নাজমুল হক :
বিগত শতাব্দীর ৮০ দশকে ছাত্র সংগঠন ছিল ছাত্র-ছাত্রী বান্ধব। ছাত্র নেতাদের দেশপ্রেম ছিল। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্র সংগঠন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আন্দোলন গড়ে তুলতো। জেনারেল আইউব খান, ইয়াহিয়া খান, জেনারেল এরশাদ ছাত্র আন্দোলনের ফলে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে। এ শতাব্দীর মতো লেজুড়বৃত্তিক সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদকাসক্ত ছাত্রনেতা ছিলো না। ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতো, নীতি নৈতিকতা দেশপ্রেম শিক্ষা দিতো। ছাত্র সংগঠন এবং ছাত্রনেতাদের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাইনিং এ খাবারের মূল্য বৃদ্ধি পেতোনা। বাসভাড়া বৃদ্ধি রোধে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে সরকারী ও বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠতো। এ শতাব্দীতে প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী ছাত্র সংগঠনের কোন আন্দোলন চোখে পড়ে নাই। একজন সরকারী কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত সাকুলার বাসে উঠলেই নাগরিকদের ১০ টাকা বাসভাড়া দিতে হবে। সকাল ৭.৩০টার আগে ছাত্রদের হাফভাড়া দেওয়া যাবেনা। রাত্র ৮.০০ টার পরে ছাত্র-ছাত্রীদের হাফভাড়া দেওয়া যাবে না। শুক্রবার এবং বন্ধের দিনে হাফভাড়া দেওয়া যাবে না। ২০২৩ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের খাতা কাগজ কলম বই এবং শিক্ষা উপকরণ প্রায় দ্বিগুণ মুল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধি রোধে কোন ছাত্র সংগঠন এবং ছাত্রনেতাদের ভূমিকা চোখে পড়ে নাই। ছাত্র সংগঠন নেতারা ব্যস্তসময় পারকরছে ফুলনদেবী তৈরিতে, পুলিশ অফিসার এডিসি হারুনকে শায়েস্তা করার জন্য ভাড়ায় প্রেসিডেন্ট এর এপিএসের পক্ষনিয়ে ভাড়ায় ভুমিকা রাখতে। ছাত্রনেতাদের দেশপ্রেম নীতি নৈতিকতা তলানীতে ঠেকেছে। কতিপয় ছাত্রীরা ব্যস্ততার মধ্যে আছে সাংসদ নিয়ে, যাহা ইডেন কলেজের বিভিন্ন ঘটনা জাতি দেখেছে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্রীরা ব্যস্ত ফুলনদেবী তৈরিতে। ছাত্র সংগঠন নেতারা ব্যস্ততার মধ্যে দিন পার করছে বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজি, হলের সিট বানিজ্য, ছাত্রীদেরকে অনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার। মাদকদ্রব্য ব্যবসা এবং আবরার হত্যা ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেষ্টরুমে ছাত্রী নিয়ে রাতযাপন, আবরার হত্যাকান্ড, সাধারণ ছাত্রদের প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতানেত্রী প্রচার করে পিটিয়ে পুলিশে দেওয়ার অসংখ্য ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী ছাত্র সংগঠন, সরকারী ছাত্র সংগঠন, মৌলবাদী ছাত্র সংগঠন, বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন এবং মৌলবাদী বিরোধী বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কোন ভুমিকা রাখতে দেখা যায়নি!! লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিজস্ব স্বকিয়তা হারিয়ে চোরাবালিতে আটকে আছে ছাত্র সংগঠন। ছাত্র সংগঠন এর দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলে কোন প্যানেল ভোট, ডেলিকেটদের গোপন ভোট নাই, ছাত্র সংগঠনের সভাপতি এবং সেক্রেটারি পদের জন্য সংগঠন এর কোন ফরম পূরণ করে জমা দিতে হয়না। লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক দলের সভাপতি বা সভানেত্রীর মুখের ঘোষণার মাধ্যমে ছাত্র সংগঠন এর কমিটি গঠন করা হয়ে থাকে। রাজনৈতিক দলের সভাপতি এবং সেক্রেটারিও একইভাবে ভোট ছাড়াই নিবাচিত হয়ে থাকে। হারুন এপিএস এর ভাড়াটিয়া আহত হয়েছে তাদেরকে পিজি হাসপাতালে দেখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচ্যান্সেলর উপ¯ি’ত। অথচ ছাত্র নেতারা এপিএস এর ভাড়াটিয়া মাস্তান হিসেবে পুলিশকে শায়েস্তা করতে গিয়েছে। এভাবে সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের দলবাজ ভাইসচ্যান্সেলর এবং প্রক্টর শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ব্যস্ত বখাটে আদুভাই বিবাহিত ছাত্রনেতাদের তেলমদনে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রেলওয়ে মন্ত্রনালয়ের আইন ভংগ করে ট্রেনের ছাদে উঠে আহত হয়েছে তার প্রতিশোধ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ভাংচুর করেছে, ভাইস চ্যান্সেলর এর বাসায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। দলবাজ বুদ্ধিজীবিরা নিরব এবং সরকারী ছাত্র সংগঠন এর পক্ষ থেকে দোষী ও সন্ত্রাসী রাস্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসকারী আইন শৃংখলা ভংগকারী বখাটে আদুভাই ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে দলীয় এবং প্রশাসনিক কোন প্রদক্ষেপ গ্রহণ করে নাই।
নাগরিকদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মুল্য বৃদ্ধি রোধে ছাত্র সংগঠন এর কোন ভুমিকা নেই। চাল ডাল আলু তেল চিনি পিয়াজ ডিম ইলিশ মাছ মুরগী শব্জি পশুজাত খাদ্য ইত্যাদির মুল্য আকাশচুম্বী। ৭ টাকার ডিম ১৫/-টাকা। অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট থেকে দেশের ১৮ কোটি মানুষকে রক্ষার জন্য ছাত্র সংগঠন এর কোন ভুমিকা নেই। জেনারেল এরশাদ সরকারের আমলে ছাত্রদের দেশপ্রেম ছিল। চিনির দাম বাড়িয়ে দারিদ্র মানুষের চা খাওয়া বন্ধের উপক্রম রোধ করেছিল জেনারেল এরশাদ এর বানিজ্য মন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ। চিনি এবং বাসভাড়া বৃদ্ধি রোধে এগিয়ে এসেছিল ছাত্র সংগঠন।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছর।গণতন্ত্র ও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য জাতির পিতা বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৪ বছর পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। ১৯৫২ সালে যাদের বয়স ২৫+ ছিলো তারা পাকিস্তানি শাসক শ্রেণি থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছিলো। ১৯৭১ সালে যাদের বয়স ২৫+ বছর ছিল তারা জাতীকে একটি স্বাধীনদেশ লাল সবুজের বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে।
১৯৯০ সালে যাদের বয়স ২৫+ ছিল তারা গণঅভ্যুত্থান এর মাধ্যমে সামরিক শাসক সৈরাচারী জে: এরশাদের পতন ঘটিয়েছে। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকার ব্যব¯’া সংযোজন করেছিল এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। ২০২৩ সালে যাদের বয়স ২৫+ তারা উৎসব মুখর পরিবেশে এখনো ভোটও দিতে পারে নাই! সংবিধান থেকে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল নিজের চোখে দেখেছে। ২০২৩ সালে সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে যাদের বয়স ৭৫ বছর তারা উপরের সবকিছুই দেখেছিল। রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে সংখ্যাগরিষ্ট আসন দখলের গণতন্ত্র দেখেছে। কি বিচিত্র দৃশ্যের গণতন্ত্র ও স্বাধীন বাংলাদেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন এর নেতানেত্রীরা ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা রাস্ট্রের ভাষার দাবীতে আন্দোলন গড়ে তুলে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সালাম রফিক শফিক জাব্বার প্রমুখের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষার স্থান লাভ করে। একটি স্বাধীন দেশে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরারকে নামাজ পড়ার কারণে প্রতিপক্ষ ধর্মীয় ছাত্র সংগঠনের অনুসারী সাজিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে একটি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সারাদেশ ও জাতি একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করে। দেউলিয়া ছাত্র সংগঠন এর সন্ত্রাসী ও খুনীদের আদালতের মাধ্যমে শাস্তি হয়। লেজুড়বৃত্তিক দেউলিয়া ছাত্র রাজনীতির অপরাধী ও খুনী ২০ জনের অধিক মেধাবী ছাত্রের জীবন বিপন্ন হওয়ার চিত্র জাতি দেখলো। যে ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনা, খুনি সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ মদখোর ও মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৈরী করে এমন দৃশ্য বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখতে চাইনা। ছাত্রদের জীবন বিপন্ন করে সে রকম ছাত্র রাজনীতি বুয়েটের ক্যাম্পাসে থাকা উচিত নয় মর্মে মতামত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ছাত্ররা শিক্ষায় মননে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক পরিবার, সমাজ, দেশ-জাতি গঠনে ভূমিকা রাখুক সবাই চায়। এমতাবস্থায় বুয়েটে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি চালুর প্রক্রিয়া সমর্থন যোগ্য নয়।
আবরার হত্যাকান্ডের পরে খুনীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলো কোটি কোটি ছাত্র জনতা। পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট ও সুশীল সমাজের ভুমিকায় মিডিয়ার প্রচারণায় আবরার হত্যার বিচারের রায় হয়। আদালতের রায় দ্রুততার সঙ্গে বিচার হওয়ার ব্যাপারটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সিনিয়র সিটিজেন ও দেশ প্রেমিক নাগরিক ও সুশিল সমাজ। শিক্ষাংগনে সন্ত্রাসীদের শাস্তি হলে অন্য অপরাধীরা সন্ত্রাস ও হত্যাকান্ড থেকে দূরে থাকবে। ছাত্র সংগঠন এর সন্ত্রাসীরা যখন দেখে যে খুনের বিচার হয়না, তখন তাদের সাহস বেড়ে যায়।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। আবরারের বাবা চকবাজার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাথিল করে। আদালত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান বুয়েট এর ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে।
বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একটা পরিবারের আশা-ভরসা, স্বপ্ন সব ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে গেছে। যেমনটা ১৯৬৯ সালে মেধাবী ছাত্রনেতা আসাদ হত্যাকাণ্ড একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছে। আবরার হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত আরও ২৫ জন মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন এবং পরিবারের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে গেল লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির কারণে। শিক্ষাংগনে আবরার ও বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী কারা? তাদের তো কোনো বিচার হলোনা। কারা তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে মেধাবী শিক্ষার্থী আবরারকে খুন করতে সেটার তো কোনো ইনভেস্টিগেশনও হলোনা।
মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় টিকে বুয়েটে পড়তে এসেছিল। তারা বাবা মায়ের স্বপ্ন পুরন করবে সেই প্ল্যান নিয়ে নিরাপদ শিক্ষাংগণ বুয়েটে এসেছিল। বাবা-মায়ের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে , তারা দেশ ও জাতিকে আলোকিত করবে, দুনীতি ও লুটপাট দূর করবে, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে তৈরি হবে, এমন স্বপ্ন নিয়েই এসেছিল। তারা তো ক্রিমিনাল হিসেবে কেউ আসে নাই বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাহলে তাদের ক্রিমিনাল বানাল কে? তাঁদের উদ্বুদ্ধ করল কে বা কারা এই ধরনের বীভৎসতম কাজ করতে। এসব প্রশ্নগুলো থেকে যা”েছ। আবরার হত্যাকারীরা কোন রাজনৈতিক দলের? বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে হত্যাকারীরা কোথায় থেকে ছাত্র হত্যার প্রশিক্ষণ পেয়েছে, তাহলে সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে বিষয়টা জানতে পারতাম। শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীরা সন্তানতুল্য। সেই সম্পর্ক যখন ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে না থাকবে, তত দিন পর্যন্ত এই পরি¯ি’তি কোনো দিন ভালো হবেনা। এখানে শিক্ষার্থীকে শাসনও করতে হবে, ভালোও বাসতে হবে। ওদের স্নেহও দিতে হবে।তাঁদের বোঝাতে হবে, তোমরা এখানে এসেছ বাবা-মায়ের স্বপ্ন নিয়ে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে এসেছ, লেখাপড়াটাই তোমাদের এখানে মুখ্য ব্যাপার। কে কোন রাজনৈতিক দল করল, অন্য দল করলে তাকে রুমে ঢুকতে থাকতে দেওয়া যাবেনা, হকিস্টিক দিয়ে পেটাতে হবে, বুয়েটের ছাত্রদের আবাসিক হল থেকে বের করে দিতে হবে। এসব অপরাজনীতি থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মুক্ত করতে হবে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা কেন হত্যার দায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিস্কার হবে।
আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডে বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র, অভিনেতা, নাট্যকার ও লেখক আবুল হায়াত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘রাজনীতি থাকলে ভালো হবেনা, রাজনীতি ছাড়া ভালো চলবে, এটা চট করে বলা কঠিন। তবে আমরা যে পরিবেশে লেখাপড়া করেছি, বড় হয়েছি, সেখানে রাজনীতি দরকার হয়নি। আমরা আমাদের সমস্যার কথা উপাচার্যকে গিয়ে বলতে পেরেছি। এখন ইউকসু নেই। তার ওপর ছাত্ররাজনীতির খারাপ প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া সেখানে উপাচার্য, প্রভোস্ট, শিক্ষক, ছাত্র সবার মধ্যেই দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিবেশটা ভালো নেই, যা ফেরাতে হবে যেকোনো মূল্যে। বিভেকবান মানুষ চোখের পানি ধরে রাখতে পারবেননা। আবরার হত্যাকারী ইফতির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি “৪ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি নির্দেশনা দেয়। এতে বলা হয়, আবরার শিবির করে, তাকে ধরতে হবে।” এরপর মেসেঞ্জার গ্রুপে সাড়াদেয় বুয়েট শাখার আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা। আবরার তখন বাড়িতে থাকায় ও সকলকে বলে, ‘ওকে বাড়ি থেকে ফিরতে দেন। ৬ অক্টোবর রাত আটটার কিছু পর আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতে রবিন বেশ কয়েকটি চড়মারে আবরারকে। রাফাত স্টাম্প এনে সকালের হাতে দেয়, স্টাম্প দিয়ে চার-পাঁচটি আঘাত করে সকালে। এতে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। বুয়েট শাখার তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মারতে থাকে।
তখন জিয়ন আবরারকে চড় মারে এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বাড়ি দেয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে সকাল ক্যানটিনে খেতে যায়। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে দেখে, আবরার অসু¯’ হয়ে পড়েছে, মেঝেতে শুয়ে আছে। সকাল তখন আবরারকে ধমক দিয়ে উঠে দাঁড় করায় এবং কয়েকটি চড় মারে। মুজাহিদ তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারে। সকাল আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করে। তানভীর তখন চড়-থাপ্পড় মারে। রাত ১১টার দিকে অনিক আসে। হঠাৎ অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে এলোপাতাড়ি শতাধিক আঘাত করে। আনুমানিক রাত ১২টার পর অনিক আবরারকে মারা থামিয়ে কক্ষের বাইরে যায়। তখন আবরার অসু¯’ হয়ে পড়ে ও জানায় তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পরই আবরার বমি করে। তখন রবিন আবরারকে দেখে বলে, ‘ও নাটক করছে’। এরপর আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়। এ সময় অমিত সাহা খুদে বার্তা পাঠিয়ে সবকিছু জানতে চায় এবং আবরারকে আরও মেরে আরও তথ্য বের করতে বলে। আবরারের অবস্থা খুব খারাপ জানালে অমিত তাঁকে হল থেকে বের করে দিতে বলে। এর কিছুক্ষণ পর রবিন ও অনিক ২০০৫ নম্বর কক্ষে আসে। আবরারকে দেখে তাঁরা বলেন, ‘ও ঠিক আছে।’ এরপর তাঁরা চলে যায়। এ সময় আবরার আবার বমি করে। রবিন তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেওয়ার জন্য নিচে নামাতে বলে। ১৭ ব্যাচের ছেলেরা আবরারকে নিচে নামানোর চেষ্টা করে। ব্যর্থ হলে তোশকসহ আবরারকে ধরে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়িতে নামিয়ে রাখে।
তখন আবরার বারবার বলছিল যে তাঁর খুব খারাপ লাগছে। সাধারণ সম্পাদক রাসেল তখন নিচে নেমে হলের প্রধান ফটকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিল। এসময় মুনতাসির দৌড়ে এসে বলেন, আবরারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সকাল তাঁকে মালিশ করতে বলে। ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেয়। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের চিকিৎসক নিয়ে আসে। চিকিৎসক আসার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎসক সিঁড়িতে আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও মারা গেছে। পরে সকাল একটি কক্ষে গিয়ে শুয়ে থাকে। সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে চলছে লেজুড়বৃত্তিক সন্ত্রাসী ও গডফাদারদের নিয়ন্ত্রিত ছাত্র রাজনীতি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রনেতার সংগঠন ও ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বক্তব্যঃ গত দশ বছরে চ.বি তে ৮ জন ছাত্র খুন হয়েছেন। তবে আমি নিশ্চিত, তার আগের ২০ বছরের হিসাব ধরলেও চ্যাম্পিয়ন হবে। আমাদের সময়টা বেশ জটিলই ছিলো। শিবির আর ছাত্রলীগ তখন সমান পরিমান শক্তিশালী। প্রচন্ড গোলাগুলিতে প্রায়ই চবির পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হতো। ২০০৭ সালে দেশের অন্যতম বড় বিদ্যাপিঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার কিছুদিন পরই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হই রিয়েল ভাই, ওসমান ভাই এর মাধ্যমে। কলেজ জীবনে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন ভাই ও ইসলামীয়া কলেজ ছাত্রলীগের ভিপি, বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজ ভাইয়ের মাধ্যমে চট্টল বীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়ে উঠা ছাত্রলীগের প্রতি ছিল আলাদা একটা টান।
জেনে রাখা উচিত, সে সময়ে ক্যাম্পাস ছিল শিবিরের একক আধিপত্য। প্রত্যেক আবাসিক হলে তাদের একক আধিপত্য ছিল। শিবিরের সাথে যুক্ত না থাকলে হলে বা কটেজে থাকা সম্ভব ছিল না। ফ্যাকাল্টি থেকে হল পর্যন্ত তাদের নজরদারি চলত। এমনকি ক্লাস রুম পর্যন্ত তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তারপরেও বগিভিত্তিক রাজনীতিতে ছাত্রলীগ সরব ছিল। অবস্থাটা এমন ছিল সন্ধ্যা সাতটা থেকে সারে সাতটার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নেমে আসত পিনপতন নীরবতা। ২০০৮ এর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল সংগ্রহ করার জন্য মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে ছিলাম। ফলাফল নিয়ে ফেরার পথে চ.বি ২নং গেইট এলাকায় একটি মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায় সেখান থেকে সশস্ত্র কয়েকজন নেমে আমার পরিচয় জানতে চায়, ছাত্রলীগ করি কিনা জানতে চায়। ২নং গেইটে আমার মায়ের মামার বাড়ি থাকায় আমি তখন বলি সেখানে বেড়াতে এসেছি। ঐ দিন আল্লাহর রহমতে বেঁচে যাই, পরে বুঝেছিলাম সেদিন এই অস্ত্র গুলোর মধ্যে এ.কে ৪৭ রাইফেল ছিল।
২০০৮ সালের শেষদিকে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। ২০০৮ এর আগে যারা খেয়ে না খেয়ে ছাত্রলীগ করত তারা ধীরে ধীরে কোনঠাসা হতে থাকে। নব্য ছাত্রলীগের উদ্ভব হয়, তারা শিবিরের বিরোদ্ধে ঐক্যবদ্ধ না হয়ে নিজেদের ভেতর বগি দখল আর হলের রুম দখলে রত হয়। ২০০৯ এর শুরুর দিকে শাহজালাল হলের সামনে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ হয় এতে আমার সামনেই তিনজন বড়ভাইকে তিনফুট চারফুট লম্বা রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়। এই তিনজন অমিত দা (সোহাগ-জাকির কমিটিতে সহ-সম্পাদক), অভি দা ও মিথুন ভাই। তাদের জখম হওয়া শরীর জামা ও হাতে চাপা দিয়ে আমরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসি। সেখানে জরুরী বিভাগেও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিরোধী গ্রুপ আমাদের উপর হামলা চালায়। সেদিনের সেই রক্তক্ষয়ী ঘটনার পর আমি চ.বি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে সরে আসি। যে রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার গ্যারান্টি দিতে পারে না আমি সেই রাজনীতি করতে চাই না। যদিও নগর রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম।
ধীরে ধীরে এই নব্য ছাত্রলীগ রাতের ট্রেনে টুকটাক ছিনতাই করতো। হোটেলে ভাত খেয়ে বিল দিতনা, চা -সিগারেট খেয়ে বিল না দেয়া, মাদক সেবনসহ সব ধরণের অবৈধ কাজ করতে লাগলো এরা। এমনকি তাদের ইভটিজিং ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের কারনে মেয়েরা নিরাপদে চলাফেরা করতে পারতনা। মেয়েদের জন্য এক নৈরাজ্যজনক অবস্থার সৃষ্টি করলো এরা।
গত ১৭ জুলাই ২০২২ এক ছাত্রীর সাথে সংঘটিত হয়েছে অত্যন্ত গর্হিত একটি ঘটনা। এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়কে অপবিত্র করেছে, আমাদেরকে দিয়েছে লজ্জা ও নিন্দা। তাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেশাগ্রস্ত, ইভটিজার, নারী নির্যাতনকারী বদমাশদের বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান দিতে হবে এবং কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে । যারা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন করেছে তাদের বিচার হতেই হবে। এদেরকে সমূলে উগরে ফেলতে হবে, নইলে অদূর ভবিষ্যতে আরো মাশুল দিতে হবে।
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি চালু হলে আবারও হত্যাকারীদের দোরাত্ত বাড়বেনা, আবারও হত্যাকারী সৃষ্টি হবেনা, কোন মায়ের বুক খালি হবে না এ নিশ্চয়তা কে দিবে। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে লেজুড়বৃত্তিক সন্ত্রাসী নিভর ছাত্র রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বন্ধ করতে হবে। উন্নত রাস্ট্রে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠন এবং ছাত্র রাজনীতি নেই। শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলাদলি নেই। বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থীদের লেখা পড়ার সুযোগ দিন। ছাত্র সংগঠন এর লিডারদের ছাত্র সংসদ নিবাচন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। নীতি নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হবে। জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন করে দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করতে হবে। খাদ্যের লাগামহীন মুল্য বৃদ্ধি রোধে ভুমিকা রাখতে হবে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।