নিজস্ব প্রতিনিধি :
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ফেনী শহরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কের জহিরিয়া মসজিদে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জনরোষের আশংকায় ইতিমধ্যে মসজিদ কমিটির সেক্রেটারী সহ কার্যকরি কমিটির ৫ জন পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। দোকান বরাদ্দে জামানতের সম্পূর্ণ টাকা জমা না দেয়ায় ফান্ড সংকটে মার্কেট নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মসজিদের বিপরীতে ১১ তলা বিশিষ্ট মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। মেসার্স সবুজ কনস্ট্রাকশন এটি নির্মাণের দায়িত্ব পায়। নির্মাণাধীন ওই মার্কেটের নিচ তলায় ১৬টি দোকান থাকবে। ওই দোকানসমূহ বিক্রির টাকায় মার্কেট নির্মাণ সম্পন্নের কথা। দোকান কিনতে ৪৪টি দরপত্র জমা হলেও সদ্য পতন হওয়া সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীর পছন্দের দলীয় নেতাকর্মীরা দোকান বরাদ্দ পান। শহরের মাষ্টারপাড়া লমি হাজারী বাড়ীর ‘ঘাটলা’ থেকে মনোনীতদের দোকান বরাদ্দ দেন মসজিদ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক। যারা দোকান কিনেছেন তাদের অনেকেই অর্ধেকেরও কম টাকা জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে সদর উপজেলা আওয়ামীলীগ সদস্য আবদুল জলিল আদর ১ কোটি ৭ লাখ টাকা দিয়ে দোকান কিনলেও মসজিদের ফান্ডে জমা দিয়েছেন ৪০ লাখ টাকা। সদর উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল ৫০ লাখ টাকা দিয়ে দোকান কিনে জমা দেন ৩৪ লাখ টাকা। এছাড়া ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন মজুমদার ৬০ লাখ টাকার স্থলে ৩০ লাখ টাকা, জেলা আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক ও জায়লস্কর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ মিলন ৬৭ লাখ টাকার স্থলে ২০ লাখ, দাগনভূঞা উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও রাজাপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবদীন মামুন ৫৪ লাখ টাকার স্থলে ১৫ লাখ, নিজাম উদ্দিন হাজারীর চাচাতো ভাই কুতুব উদ্দিন হাজারী ৫০ লাখ টাকার স্থলে ৩৫ লাখ, ফেনী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী ৪৭ লাখ টাকার স্থলে ১৫ লাখ, দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সভাপতি দিদারুল কবির রতন ৫৭ লাখ টাকার স্থলে ৩৫ লাখ ৮০ হাজার, ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল ৫৭ লাখ টাকার স্থলে ২৫ লাখ টাকা, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কুমিল্লা জোন ইনচার্জ সামছুল করিম মজুমদার ৪৮ লাখ টাকার স্থলে ১৯ লাখ, জেলা যুবলীগের কোষাধ্যক্ষ ও মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ সাইফ উদ্দিন আহমেদ জিতু ৬০ লাখ টাকার স্থলে ১২ লাখ টাকা মসজিদের ফান্ডে জমা দেন। ২০২২ সালের মে মাসে দোকান বরাদ্দ পাওয়া সবাইকে বাকি টাকা পরিশোধ করতে নোটিশ দেয়া হলেও উল্লেখযোগ্য পরিমান টাকা কেউ দেননি। এর প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১৫ জুন সাইফ উদ্দিন আহমেদ জিতু দোকান বরাদ্দ বাতিল করতে আবেদন করেন।
মসজিদের অফিস কক্ষের ম্যানেজার নাছির উদ্দিন জানান, মার্কেট নির্মাণ কাজ তদারকী করতে প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম নিয়োজিত রয়েছেন। ইতিমধ্যে মার্কেট নির্মাণে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বর্তমান সময়ে একদিকে অর্থ সংকট, অন্যদিকে কমিটির স্থবিরতায় মার্কেট নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে।
এদিকে অপর একটি সূত্র জানায়, জহির উদ্দিন আহমদ ওয়াকফ এস্টেটের আওতায় পরিচালিত মসজিদ পরিচালনা কমিটিতে পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক সহ-সভাপতি। এর মধ্যে কমিটির সম্পাদক ওয়াসিম ইকবাল রুমেল, যুগ্ম-সম্পাদক বাহার উদ্দিন, কোষাধ্যক্ষ সাইফ উদ্দিন আহমেদ জিতু, সদস্য মোমিনুল হক দিদার, শাহীন হায়দার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এছাড়া মুসল্লীদের পক্ষে মসজিদ নির্মাণ কমিটির সাবেক যুগ্ম-আহবায়ক ফারুক হারুন অন্তবর্তীকালীন নতুন কমিটি গঠন করতে জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছেন। ওই আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, “সাম্প্রতিক দেশে পটপরিবর্তনের পর থেকে মসজিদ কমিটির কোন সদস্যের উপস্থিত দেখা যাচ্ছেনা। সেই সাথে শোনা যাচ্ছে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। এমতাবস্থায় মসজিদের কার্যক্রম স্থবিরের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হচ্ছে।”
দায়িত্বশীল অপর একটি সূত্র জানায়, মাওলানা আবুল কাশেমের মৃত্যুর পর মসজিদের খতিব পদটি শূন্য রয়েছে। প্রায় ৪ বছর ধরে শূন্য থাকলেও মসজিদ কমিটি খতিব নিয়োগের উদ্যোগ নেননি। যার ফলে পেশ ইমাম মুফতি ইলিয়াছ নিয়মিত পাঞ্জেগানা ইমামতির পাশাপাশি খতিবের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। মুফতি ইলিয়াছের অনুপস্থিতিতে মুয়াজ্জিন ক্বারী নুরুল্লাহ ও নুর হোসেনও মাঝেমধ্যে ইমামতি করেন।
পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া সম্পাদক ওয়াসিম ইকবাল রুমেল জানান, পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত মসজিদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে জেলা প্রশাসক নির্দেশনা দিয়েছেন। মার্কেট নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকলেও মসজিদের কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।
জেলা প্রশাসক ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার ফেনীর সময় কে বলেন, মুসল্লীদের পক্ষ থেকে আবেদনের প্রেক্ষিতে উদ্বুত পরিস্থিতি ওয়াক্ফ এস্টেট প্রশাসকের কাছে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তার নির্দেশনা পেয়ে যথাযথ প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
খতিব পদ শূন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরবর্তী কমিটি গঠনের পর খতিব নিয়োগের প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে। আশা করছি দ্রুতসময়ের মধ্যে ওয়াক্ফ এস্টেট প্রশাসক থেকে নির্দেশনা পাওয়া যাবে।