ফেনীতে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবী খুব জোরালো ভাবে উত্থাপন করার অনেক গুলো যৌক্তিক কারন আছে। অনেকে হয়তো বলবেন একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবী দীর্ঘ দিনের, সেই দাবীই পূরণ হচ্ছেনা সেখানে আবার আর্ট কলেজ। আমি এই মতের সাথে একাত্মতা পোষণ করেই বলছি, ফেনীতে একটি মেডকেল কলেজ, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা একান্ত জরুরি। একই সাথে চলমান বিশ্বের বৈচিত্রপূর্ণ ও নান্দনিক উৎকর্ষতায় সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে একটি আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করাও এই সময়ের যৌক্তিক দাবী।
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা যদি আমাদের প্রজন্মকে উপযুক্ত জ্ঞান ও দক্ষতায় সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে না পারি তাহলে অবহেলিত এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তালিকায় ফেনীর অবস্থান হবে লজ্জার। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক তথা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে রাজনীতি, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে ফেনীর আছে গৌরবময় অবস্থান। সে যায়গা থেকে শিল্পকলা চর্চায় ফেনী কেন পিছিয়ে থাকবে? এমন প্রশ্নও যৌক্তিক।
একথা দ্বিধাহীন কন্ঠে বলা যায়যে পৃথিবীর সকল ভাষা ও ভাষাহীন মানুষের পাঠের জগৎ একখানা ছবি। যখন ভাষা আবিস্কার হয়নি বা মানুষ ভাষা আয়ত্ম করতে সক্ষম হয়নি ঐ সময়ে মানুষেরা রেখা চিত্রের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতো। আবিস্কৃত প্রাচীন গুহাচিত্র বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীগণ এমন তথ্য প্রকাশ করেছেন। একটি ছবির ভাষা সকল মানুষের সহজ পাঠ্য বিষয় হয়ে মনের কোনে সযতনেই ধরা দিয়ে থাকে। এ ভাষা পড়ার জন্য কাউকে বিদ্যালয় কিংবা শিক্ষক থেকে তালিম নিতে হয়না। প্রাচীন গুহাবাসী নিয়ান্ডাথাল বা খাড়া মানুষ, বুদ্ধিমান মানুষ থেকে যে আধুনিক মানুষের বিশ্ময়কর পথচলা তার সকল স্তরেই চিত্রশিল্পের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়।
একসময় চিত্রশিল্প রাজা বাদশাদের দরবার বা অন্দর মহলে চিত্ত ভৈববের আলো ছড়াতো। সেই সব ছবিতে রাজার মহত্ব কিংবা ব্যক্তিত্বকেই পুটিয়ে তোলা হোতো। কিন্তু তৎপরবর্তীতে পুঁজীবাদী সাম্রাজ্যবাদ বিকাশের ধারাবাহিকতায় তা পুঁজিপতি অধিকতর ধনীক ও বণিক শ্রেণীর কব্জায় অলংকারিক শোভা বর্ধনে ভ’মিকা রাখতে থাকে। কিন্তু কালের বিবর্তনে ও মানুষের শ্রেণী বৈষম্য সামাজিক রীতি তথা জীবন যাপন বোধের পরিবর্তন ও গনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ক্রম প্রসারের ফলে চিত্রশিল্পের মাঝেও বহুমাত্রিক পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে। নৃত্যরূপ ভোগবাদী শিল্প থেকে কাগজে কাপড়ে ছবি আঁকা, কাঠ, পাথর খোদাই করে ছবি নির্মাণ ও প্রদর্শন থেকে বেরিয়ে এসেছে ছবির ঘরামি প্রকাশ ও নির্মণ। শিল্প বিপ্লব থেকে বর্তমানের তথ্য প্রযুক্তির যুগ পরিক্রমায় চিত্রশিল্পেও এসেছে বহুমাত্রিক নান্দনিক প্রকাশ ভংগি ও সর্বজনে ব্যবহার। সর্বজনে ব্যবহারের ধারণাগত ব্যাখ্যাটি বা বক্তব্যটিতে বিস্তর আলোচনার দাবী রাখে। তবে সংক্ষেপে বললে এভাবে বলা যায়, মানুষ ঘর থেকে বের হতে যে যেমনতর পোশাকই পরে বের হোননা কেন তার নির্মাণে প্রথাগত এক বা একাধিক নকশাবিদের হাতে এর চুড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে। মানুষের অঙ্গ সৌন্দর্য বর্ধনের যে মাত্রায় আমরা পোষাক-আশাক পরছি তা নিয়ে কে কতখানি ভাবছি। এই পোষাক একদিনে আসেনি। হাজার বছরের কাল অতিক্রম কওে বিবর্তনের নানান ধারাবাহিকতায় মানুষ পোষাকে আচ্ছাদিত হতে শিখেছে। মানুষ জন্মেও শারীরবৃত্তিয় লজ্জা ডাকতে শুরু করেছে শিকারী প্রাণীর চামড়া, গাছের পাতা, ছাল ইত্যাদি দিয়ে। জীবনের বহুমাত্রিক ধাপ অতিক্রমের ধাপে ধাপে মানুষ মানুষকে আধুনিকতায় উন্নিত করতে সামর্থ হয়েছে। প্রাকৃতিক বস্তু দিয়ে তন্তু এবং তন্তু থেকে যর্যায়ক্রমে সুতার আবিস্কার, আবার প্রকৃতি থেকে রং নিয়ে নিয়ে সুতার রঙীন বুনন, সুতা থেকে কাপড় শেষে কাপড়কে শরীর বৃত্তে ব্যবহারের কৌশল আবিস্কার মূলত এ সবের মধ্য দিয়ে বয়ন শিল্পের বিকাশ, পোষাক শিল্পে রূপায়ণ। এখন এ শিল্পে ফ্যাশন ডিজাইন নামে বহুমাত্রিক অধ্যয়নের চর্চ্চা চালু হয়েছে।
প্রত্যেকটি নতুন কাপড়ের গায়ে নানান ধরণের ট্যাগ ঝুলে থাকতে দেখা যায় কিন্তু এর প্রতিটি স্তরে এক একজন ডিজাইনার বা নকশাবিদের হাতের ছোঁয়া রয়েছে। বর্তমানে মানুষের যে কোন ধরণের চাহিদা পূরণের জায়গায় প্রতিটি বস্তু বা পণ্যেও কোন না কোন নকশা প্রিন্ট প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
বাংলাভাগে এক সময় এ দেশে কোন আর্ট কলেজতো দুরের কথা, একটা আর্ট স্কুলও ছিলোনা। একটু পরে এ বিষয়টি আরো একটুখানি খোলসা করে আলোকপাত করছি। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিভাগীয় শহর তথা অনেক জেলাতেও আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান এমনি এমনি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শিক্ষার চাহিদা ও প্রয়োজনের আলোকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝ খানে ফেনী একটি গুরুত্ব পূর্ণ অঞ্চল। কৃষি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সকল ক্ষেত্রেই এ অঞ্চলের মানুষ দেশের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। তথ্য প্রযু্িক্তর এই দিনে শিল্পকলা চর্চ্চার পূর্ণাঙ্গ কোন প্রতিষ্ঠান এখানে থাকবেনা তা হতে পারেনা। আগেই বলেছি চিত্রকলা এখন আর শুধু ছবি আঁকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। এখান থেকে অনেক সম্ভাবনার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার কোন বিকল্পই হতে পারেনা। পেশা হিসেবে চারুশিল্প গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে। চলচ্চিত্র নির্মাণে, টেলিভিশনে, নাটক মঞ্চায়নে, পত্র-পত্রিকায়, বিজ্ঞাপন ও প্রচার ক্ষেত্রে, মুদ্রণ শিল্পে, পুস্তক প্রকাশনায়, পোষাক পরিচ্ছদের নকশায়, ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ডিজাইনে, স্থাপত্য শিল্পের বহিরাঙ্গন ও অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রভৃতি অনুষ্ঠানে শিল্প সুষমা ও রুচিশীল উপস্থাপনায় চারুকলা শিল্পীদের প্রয়োজন ও গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ফেনীতে বর্তমানে জেলা-উপজেলায় তথা ইউনিয়ন পর্যায়েও অনেক ছবি আাকা ও গানের স্বতন্ত্র স্কুল চালু হয়েছে। কিন্তু ৪৮ এর দেশ ভাগের পর জয়নুল আবেদীন’রা বাংলাদেশে তথা ঢাকায় এসে দেখলেন এখানে আর্ট কলেজতো দুরের কথা কোন আর্ট স্কুলও নেই। জয়নুল আবেদীন, শফি উদ্দিন আহমদ, পটুয়া কামরুল হাসান’রা একত্রিত হয়ে প্রথম আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। যর্যায়ক্রমে সেই আর্ট স্কুল বর্তমানে ঢাকা জাতীয় জাদুঘরের পাশে চারুকলা ইন্সটিটিউট নামে মহিরুহ প্রতিষ্ঠানে রুপ লাভ করেছে। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক গুলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও চারুকলা বিভাগ নামে স্বতন্ত্র বিভাগ খোলা হয়েছে। চারুকলা শিক্ষায় যে ব্যাপক চাহিদা তৈরী হয়েছে এটি তারই নামান্তর। বাংলাদেশের চিত্র শিল্পীরা এখন দেশের গন্ডি চাড়িয়ে বিশ্ব দরবারেও দেশের সুনাম ছড়িয়ে দিয়েছে। এস. এম. সুলতান, শাহাব উদ্দীন, মনিরুল ইসলাম, জয়নুল আবেদীন, শফি উদ্দীন আহমদ প্রমূখ।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে চারুকলার শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট এগিয়ে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনী উন্নতি ও প্রসারের ফলে চিত্রশিল্পে বহুমাত্রিক গতি এসেছে। বিশ্বজনীন চাহিদা তৈরী হয়ে আছে এ ক্ষেত্রে। এ আয়োজনে ফেনীকে দুরে সরিয়ে রাখা যায়না। তাই ফেনীতে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠায় এখনই উদ্যোগ গ্রহন করা প্রয়োজন।
লেখক : চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।