আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যা যা ব্যবহার করি, তার অধিকাংশই প্লাস্টিকের তৈরি। প্লাস্টিক হচ্ছে কৃত্রিমভাবে তৈরি পলিমার, যা মূলত জীবাস্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে রাসায়নিক উপায়ে তৈরি করা হয়। প্লাস্টিক সাধারণভাবে সহজেই বাঁকানো যায় (নমনীয়), ক্ষয়রোধী, দীর্ঘস্থায়ী এবং সস্তা। আলেকজান্ডার পার্কস ১৮৫৫ সালে প্রথম মানবসৃষ্ট প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন এবং এর নাম দেন পার্কেসিন। এটি তৈরি করা হয়েছিল উদ্ভিদের সেলুলোজ ও নাইট্রিক অ্যাসিডের মধ্যে বিক্রিয়া করে। তবে ১৯০৭ সালে লিও বেকল্যান্ড সম্পূর্ণ সিনথেটিক প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন এবং এর নাম দেন বেকেলাইট। তিনিই প্রথম প্লাস্টিক শব্দটি ব্যবহার করেন। এছাড়া যে দুজন বিজ্ঞানী প্লাস্টিক উৎপাদনে অনন্য অবদান রাখেন, তারা হলেন নোবেলজয়ী হারমেন স্টাওডিংগার (পলিমার রসায়নের জনক) এবং হারমেন মার্ক (পলিমার পদার্থবিদ্যার জনক)। ডুপনট করপোরেশন কর্তৃক উদ্ভাবিত নাইলন ছিল বাণিজ্যিকভাবে সফল সিনথেটিক থার্মোপ্লাস্টিক পলিমার। ক্রমে অ্যাক্রাইলিক, পলিস্টাইরিন, পলিভিনাইল ক্লোরাইড, সিনথেটিক রাবার, পলিইথিলিন (পলিথিন) ইত্যাদি প্লাস্টিকের আবিষ্কারের ফলে জীবনের সব স্তরে প্রয়োজনীয় প্রায় সব দ্রব্য ও দ্রব্যাদির অংশবিশেষ প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি হচ্ছে। প্রাকৃতিক ধাতব, প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে তৈরি যেকোনো দ্রব্যের চেয়ে প্লাস্টিক সস্তা, ব্যবহারবান্ধব এবং দীর্ঘস্থায়ী। ফলে বিদ্যুৎগতিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং অবচেতন মনেই আমরা জল, স্থল ও অন্তরীক্ষের সবকিছুকে প্লাস্টিকদূষণে দূষিত করে ফেলেছি।
প্লাস্টিকদূষণ আজ মানুষসহ অন্য সব জীবের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলছে। পরিবেশে পচনরোধী প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্য, উপজাত, কণিকা বা প্লাস্টিকের দ্রব্য নিঃসরিত অণুর সংযোজন; যা মাটি, পানি, বায়ুমণ্ডল, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও মানবস্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে, তাকে সাধারণভাবে প্লাস্টিকদূষণ বলা হয়। প্লাস্টিক যদি ৫০ মাইক্রনের কম পুরু হয় , তাহলে সে প্লাস্টিকগুলো সযে স্থানে পেলা হয় সে স্থানে একই রকম ভাবে থেকে যাবে আর সে মাটিতে কোন গাছ জন্মাতে পারবেনা। পরিবেশের উপর প্লাস্টিক দ্রব্যাদির এমন নেতিবাচক প্রভাবকে “প্লাস্টিক দূষণ” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়৷গত ৫০ বছরে পৃথিবীতে মাথাপিছু এক টনের বেশি প্লাস্টিকের দ্রব্য উৎপাদন করা হয়েছে। এসব পচনরোধী প্লাস্টিক বর্জ্যের শতকরা ১০ ভাগ পুড়িয়ে ধ্বংস করা হলেও বাকি ৯০ শতাংশের বেশি বিশ্ব পরিবেশকে নানাভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। এসব ক্ষতিকর পচনরোধী বর্জ্য পরিবেশে ৪০০ থেকে ১ হাজার বছর পর্যন্ত থাকতে পারে এবং নানা রকম মাইক্রো বা ন্যানো কণা বা ক্ষতিকর পদার্থ নিঃসরণ করে প্রতিবেশে ও মানবস্বাস্থ্যে ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পৃথিবীতে প্রতি বছর ৪৫ কোটি টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যোগ হচ্ছে। এ বর্জ্যের ৫১ শতাংশ উৎপাদন হচ্ছে এশিয়া মহাদেশে। প্লাস্টিকদূষণ বিশ্বের সব দেশে এবং সব পরিবেশে এমনকি মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া, গভীর সমুদ্রের তলদেশ এবং মেরু অঞ্চলেও বিস্তৃত।এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৫০ থেকে ২০১৫ এ সময়কালের মধ্যে পৃথিবীতে জমা হওয়া প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৬৩০ কোটি টন (১ হাজার কেজিতে ১ টন)। অবাক হওয়ার তথ্য হচ্ছে, জমা হওয়া সে বর্জ্যের ৭৯% এখনো পৃথিবীতে বিদ্যমান আছে৷ আর যদি প্লাস্টিক বর্জ্যের এ ধারা অব্যাহত থাকে তবে ২০৫০ সালে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ১২০০ টনে গিয়ে দাঁড়াবে।
পরিবেশে অপচনশীল নানা রকম প্লাস্টিক বর্জ্যের সঙ্গে অতিবেগুনি রশ্মি এবং পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের মিথস্ক্রিয়ার ফলে মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকের কণা এবং নানা রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, যেমন বিসফেনল- এ পরিবেশে নির্গত হয়। এসব মাইক্রো ও ন্যানো কণা এবং নিঃসৃত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মানুষ ও অন্যান্য জীবের হরমোনাল সিস্টেম নষ্ট করতে পারে। ফলে প্লাস্টিক দূষণ মানুষ ও অন্যান্য জীবের প্রজননক্ষমতা নষ্ট করে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টি করে। এছাড়া এসব প্লাস্টিক ন্যানো কণা এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মানুষ ও অন্যান্য জীবের কোষাভ্যন্তরে অবস্থিত ডিএনএ ও আরএনএ অণুর মধ্যে পরিবর্তন করে ক্যান্সার বা স্নায়ুতন্ত্র বিকল করতে পারে। তবে একক ব্যবহার পলিথিন ব্যাগ প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক। কারণ এদের যত্রতত্র ব্যবহার এবং ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার ফলে নিষ্কাশন নালা, খাল ও নদীর প্রবাহ বিনষ্ট হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। আক্রান্ত হচ্ছে জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদের শিকড়ের বিস্তার।
এছাড়া এসব পলিথিন বর্জ্যের সর্বশেষ গন্তব্যস্থল হচ্ছে সমুদ্র। প্লাস্টিক বর্জ্য কর্তৃক সামুদ্রিক প্রতিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, বর্তমানে সমুদ্রে ৫ দশমিক ২৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রো ও ম্যাক্রো প্লাস্টিকের কণা জমা হয়েছে। প্রতি বর্গমাইল সমুদ্রে ৪৬ হাজার টুকরা/কণা প্লাস্টিক জমা হয়েছে। সমুদ্রে জমাকৃত প্লাস্টিকের মোট ওজন ২ লাখ ৬৯ হাজার টন। প্রতিদিন ৮০ লাখ টুকরা প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে পতিত হচ্ছে। এভাবে জমতে জমতে বড় বড় মহাসাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য জমাকৃত এলাকা (প্যাচ) তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রশান্ত মহাসাগরে বর্তমানে প্লাস্টিক বর্জ্যের প্যাচের আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। অনুরূপ প্লাস্টিক বর্জ্য জমাকৃত এলাকা অন্যান্য মহাসাগর এবং সাগরেও সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি বছর ৮৩০ কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ ও প্লাস্টিকের টুকরা আমরা অসচেতনভাবে সমুদ্রসৈকতে ফেলে আসছি। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালে সমুদ্রে মাছের সংখ্যার চেয়ে প্লাস্টিকের দ্রব্য ও কণার সংখ্যা বেশি হবে।ফলে মৎস্য, তিমি এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু সামগ্রিকভাবে সামুদ্রিক প্রতিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্লাস্টিকদূষণের ফলে প্রতি বছর ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি এবং ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মৃত্যুবরণ করে। বর্তমানে সমুদ্র থেকে আহরিত প্রতি তিনটি মাছের মধ্যে ১টি মাছের পেটে প্লাস্টিকের দ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে। প্লাস্টিকের দ্রব্যের মধ্যে মাইক্রোবিডস থাকে, যা সহজেই পরিবেশ দূষণ করতে পারে। এসব মাইক্রোবিডস জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের অন্যান্য জীবের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর ফলে অদৃশ্য মাইক্রো প্লাস্টিকের কণা ভয়ংকরভাবে বায়ুদূষণ ঘটায়, যা নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ফুসফুসে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল ঞযব ংবধঃঃষবং ঞরসব (দ্যা সিটলস টাইম) নামক দৈনিকে একটি খবর খুব সাড়া দেয়। সীটল সমুদ্র সৈকতে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায় একটি বিশাল তিমিকে। পরে যখন সেই তিমির মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণা করা হয়, তখন দেখা যায় তিমির পাকস্থলীতে পাওয়া গিয়েছে বহু প্লাস্টিক পদার্থ। সেসব প্লাস্টিককেই সেই তিমির মৃত্যুর কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
আমাদের পানীয় জলের শতকরা ৮০ ভাগ পানি মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকের কণা দ্বারা দূষিত। এসব অদৃশ্য প্লাস্টিকের কণা ও হরমোনাল সিস্টেমের প্রভাবকারী প্লাস্টিক নিঃসৃত বিষাক্ত দ্রব্যাদি খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানবস্বাস্থ্যকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। প্লাস্টিক বর্জ্য নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থ মাটি, পানি ও বায়ুমণ্ডলকে বিষাক্ত করে চলছে। প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর ফলে ২০১৯ সালে বায়ুমণ্ডলে ৮ দশমিক ৫ কোটি টন কার্বন ডাই- অক্সাইড যোগ হয়েছে। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের উষ্ণায়নের ১০-১৩ শতাংশ অবদান হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানোর মাধ্যমে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে। তার মধ্যে ৭৯ শতাংশ নানাভাবে পরিবেশে জমা হয়ে মানবস্বাস্থ্যসহ প্রকৃতির অন্যান্য জীবের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে।
পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৩৮১ কোটি টন প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ হচ্ছে একবার ব্যবহারযোগ্য (সিঙ্গেল ইউজ)। শুধু শতকরা ৯ ভাগ পুনর্ব্যবহার করা হয়। বর্তমান ধারা চলতে থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ পৃথিবীতে প্লাস্টিকের দ্রব্য উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হবে। প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করছে প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন ব্যাগ। প্রতি মিনিটে ১০ লাখ প্লাস্টিক ব্যাগ আমরা ব্যবহারের পর ফেলে দিচ্ছি। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্লাস্টিক ব্যাগ বর্জ্য ৫০ হাজার কোটি। প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন এবং দূষণে চীন পৃথিবীর সর্বোচ্চে।
বাংলাদেশে প্রতিদিন আট লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, তার মধ্যে শতকরা ৩৬ ভাগ পুনর্চক্রায়ণ, ৩৯ ভাগ ভূমি ভরাট এবং বাকি ২৫ ভাগ সরাসরি পরিবেশে দূষক হিসেবে যোগ হচ্ছে। খোদ ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। আমাদের এ প্রিয় শহরে আমরা ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে অবচেতন মনে অন্যান্য বর্জ্যরে সঙ্গে ফেলে দিচ্ছি। একশর বেশি ফ্যাক্টরিতে এসব পলিথিন ব্যাগ তৈরি হয়। পলিথিন ব্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে জলাবদ্ধতাসহ ঢাকা শহর কতটা বাসযোগ্যহীন এবং আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে, তা সবার জানা। পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে দেশে আইন হয়েছে ২০০২ সালে এবং ইহা বিশ্বে প্রথম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আইনের প্রয়োগের অভাব। পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার পর গত এক দশকে ঢাকা শহরে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বেড়েছে তিন গুণ। কী সাংঘাতিক পরিসংখ্যান! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যোগ হচ্ছে, যা সব ধরনের বর্জ্যের শতকরা ৮ ভাগ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ও এশিয়ান বিজ্ঞান একাডেমিগুলোর আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে প্লাস্টিকদূষণ মোকাবেলায় যেসব সুপারিশ গৃহীত হয় তা হচ্ছে: ১) বিশ্বব্যাপী ও আঞ্চলিক পর্যায়ে প্লাস্টিকদূষণ ব্যবস্থাপনা প্রণীত আইন ও নীতিমালাকে হালনাগাদ করতে হবে; ২) বাংলাদেশে প্লাস্টিকদূষণ ব্যবস্থাপনায় প্রণীত আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে; ৩) পরিবেশ সুরক্ষা নীতি ও প্লাস্টিকদূষণ নীতিমালাকে সমন্বয় করে আধুনিক জ্ঞানের ভিত্তিতে তা হালনাগাদ করতে হবে; ৪) প্লাস্টিকের দ্রব্যকে বারবার ব্যবহার ও পুনর্চক্রায়ণকে (রিসাইক্লিং) উৎসাহিত করতে হবে; ৫) যদিও আমাদের জীবনে প্লাস্টিকের দ্রব্যের ভূমিকা স্বীকার্য, তবে তা ব্যবহারে সতর্কতা এবং পরিমিতি আবশ্যক; ৬) পরিবেশে সহজে পচনশীল (বায়োডিগ্রেডেবল) প্লাস্টিকের ব্যবহারকে উৎসাহিতকরণ এবং পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ ও অন্যান্য পাটজাত দ্রব্যকে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারে প্রণোদনা প্রদান করতে হবে; ৭) বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে পলিথিন ও প্লাস্টিকের অন্যান্য দ্রব্যের ব্যবহার সীমিতকরণ এবং পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নিম্নোক্ত সুপারিশমালা জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্যও আহ্বান জানানো হয়:১) দেশে বর্তমানে ৫৫ মাইক্রন পুরুত্বের পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের আইন রয়েছে, তবে বাস্তবায়ন নেই। সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে ‘পরিবেশ সুরক্ষা পুলিশ ফোর্স’ গঠন করে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারে প্রণীত আইনের কঠোর বাস্তবায়ন সময়ের দাবি; ২) পূর্ণবয়স্ক মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন করা দুরূহ। কিন্তু শিশুদের জ্ঞানের পরিবর্তনের জন্য পাঠ্যপুস্তকে প্লাস্টিকদূষণের ভয়াবহতা এবং এর বিকল্প পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহারের সুবিধাগুলো শিক্ষা দিয়ে জাতিকে পরিবেশসচেতন ভবিষ্যৎ নাগারিক উপহার দিতে হবে; ৩) ১৪-১৫ মিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ প্রতিদিন ঢাকায় জলাবদ্ধতার মূল কারণ। পাটের সেলুলোজ দিয়ে সোনালি ব্যাগ তৈরি, যা সহজে কম্পোস্টে পরিণত হয়ে মৃত্তিকায় কার্বনের পরিমাণ বাড়ায়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পাটের তৈরি বিকল্প সোনালি ব্যাগ উৎপাদনে জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ। সোনালি আঁশের প্রডাক্টে সাবসিডি দিতে হবে; ৪) বিকল্প পাট/চাহিদা মেটানোর জন্য পাট উৎপাদন বাড়াতে হবে। বারোমাসি পাটের জাত আবিষ্কার করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে জৈবিক রোগ দমন এবং উৎপাদন বাড়াতে হবে। লবণাক্ততা সহনশীল পাটের জাত তৈরি করে উপকূলীয় এলাকায়ও পাট উৎপাদন করতে হবে; ৫) বাংলাদেশ টেলিভিশন, অন্যান্য স্যাটেলাইট টিভি, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্লাস্টিকদূষণ সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং পরিবেশসম্মত পাটজাত সোনালি ব্যাগ এবং অন্যান্য দ্রব্য ব্যবহারে উৎসাহিত করা। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দূষণমুক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ উপহার দেয়ার লক্ষ্যে এবং একবিংশ শতাব্দীতে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি অর্থনীতিকভাবে উন্নত সোনার বাংলা রূপায়ণে প্লাস্টিকদূষণ মোকাবেলায় জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা।
পরিশেষে বলতে চাই, প্লাস্টিকদূষণ আমাদের স্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, উন্নত জীবনযাপন এবং নিরাপদ খাদ্যের জন্য এক বিরাট হুমকি। সময়োপযোগী আইন তৈরি, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং প্লাস্টিকদূষণের ক্ষতিকর দিক ও করণীয় নিয়ে সমাজের সব স্তরে সচেতনতা সৃষ্টি একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের সোনালি আঁশের মাধ্যমে তৈরি সোনালি ব্যাগসহ প্লাস্টিকের বিকল্প অন্যান্য পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারে জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য সরকার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে। দেশে প্লাস্টিকদূষণের মাত্রা ও প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ এবং দূষিত প্রতিবেশকে পুনরুদ্ধারের জন্য জাতীয়ভাবে আন্তঃবিভাগীয় সমন্বিত গবেষণা প্রয়োজন। পরিবেশকে আমরা যতখানি দেব পরিবেশ ঠিক আমাদের ততখানিই ফেরত দেবে। প্লাস্টিক আমাদের জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সেটি অস্বীকারের কোন উপায় নেই। কিন্তু, প্লাস্টিক ব্যবহারের পর নির্দিষ্ট স্থানে সংরক্ষণের দায়িত্ব কিন্তু আমাদের। মার্গারেট মিডের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, “আমরা যদি পরিবেশ ধধংস করি তবে আমাদের কোন সমাজ থাকবেন।”
লেখক : ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।