নিজস্ব প্রতিনিধি :
দাগনভূঞা পৌর শহরের হাসপাতাল রোডের অভিরামপুর এলাকায় ৫ তলা ভবন দখল করতে নারকীয় তান্ডব চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। ভবনটির মালিক আবদুল গফুর ভূঞা শনিবার সকালে মারা যাওয়ার পর ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। অভিযোগ রয়েছে, ক্যান্সার আক্রান্ত গফুর ভূঞা ওইদিনের ঘটনায় হামলার শিকার হন। এরপর থেকে তার শারিরীক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। গতকাল শনিবার ভোরে ঢাকায় নেয়ার পথে পথিমধ্যে তিনি মারা যান।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, সদর ইউনিয়নের জগতপুর এলাকার কাতারপ্রবাসী আবদুল গফুর ভূঞা প্রায় ১৫ বছর আগে পৌর শহরের হাসপাতাল রোডের পলাশ চন্দ্র সাহার কাছ থেকে ৬শতক জায়গা কেনেন। ওই জায়গায় ২০১৩ সালে ৫ তলা ভবন নির্মাণ করেন। ২০২৩ সালে কাতার থেকে দেশে ফেরেন গফুর ভূঞা। ইতিমধ্যে পলাশ চন্দ্র সাহার ভাগ্নে সয়েল সাহা নিজেকে ওই জায়গার মালিক দাবী করেন। তার কাছ থেকে জায়গাটির আমমোক্তারনামা নেন ইকবাল। তিনি উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জয়নাল আবদীন মামুনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
মৃত্যুর আগে বৃহস্পতিবার গফুর ভূঞা অভিযোগ করেন, বিভিন্ন সময় ওই বাড়ি থেকে তিনি ও তার পরিবারকে উচ্ছেদ, বাড়িটি দখলে নিতে হুমকি-ধামকি দেন চেয়ারম্যান মামুন। বিষয়টি নিয়ে তারা জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানায়, বুধবার (২৯ মে) দুপুরে ৪০-৫০ জন যুবক ভূঞা ম্যানশনে অতর্কিত হামলা চালায়। হামলাকারীরা প্রথমে সিসি ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলে। এরপর সবকটি মিটার ভেঙ্গে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন ও পানির মোটর খুলে নিয়ে যায়। নিচতলার বাসার বাইরে দরজা আটকিয়ে দ্বিতীয় তলায় গফুর ভূঞার বাসায় হানা দেয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই গফুর ভূঞা, তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধু ও দেড় বছর বয়সী নাতনিকে বেদম মারধর করে। এসময় আসবাবপত্র ভাংচুর ও তাদের ব্যবহৃত সবকটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।
বৃহস্পতিবার বিকালে বাসায় মেয়ে ও পুত্রবধুর সামনেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আবদুল গফুর ভূঞা। তিনি বলেছিলেন, “দীর্ঘদিন ধরে তার পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ এবং জায়গাটি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজাপুরের চেয়ারম্যান মামুন তাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে বারবার হুমকি দিচ্ছেন। বারবার হামলা হয়েছে। মামুনের নির্দেশে বুধবার অসংখ্য পোলাপান হামলা চালিয়েছে।”
আবদুল গফুর ভূঞার ছেলে রিয়াদ হোসেন রাজু ফেনীর সময় কে জানান, হামলার ঘটনায় থানায় গেলে পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। আদালতের রায় তাদের পক্ষে থাকলেও হামলাকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় আইনের তোয়াক্কা করছেনা। অব্যাহত হুমকির মুখে তারা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।
দাগনভূঞা থানার ওসি আবুল হাসিম ফেনীর সময় কে জানান, ভোটের দিন ঘটনা জেনে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। শনিবার ওই বাড়ির মালিক গফুর ভূঞা মারা গেছেন বলে শুনেছি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিবেদিতা চাকমা ফেনীর সময় কে বলেন, আদালতের রায় থাকলেও জোর করে উচ্ছেদের কোন সুযোগ নেই। ভূমির মালিক হলে দখলদারদের উচ্ছেদ করে আইনী প্রক্রিয়ায় প্রকৃত মালিকগণ দখল বুঝে নিতে হয়।
গফুর ভূঞার করুণ মৃত্যু
দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফেরার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন আবদুল গফুর ভূঞা। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। দেশে-বিদেশে চিকিৎসাও নিচ্ছিলেন। ২৮ মে মঙ্গলবার ভারতের চেন্নাই থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেন। পরদিন বুধবার পরিবারের অপর সদস্যদের সাথে অতর্কিত হামলার শিকার হন ষাটোর্ধ্ব গফুর। একইসময়ে তার বাসার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। খুলে নেয়া হয় পানির মোটর। বিদ্যুৎ-পানি ছাড়াই তিনদিন বিভিষিকাময় পরিস্থিতির শিকার হয়ে শারিরীক অবস্থার অবনতি হতে থাকে।
তার বড় ছেলে রিয়াদ হোসেন রাজু জানান, হামলার সময় গফুর ভূঞাকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষির শিকার হন। তার শরীরে অস্ত্রোপচারের স্থানে এসময় একটি ঘুষি লাগে। এতে তার রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তিনদিনের রক্তক্ষরণে অবস্থার অবনতি হলে শনিবার সকালে তাকে ঢাকায় নেয়ার পথে সাড়ে ৯টার দিকে পথিমধ্যে মারা যান। তার মৃত্যুর খবরে এলাকায় শোক-ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গ্রামের বাড়ি সদর ইউনিয়নের জগতপুর এলাকায় নামাজে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
কেন বুধবার হামলা
মালিকানা দাবী করে বাড়ি ছেড়ে দিতে বিভিন্নসময় অব্যাহত হুমকি-ধামকির পর বুধবার দিনদুপুরে হামলা চালানো হয় ভূঞা ম্যানশনে। পৌর শহরের জনাকীর্ণ এই এলাকায় প্রকাশ্যে হামলা হলেও কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। ওইদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিরা ছিল ভোটে ব্যাস্ত।
স্থানীয়দের মতে, নির্বিঘ্ন হামলা করতেই পূর্বপরিকল্পিতভাবে ২৯ মে বুধবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দিনকে বেছে নেয় প্রতিপক্ষরা। খবর পেয়ে ভোটের ডিউটিতে থাকা পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে এলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। আহতদের উদ্ধার করে তৎসংলগ্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।
মামুনের অস্বীকার
দাগনভূঞা পৌর শহরের হাসপাতাল রোডের ভূঞা ম্যানশনে হামলার ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জয়নাল আবদীন মামুন। ভূঞা ম্যানশনের মালিক আবদুল গফুর ভূঞা ঘটনার পর পুলিশ ও সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার জন্য মামুনকে দায়ী করেন। এর আগে তিনি জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী সহ বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের দ্বারস্থ হয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করেন।
কিন্তু ঘটনার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন জয়নাল আবদীন মামুন। তার দাবী, কারো প্ররোচনায় গফুর ভূঞা তার নাম বলেছেন। এছাড়া গফুর ভূঞার প্রতিপক্ষ সয়েল সাহা থেকে আমমোক্তারনামা গ্রহণকারী ইকবাল মামুনের ঘনিষ্ঠ নয় বলে দাবী করেন। তবে গফুর ভূঞার সাথে জায়গা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত থেকে মামলার রায় সয়েল সাহার পক্ষে পেয়েছেন তিনি জেনেছেন। এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত না হতে তিনি সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি অনুরোধ জানান।