারে। পেট ফাঁপা দেখা দিলে তিসির তেল খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে ভেটেরিনারি ডাক্তার বা পশু বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া উচিত।

কোরবানি ঈদ প্রস্ততি এবং করনীয় : ১. কোরবানি ঈদ এর আগের রাত ১০ টার পর থেকে কোন প্রকার খাদ্য খাওয়ানো উচিত নয়; একমাত্র পানি ছাড়া। ২. প্রচুর পরিমাণ পানি খাওয়াতে হবে। ৩. অবশ্যই ঈদের কমপক্ষে ১ দিন আগেই অভিজ্ঞ কসাই ঠিক করে রাখতে হবে। ৪. ঈদের মাঠে যাওয়ার আগে সকালে কোরবানির পশুকে ভালোভাবে গোসল করাতে হবে। ৫. পশুকে কোরবানি করার মুহূর্তে তাকে শোয়ানোর জন্য ৩০ ফুট লম্বা নরম সুতা বা পাটের তৈরি ২০ হাত রশি দিয়ে বেঁধে শোয়াতে হবে। কোনো অবস্থাতেই নাইলনের দড়ি ব্যবহার করা যাবে না। তাতে শরীরের চামড়ায় ক্ষত হবে এবং যারা পশুকে শোয়াবে, তাদের হাত ও রশির টানে ছিলে যেতে পারে। ৬. জবাই করার স্থানটিতে ঠিক গলার নিচে দেড় ফুট গভীর ও দেড় ফুট আড়ে ও লম্বায় একটি গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে পশুর রক্ত ঝরাতে হবে। ৭. এমনভাবে পশুকে রাখতে হবে, যাতে গর্তে সম্পূর্ণরূপে রক্ত ঝরে পড়ে। ৮. জবাই করার পর পশুকে টানাহেঁচড়া না করে উঁচু করে সরিয়ে জবাই করার স্থান থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে চামড়া ছাড়াতে হবে। ৯. চামড়া ছাড়ানোর কাজে অবশ্যই আগা ভোতা ছুরি ব্যবহার করতে হবে। ১০. চামড়া ছাড়ানোর সময় চামড়ার সঙ্গে কোনক্রমেই যেন অতিরিক্ত গোশত আটকে না থাকে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ১১. মাথার চামড়া শরীরের মূল চামড়ার সঙ্গেই রেখে ছড়াতে হবে, পৃথক করা যাবে না। ১২. ছাড়ানো চামড়া সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার পানি দ্বারা ভালোভাবে ধুয়ে ঝুলিয়ে রেখে পানি ঝরিয়ে নিয়ে কাপড় দিয়ে ঘসে শুকিয়ে ফেলতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, তা যাতে জিআই তারে ঝুলিয়ে রাখা না হয়। দড়িতেও দীর্ঘক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। ১৩. গরুর চামড়া প্রতি পাঁচ কেজি, মহিষের চামড়া প্রতি ৭.৫ কেজি এবং ছাগল/ভেড়ার চামড়া প্রতি ১.৫ কেজি লবণ মাখাতে হবে। ১৪. অনভিজ্ঞ লোক দিয়ে কাজ করালে চামড়ার ক্ষতি হতে পারে তাই এই ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যার হক মূলত গরীবদের, তারা যাতে তাদের হক থেকে যেন বঞ্চিত না হয় তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : ইসলামে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। তাই আমাদের উৎসবে আনন্দের পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছিন্নতার ব্যাপারে খেয়াল রাখা খুবই প্রয়োজন। ১. কোরবানি ঈদ এ কোরবানির পর পশুর রক্ত ও তরল বর্জ্য খোলা স্থানে রাখা যাবে না। এগুলো গর্তের ভেতরে পুঁতে মাটিচাপা দিতে হবে। কারণ, রক্ত আর নাড়িভুঁড়ি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দুর্গন্ধ ছড়ায়। আর যদি রক্ত মাটি থেকে সরানো সম্ভব না হয়, তা হলে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। ২. কোরবানির বর্জ্য পলিথিনে রেখে দিতে হবে, যাতে ময়লা পরিবহন দ্রুততার সঙ্গে করা যায়৷ যেসব এলাকায় ময়লার গাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয় বা দেরি হবে, সেসব স্থানে বর্জ্য পলিথিনের ব্যাগে ভরে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে। ৩. পশুর হাড়সহ শক্ত বর্জ্যগুলোও পলিথিনে দিয়ে দেওয়া ভালো। নাড়িভুঁড়ি বা এ জাতীয় বর্জ্য কোনভাবেই পয়:নিষ্কাশন নালায় ফেলা যাবে না৷ যারা চামড়া কিনবেন, তারা কো বদ্ধ পরিবেশে চামড়া পরিষ্কার না করে এমন খোলামেলা স্থানে করতে পারেন, যেখানে ময়লা জমে দুর্গন্ধ হবে না৷ আর চামড়ার বর্জ্যগুলোও অপসারণের জন্য জমিয়ে রাখতে হবে। ৪. কোরবানির পশুর বর্জ্য সরকারি উদ্যোগের জন্য অপেক্ষা না করে নিজের উদ্যোগে পরিষ্কার করাই ভালো।

গোশত সংরক্ষণে করণীয় : কোরবানির গোশত ভালোভাবে সংরক্ষণ করা খুবই : গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যায় এই সময়ে একসাথে বেশ ভাল পরিমাণ গোশত আমাদের বাসায় আসে যা আমরা অনেকদিন ধরে খেয়ে থাকি। তাই ভালোভাবে সংরক্ষণ না করা গেলে অনেক গোশত নস্ট হতে পারে। সাধারণত আমরা গোশত কেটে নিয়ে রেফ্রিজারেটওে সংরক্ষণ করি। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, কাটা মাংস না ধুয়ে রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা ঠিক নয়। এতে করে গোশতে লেগে থাকা রক্তের কারণে পচন ধরতে পারে। এ মাংস খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পারে। তাই রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণের পূর্বে অবশ্যই ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে নিয়ে শক্ত করে চেপে চেপে রক্তমিশ্রিত পানি ঝেড়ে নিতে হবে। এরপর সংরক্ষণ করতে হবে।এ ছাড়া গোশতকে পরিষ্কার করে নিয়ে রোদে শুকানো যেতে পারে। গোশত চেপে নিয়ে লবণ পানিতে হালকা চুবিয়ে নিয়ে অতঃপর চেপে নিয়ে রোদে শুকানো যায় বা রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়। অনেক সময় গোশতকে ধোয়ায় স্মোক করে রাখা যায়। অথবা গোশতকে কিমা বানিয়ে বিভিন্ন মসলা দিয়ে মিশিয়ে সস তৈরি করেও সংরক্ষণ করা সম্ভব।

কোরবানি ঈদ এ আনন্দের সাথেও যেই অপরিসীম ত্যাগ আমরা করছি, সেই ত্যাগ যেনো আসলেই অর্থবহ হয় সে জন্য আমাদের উপরের ব্যাপারগুলি লক্ষ্য রাখা উচিত। আর একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে শুধু যেন পশু কোরবানিতেই আমাদের ঈদ সীমাবদ্ধ না থাকে, নিজের মনের পশুত্বকেও যেন আমরা কোরবান করতে পারি এবং প্রকৃত ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়। তবেই আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া সম্ভব।

লেখক : ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!