দৈনিক ফেনীর সময়

ফেনীতে বন্যায় লাশের সংখ্যা বাড়ছে

ফেনীতে বন্যায় লাশের সংখ্যা বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিনিধি :

ফেনীতে ভয়াবহ বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৯ জনে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে ১৮ জন পুরুষ, সাতজন নারী ও চারজন শিশু রয়েছে। নিহতদের মধ্যে ২০ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে, বাকি নয়জনের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচেছ তারা বন্যার কারনেই মারা গেছে, লাশের তদন্ত সাপেক্ষে মৃত্যুর কারন জানা যাবে বলে জানান জেলা প্রশাসক। তবে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ নিখোঁজ ডায়েরী করেনি।

ওমান প্রবাসী মাসুদ খান জানান, তার বাবা আলীম উল্লাহ (৭৩) মারা যাওয়ার পর লাশ কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাতসতী গ্রামের নাছির ভূঁইয়া বাড়ির বাসিন্দা। যখন পুরো গ্রাম পানিতে তলিয়ে ছিলো। আলীম উল্লাকে কবর দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। স্বজনরা মরদেহ কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। সঙ্গে একটি চিরকুটে তাকে দাফনের অনুরোধ করা হয়। পানি নামার পর লাশ উদ্ধার করা হয়।

নিহত কয়েকজনের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাতের অন্ধকারে ফুলগাজী-পরশুরামে হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে মারা যায় কয়েকজন। মোবাইল যোগাযোগ বিচিছন্ন থাকায় কেই কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। অসুস্থ বৃদ্ধরা পানির স্রোতের সাথে নিরাপদ আশ্রয়ে ও হাসপাতালে যেতে পারেননি। নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে মারা যায় দুইজন।

বন্যার সময় স্বাভাবিকভাবে মারা যাওয়া কয়েক জনের লাশ দাফন করতে না পেরে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার বরাত দিয়ে জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বন্যায় ফেনী সদরে আটজন, দাগনভূঞায় তিনজন, ফুলগাজীতে সাতজন, সোনাগাজীতে ছয়জন, ছাগলনাইয়ায় তিনজন এবং পরশুরামের দুইজন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ফেনী সদর উপজেলায় অজ্ঞাত তিনজন, সোনাগাজীতে চারজন এবং ছাগলনাইয়া উপজেলায় একজন অজ্ঞাত রয়েছেন।

ফেনী মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, গত কয়েকদিন ধরে শুধু লাশের খবর পেয়েছি। অনেকে ফোন করে লাশের খবর দিচেছ। বুধবারও দুজন ব্যক্তি ফোন করে বলেছেন, তারা একটি লাশ দেখতে পেয়েছেন। আমি ফোর্স পাঠিয়ে উদ্ধার করি। বন্যায় এখন পর্যন্ত ফেনী সদরে আটজন মারা গেছেন বলে জানান তিনি।

লেমুয়া ইউনিয়নের তেরবাডড়িয়া এলাকার সালে আহমেদের মেয়ে উম্মে সাইমা (৮), মৌটুবি ইউনিয়নের ভগবান দেবনাথ এর ছেলে রবীন্দ্র কুমার নাথ (৫৮), ছনুয়া ইউনিয়নের দমদমা গ্রামের আলি আহমেদের ছেলে কবির আহমেদ (৬৫) কালিদহ ইউনিয়নের হোসেন মেম্বার বাড়ির সুলতান আহমেদের স্ত্রী অজিফা খাতুন (১১৫) ও অজ্ঞাত চারজনের লাশ পাওয়া গেছে।

পরশুরাম থানা সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের ধনিকুণ্ডা গ্রামের বাসিন্দা সাহাব উদ্দিনের (৬০) মরদেহ পাওয়া যায় ফুলগাজীর ঘনিয়া মোড়া গ্রামে। পানিবন্দি মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনতে যাওয়ার পথে পানির স্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন তিনি। ছয়দিন পর মঙ্গলবার (৩ আগষ্ট) দুপুরে ঘনিয়ামোড়া গ্রাম থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পরশুরামের ধনিকুন্ডা গ্রামে দাফন করা হয়। মির্জানগর ইউনিয়নের মধুগ্রামের দেলোয়ার হোসেন (৪০) বন্যায় মারা গেছেন।

দাগনভূঞা থানা সূত্রে জানা যায়, বন্যায় দাগনভূঞা উপজেলায় এখন পর্যন্ত তিনজন মারা যান। এদের মধ্যে একজন পানিতে ডুবে মারা গেলেও অন্যজন ত্রাণ নিতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। নিহতদের মধ্যে পানিতে ডুবে মারা গেছে উপজেলার উত্তর করিমপুর গ্রামের নুর নবীর ছেলে আট মাস বয়সী নুর মোহাম্মদ। ত্রাণ নিতে গিয়ে ২৮ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে জয়লস্কর ইউনিয়নের উত্তর আলমপুর গ্রামের হুমায়ুন কবিরের ছেলে জাফরুল ইসলাম। গত রবিবার পৌরসভার রামানন্দপুর গ্রামের নুরুল হকের স্ত্রী মালেকা বানুর (৮৫) লাশ পাশ্ববর্তী জমিতে অর্ধগলিত অবস্থায় পাওয়া যায়।

সোনাগাজী মডেল থানার ওসি সুদীপ রায় জানান, ২৬ আগস্ট সোনাগাজী ইউনিয়নের মুহুরি নদীর বাঁধের পাশ থেকে মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের নাঈম উদ্দিনের মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। ২৭ আগস্ট রাতে সোনাগাজী ইউনিয়নের মুহুরি নদীর পাড়ে ছাড়াইতকান্দি গ্রামের মাবুল হকের ছেলে তিন বছর বয়সী আবিরের মরদেহ পাওয়া যায়। ২৮ আগস্ট আমিরাবাদ ইউনিয়নের মুহুরি নদীর পাড়ে কলার ভেলায় ভেসে আসা অজ্ঞাতনামা এক বৃদ্ধের মরদেহ পাওয়া যায়। গত ২৯ আগস্ট মুহুরি নদীর প্রজেক্টের বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে চর চান্দিয়া ও চর দরবেশ ইউনিয়নের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় অজ্ঞাতনামা আরেকটি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গত শুক্রবার ৩০ আগষ্ট সন্ধ্যায় সোনাগাজীর চর আবদুল্লাহ এলাকা থেকে স্থানীয় মানুষের সহায়তায় একজনের মরদেহ উদ্ধার করে সোনাগাজী থানার পুলিশ। বৃহস্পতিবার দুপুরে বড় ফেনী নদীর মুহুরী প্রকল্প এলাকায় একজনের অর্ধগলিত লাশ ভাসতে দেখে ¯’ানীয় লোকজন পুলিশে খবর দেয়। পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে বিকেলে উপজেলা চর সাহাপুর এলাকায় জানাজা শেষে লাশটি দাফন করা হয়।

সুদ্বীপ রায় বলেন, পরিচয় শনাক্ত করতে না পারায় অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে লাশের দাফন করা হয়েছে। এই নিয়ে উপজেলায় বড় ফেনী ও মুহুরী নদী থেকে দুই নারীসহ ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজনের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে।

ফুলগাজী থানা সূত্রে মৃত সবার পরিচয়ই পাওয়া গেছে। ফুলগাজী উপজেলার নোয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা শাকিলা আক্তার(২২), উত্তর করইয়া গ্রামের কিরণ (২০), দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামের রাজু (২০), কিসমত বাসুড়া গ্রামের আবুল খায়ের (৫০), লক্ষ্মীপুর গ্রামের সৈয়দ তারেক (৩২) ও শনিরহাট গ্রামের রজবের নেছা (২৫) ও পূর্ব দরবারপুর গ্রামের হাবিব উল্লার ছেলে ইউসুপ (৬০)।

ছাগলনাইয়া থানা সূত্রে জানা যায়, বন্যায় মারা যাওয়া তিনজনের মধ্যে একজনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে শুভপুর ইউনিয়নের উত্তর মন্দিয়া গ্রামের ফুরফুরের নেসা (৭৫)নামে আরেক নারীর মরদেহ তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। বন্যার কারণে তিনি বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি বলে জানা যায়।

থানা সূত্রে আরও জানা যায়, গত সোমবার সন্ধ্যায় উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের মিজাজী খালে ভাসমান অবস্থায় আইয়ুব খান নামে ৬০ বছর বয়সী স্থানীয় এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করেছে গ্রামবাসী। তিনি মধ্যম নিশ্চিতা গ্রামের মৃত এবাদউল্লার ছেলে। উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের পূর্ব শিলুয়া গ্রামে ভেলায় ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাতনামা এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।

সুজন ফেনীর সাধারন সম্পাদক সাংবাদিক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, বন্যার পানি খুবই গভীর এবং প্রবল স্রোত থাকায় বন্যার সাথে সরাসরি জড়িত প্রাণহানি সাধারণত ডুবে যাওয়ার কারণে ঘটে থাকে। এছাড়াও মৃত্যুগুলি ডিহাইড্রেশন, হিট স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক এবং অন্য যে কোনও অসুস্থতার সাথে সম্পর্কিত রোগীর চিকিৎসা সরবরাহের করা যায় না, সে কারনেও হতে পারে।

ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া ভূইয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচেছ তারা বন্যার কারনেই মারা গেছেন। বন্যার কারনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তাদের সাথে পরিবারের কোন যোগাযোগ হয়নি।

জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, কি কারনে তারা মারা গেছেন তার সঠিক কারন এখনো জানা যায়নি। পুলিশ প্রশাসন থেকে লাশ উদ্ধারের তথ্য আমরা পেয়েছি। পরবর্তীতে তদন্ত সাপেক্ষে মৃত্যুর কারন জানা যাবে। নিহতের পরিবারকে নগদ ২০ হাজার টাকা ও শুকনো খাবার বিতরন করা হয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!