নাজমুল হক
পোশাক জাতী ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। কোথাও কোথাও নারী ও পুরুষের পোশাক সেই দেশ ও জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য প্রকাশ করে। পোশাক দেখা বলা যায় সে কোন দেশের নাগরিক। কোন জাতির প্রতিনিধিত্ব করছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন নিজস্ব পোশাক পরে, মুসলমান ধর্মের নারী ও পুরুষের পোশাক আছে। উপমহাদেশে নেপাল ভুটান শ্রীলঙ্কা মালদ্বীপ পাকিস্তান রাস্ট্রের নিজস্ব পোশাক আছে। ভারতে হিন্দুদের টুপি আছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠির নিজস্ব পোশাক ও সংস্কৃতি আছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের নিজস্ব কোন পোশাক নেই।
বাংলাদেশে হাজার বছরের ঐতিহ্য পোশাক ও সংস্কৃতি মেনে বসবাস করার রীতি বিদ্যমান রয়েছে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছাত্রী শালীনতা বজায় রেখে পোশাক পড়ার অধিকার নিয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশি পোশাক ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। মাননীয় বিচারকবৃন্দ পোশাকের শালীনতা ও শালীন পোশাক ও সংস্কৃতির পক্ষে রায় দিয়েছে।
ইংরেজ শাসনকালে কেরালা রাজ্যে হিন্দু নারীদের স্তনকর প্রদান করতে হতো। ঐ সময় নিয়ম ছিলো যে শুধু ব্রাহ্মণ নারী ব্যতিত অন্য কোন হিন্দু নারী তার স্তনকে ঢেকে রাখতে পারবে না। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের নারীরা তাদের স্তনকে এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারবে। বাকি হিন্দু নারীদেরকে প্রকাশ্যে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হবে। ব্রিটিশ ভারতে সাধারণ হিন্দু নারীরা নারীর অধিকার আদায়ের জন্য ১৮০৩ সালে স্তনকেটে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে নারীর সন্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। কোন ব্রাহ্মণ নারীর অধিকার আদায়ের জন্য এগিয়ে আসে নাই। ২০২২ সালে মুসলিম নারীরা পোশাক পরার স্বাধীনতার নামে উল্টো পথে হাটার জন্য রাস্তায় নেমেছে।
তবে যদি কোন নারী তার স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করতে চায়, তবে তাকে স্তনের সাইজের উপর নির্ভর করে ট্যাক্স বা কর দিতে হতো। বড় স্তন হলে বেশি কর আর ছোট স্তন হলে কম কর দিতে হতো।
১৮০৩ সালে নাঙ্গেলী নামে এক সাহসী হিন্দু নারী তার স্তনকে আবৃত করে রাখে। যখন গ্রামের ট্যাক্স কালেকটর তার থেকে স্তনকর চাইতে আসে, তখন নালেঙ্গী স্তনকরের বদলে ঘরের ভিতরে যেয়ে নিজের দুটি স্তনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে পাতা দিয়ে মুড়িয়ে ট্যাক্স কালেকটরের হাতে ধরিয়ে দেয়। স্তন কেটে ফেলার কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য নাঙ্গেলীর মৃত্যু হয়। স্ত্রীর মৃত্যুশোকে নালেঙ্গীর স্বামীও আত্মহত্যা করে। এই ঘটনার পর থেকেই স্তনকর বন্ধ হয়। স্তনকর বন্ধ করার জন্য দক্ষিণ ভারতীয় নারীদের বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। এমনকি স্তন ঢেকে রাখার অধিকার আদায়ের জন্য রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছে।
উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যখন কিছু নিচু হিন্দু নারীরা তাদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার দাবি করে, তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরোহিতরা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে নিটু বর্ণের নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্মবিরোধী কাজ বলে প্রচারণা চালিয়ে ছিল।
তখন নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা ১৮৫৯ সালে স্তন ঢেকে রাখার অধিকার আদায়ের আন্দোলন গড়ে তোলে এবং দক্ষিণ ভারতে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গার উদ্দেশ্যই ছিলো নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা। সেই দাঙ্গায় অনেক নারী মারা যায় এবং শত শত নারী আহত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা আন্দোলনে নেমেছিলো যাতে তারা স্তন ঢেকে বøাউজ পড়ে শাড়ী পড়তে পারে, স্তন ঢেকে রাখতে পারে।
নিম্নবর্ণের হিন্দুদের স্তন নিয়ে নগ্নতা’র প্রথা টিপু সুলতান মোটেও পছন্দ করেননি। তিনি চেয়েছিলেন এই নগ্নতা বন্ধ হোক। কিন্তু তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে জবরদস্তি কিছু করতে পারেননি। তাই তিনি হিন্দু নারীদেরকে আহবান করেছিলেন, “যদি তোমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো, তবে কাপড় পরার অধিকার পাবে। ইসলামে নগ্নতার কোনো স্থান নেই।” টিপু সুলতানের ঐ কথা শুনে হাজার হাজার নিচু বর্ণের হিন্দু নারী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
ব্রিটিশ ভারতে নিমবর্ণের হিন্দু নারীরা নিজের সন্মান ও ইজ্জত রক্ষার জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো। কেবলমাত্র নিজের শরীরকে আবৃত করার অধিকার পাবার জন্য। বাংলাদেশে’র কিছু বিপথগামী নারীরা পোশাকের স্বাধীনতার নামে উল্টো পথে হাটছে। ইংরেজ শাসনকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী নাঙ্গেলী স্তন ঢেকে রাখার জন্য নিজের জীবনকে বলিদান দিলো, নারীরা ইংরেজ সৈন্যদের সাথে লড়াই চালিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ করলো, এখন দেখা যাচ্ছে ইংরেজদের উত্তরসুরী কিছু সংখ্যক নারী স্তন থেকে কাপড় সরানোর জন্য বাংলাদেশে ‘আন্দোলন’ করছে। পোশাকের শালীনতা না স্বাধীনতা এখন জাতির কাছে বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নাঙ্গেলীসহ শতশত নারী স্তনকে ঢেকে রাখার জন্য জীবন উৎসর্গ করলো আর বাংলাদেশের নারীরা সেই স্তনকে উন্মুক্ত করে রাখার জন্য আন্দোলন করছে। কি জঘন্য তাদের রুচিবোধ। নাঙ্গেলী বøাউজ পরিধান করা উদ্দেশ্যে জীবন ব্রিটিশ ভারতে দিলো আর বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক নারী সেই বøাউজ খোলার জন্য আন্দোলন করছে।
সম্রাট শাহজাহানের সংগ্রহ করা কহিনুর চুরি করে নিয়ে গেছে ব্রিটিশ সরকার। যাহা রানী ভিক্টোরিয়া এবং এলিজাবেথ এর মাথায় চুরির মুকুট শোভা পেয়েছে। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের আগ পর্যন্ত সুবা বাংলা ছিল বিশ্বের মধ্যে ঐশ্বর্যশালী দেশ। তখনকার অনেক ইউরোপীয়রা বলেছেন, বাংলার মানুষের প্লেটে কম করেও তিন পদের খাবার থাকত। ঘি, মাখন খাওয়া তাদের জন্য সাধারণ বিষয় ছিল। তাদের গায়ে যে পোষাক ছিল তা ইউরোপিয়ানদের কাছে ভাবনারও অতীত।
নবাবের পতনের পর মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও ওড়িশার খাজনা উঠানোর দেওয়ানী লাভ করে। মাত্র লাখ দেড়েক রূপিতে দেওয়ানী কিনে নেন রবার্ট ক্লাইভ। খাজনা আদায় করে রবার্ট ক্লাইভ হিসাব করে দেখেন দেড় লাখ রূপি দিল্লিতে দেবার পরও কোম্পানির প্রায় ১৬ লাখ রূপি। বাস্তবে সেটি কোটি রূপিতে ছাড়িয়ে যায়।
খাজনার বাজনা শোধ করতে যেয়ে ফসলে ভরপুর একটি জনপদ স্রেফ শশ্মান হয়ে যায়। সব থেকে বেশি সংকটে পড়ে ঢাকা। বাণিজ্যিক শহর গোরস্তানে পরিণত হয় ব্রিটিশ অত্যাচারে। কোম্পানির হাতে রাজস্ব উত্তোলনের দায়িত্ব থাকায় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব উত্তোলন শুরু হয়।
বাংলা ১১৭৬ সাল আর ১৭৭০ ইংরেজি। সিরাজের পতনের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। সোনার বাংলা গোরস্থানে পরিণত হয়। এই দুর্ভিক্ষে ১ কোটি লোক মারা যায়। এটা দুনিয়ার নিকৃষ্টতম দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের কারণ ফসল উৎপাদন কম নয়, দুর্ভিক্ষের কারণ সে বছর মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায়। যে বছর দুর্ভিক্ষ হলো তার আগের বছর আদায়কৃত রাজস্ব ছিল দেড় কোটি রূপি। আর যে বছর দুর্ভিক্ষ হলো সে বছর আগের বছরের তুলনায় ৫ লাখ ২২ হাজার রূপি বেশি আদায় হয়েছিল।
ঢাকার মসলিনের কদর ছিল আকাশ ছোঁয়া। ব্রিটেন থেকে কোম্পানি কলের তৈরি কাপড় আনলেও সেটা এখানে চলত না। তারপর তারা আমাদের অতীতের হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত কেটে দেয় যাতে তারা মসলিন বুনতে না পারে।
গোটা মুঘল আমলে সুবা বাংলা ১৯টি, পরে ৩৪টি ছোট ছোট নবাব ও রাজাদের অধীনে শাসন হয়েছে। সেই শাসনের বেশিরভাগ সময় মুঘল শাসনের বিষয়টি অনেক আলগা ছিল। বাংলা মুঘল শাসনের অধীনে ছিল ২৩০ বছর। এই ২৩০ বছরে বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়নি। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিম হেরে যাবার পর দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী কিনে নেয় কোম্পানি। এরপর মাত্র ৬ বছরের মাথায় ১৭৭০ সালে বা বাংলা ১১৭৬ সনে দুর্ভিক্ষ হয় যাতে মারা যায় ১ কোটি মানুষ। এটা নির্মম, ভয়াবহ উপনিবেশিক শোষনের ফল।
কোম্পানির শাসন ও ব্রিটেনের শাসনের মধ্যে কত লোককে তারা জোরপূর্ব দাস বানিয়েছে সেই হিসাব নতুন করে আমাদের নেয়া দরকার।
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ের দিকে যে দুর্ভিক্ষ হয় তাতে বাংলার ৩০ লক্ষ লোক না খেয়ে মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষ কিন্তু ফসল উৎপাদন কম হয়েছিল সে কারণে না, বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলা থেকে সব খাদ্য শস্য ব্রিটেনে নিয়ে মজুদ করা হচ্ছিল। যুদ্ধে যেখানে মাত্র ৪০ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য লড়ছিল সেখানে ভারতীয় সৈন্য ছিল প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার। ভারতীয়রা মরেছেও যুদ্ধের ময়দানে অকাতরে।
দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত বেজে উঠার আগে তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে জানানো হয়েছিল, তখন রাজা ছিলেন ষষ্ট জর্জ, মানে দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা। চার্চিল কোন প্রদক্ষেপ গ্রহণ করে নাই। সোনার বাংলাকে মৃতপুরি বানালো ব্রিটিশ সরকার। উপমহাদেশ লুটপাট এর প্রতিকী চিহ্ন চুরির হিরা কোহিনূর বহন করতেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ ব্রিটিশ ভারতে লুটপাটকে সহযোগীতা করার শামিল। দুর্ভিক্ষ লাগিয়ে রক্তের সাথে বেঈমানি। বাহাদুর শাহ পার্ক নামে ঢাকায় একটা পার্ক আছে। ওখানে ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতাকার্মী বিপ্লবীদের লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলার লাশ শহরে টেনে-হেঁচড়ে নেয়া হয়েছিল।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক জুলুম বন্ধ করার জন্য নারীর জীবন দিতে হয়েছে। ব্রিটিশ শোষণ থেকে মুক্তির জন্য অকাতরে জীবন দিয়েছে লক্ষ লক্ষ তরুন যুবক শ্রমিক কৃষক। সেই বিপ্লবীদের বড় অংশ বাংলাদেশের। আমাদেও পূর্বপুরুষরা তাদের জীবনবাজি রেখে ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। আর আমরা আজ সেই ঔপনিবেশিক শোষনের ক্ষতচিহ্ন এলিজাবেথের জন্য কাঁদছি। কী ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা। ব্রিটিশ আগ্রাসন বিরোধী শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।