গত সপ্তাহে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় একটি নিউজ ছিলো বজ্রপাতে এক রাখাল ও তার ১৪ টি গরুর করুণ মৃত্যু। শৈশব থেকেই আমরা দেখে এসেছি বর্ষায় বৃষ্টি। কালে ভাদ্রে বন্যার সর্বগ্রাসী ভয়াল রূপ। কিন্ত গত এক দশক ধরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু। যা সাধারণত এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৮০-১২০ দিন বজ্রপাত হয়।প্রতিবছর দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বরণ করছে গড়ে দুশ শত পঞ্চাশ জনেরও বেশী মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্হাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব মতে গত দশ বছরে (২০১০ থেকে ২০১৯ মাস পর্যন্ত ) দেশে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে দুই হাজার ৮১ জন। শুধুমাত্র ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দেই মৃত্যু বরণ করেছে সর্বাধিক ৩৫৯ জন। আর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে চার দিনে সর্বাধিক ৮১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ফলে সে বছরের ১৭মে সরকার বজ্রপাতকে দেশের আরেকটি দুযোর্গ হিসাবে ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপাটমেন্ট অব জিওগ্রাফি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, বিশ্বে বজ্রপাতে সর্বাধিক মৃত্যুর দেশ বাংলাদেশ। আর বিশ্বের মোট বজ্রপাতের এক-চতুর্থাংশ ঘটে এদেশে যা ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এইচ. এম. আসাদুল হক বলেন, দেশে প্রাকৃতিক দুযোর্গে যত মানুষ মারা যায় তার দ্বিতীয় অবস্হানে রয়েছে বজ্রপাতে মৃত্যু।
দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভারতের বেশকিছু অঙ্গরাজ্যে বজ্রপাত হয়ে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে এর প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যদিও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিলে। কিন্তু সেখানকার তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুর হার বেশি। আমাদের দেশে গত ১৮ মে ২০২১ মঙ্গলবার বজ্রপাতে নেত্রকোণায় সর্বাধিক ছয়জনের মৃত্যুসহ দেশের ছয়টি জেলায় মোট ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।সেইভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম বলছে, বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে কৃষিকাজ করার সময়, এই হার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। এছাড়া মাঠ থেকে গরু আনতে গিয়ে, নৌকায় মাছ ধরতে গিয়ে, খোলা মাঠে খেলতে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলোয় বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটছে বেশি।
বজ্রপাত কি : হঠাৎ বিদুৎ এর ঝলকানি তার পর গুরু করে বিকট শব্দ। এই পুরো প্রক্রিয়াকে বজ্রপাত বলা হয়। বজ্রপাত প্রকৃতির সব থেকে সুন্দর ও ভয়ঙ্গকর দৃশ্য।এই কারনে আগের দিনের মানুষ বজ্র কে দেবতা জ্ঞান করত।বজ্রপাত প্রকৃতির একটি সাধারণ ঘটনা।প্রতি সেকেন্ডে ৪০ টির মত বজ্র সৃষ্টি হয়।পানিচক্রের নিয়মে জলাধারের পানি বাষ্পীভূত হয়ে মেঘ আকারে আকাশে আশ্রয় নেয়। এই মেঘ-ই হল বজ্রপাতের ব্যাটারি। বজ্রপাতের জন্য দায়ী মেঘ বৈদ্যুতিক চার্জের আধারের মত আচরণ কর। যার উপরের অংশ পজিটিভ এবং নিচের অংশ নেগেটিভ চার্জে চার্জিত থাকে। মেঘ কিভাবে চার্জিত হয় তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে বেশ মতভেদ থাকলেও সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হচ্ছে, পানিচক্রে জলকণা যখন ক্রমশ উর্ধ্বাকাশে উঠতে থাকে তখন তারা মেঘের নিচের দিকের বেশি ঘনীভূত বৃষ্টি বা তুষার কণার সাথে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়।যার ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্প কণা বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। এই মুক্ত ইলেকট্রন গুলো মেঘের তলদেশে জমা হয় এবং ইলেকট্রন হারানো পজিটিভ চার্জিত বাষ্পকণা মেঘের একেবারে উপরপৃষ্ঠে চলে যায়। যার ফলশ্রুতিতে মেঘগুলো শক্তিশালী ধারক বা ক্যাপাসিটর এর বৈশিষ্ট্য লাভ করে। মেঘের দুই স্তরে চার্জ তারতম্যের কারণে সেখানে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের শক্তি মেঘে সঞ্চিত চার্জের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।এভাবে বাষ্পকণা ও মেঘে সংঘর্ষ চলতে চলতে মেঘের উপরে এবং নিচে যথাক্রমে পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে এতটাই শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরী করে যে তার বিকর্ষণে পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থানরত ইলেকট্রন গুলো ভূপৃষ্ঠের আরো গভীরে চলে যায়। ফলাফলস্বরূপ ওই নির্দিষ্ট এলাকার ভূপৃষ্ঠ শক্তিশালী পজিটিভ বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এখন বজ্রপাতের জন্য শুধু যা প্রয়োজন তা হল বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য সামান্য একটু বাহক বা কন্ডাক্টর। কিন্তু আমরা জানি বাতাস বিদ্যুৎ অপরিবাহী, তাহলে বজ্রপাত কিভাবে হবে?মেঘের বিপুল শক্তিশালী বিদ্যুতক্ষেত্র তার চারপাশের বাতাসের অপরিবাহী ধর্মকে নষ্ট করে দেয়। যাকে বলে উরবষবপঃৎরপ ইৎবধশফড়হি । মেঘে অবস্থিত বিদ্যুতক্ষেত্র যখন যথেষ্ঠ শক্তিশালী হয়(প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ১০,০০০ ভোল্ট), তখন তার আশেপাশের বাতাস পজিটিভ এবং নেগেটিভ চার্জে বিভক্ত হয়ে যায়। এই আয়নিত বাতাস প্লাজমা নামেও পরিচিত। বাতাস আয়নিত হয়ে মেঘ এবং ভূপৃষ্ঠের মধ্যে বিদ্যুৎ চলাচলের পথ বা শর্ট সার্কিট তৈরী করে দেয় এবং বজ্রপাত ঘটায়।এই সময় তড়িৎ বিভবের পার্থক্য ১০ মিলিয়ন ভোল্ট পর্যন্ত হতে পারে আর তরিৎ প্রবাহের মাত্রা ৩০,০০০ এম্পায়ার পর্যন্ত হতে পারে।বিভবের পার্থক্যের উপর প্রবাহের মাত্রা নির্ভর করে।এই সময় বাতাসের তাপ মাত্রা ২০০০০ থেকে ৩০০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়।এই প্রচন্ড শক্তির স্থায়িত্ব মাত্র সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ। বজ্রপাতের মধ্যে পড়লে সাথে সাথে মৃত্যু ঘটবে।তবে আশার কথা হলো মোট বজ্রপাতের মাত্র ২৫ ভাগ ভুপৃষ্টে পরে বাকি গুলো মেঘের মধ্যেই ঘটে থাকে।
কেন এত বজ্রপাত : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার মতে, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ আমাদের ভৌগলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই হিমালয় রয়েছে, যেখান থেকে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুই বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে’। শীত পরবর্তী সময়ে একদিকে যেমন বঙ্গোপসাগর থেকে উষ্ণ বাতাস আসতে শুরু করে, অন্যদিকে হিমালয় থেকে আসে ঠাণ্ডা বাতাস। দক্ষিণের গরম আর উত্তরের ঠাণ্ডা বাতাসে অস্থিতিশীল বাতাস বজ্র মেঘের সৃষ্টি করে। এরকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রের তৈরি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তাওহিদা রশিদ বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। তিনি জানান, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে দশমিক ৭৪ শতাংশ তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপমাত্রা বাড়ায় সামগ্রিক আবহাওয়া ব্যবস্থার উপরই এর প্রভাব পড়েছে। উত্তপ্ত বায়ু বজ্রপাত সৃষ্টিতে রাখছে ভূমিকা। তার মতে, বছরে এক ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়ার কারণে ১২ শতাংশ বজ্র ঝড় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এটি কোন কোন বিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন। তবে বজ্রপাতের হার বাড়ার কারণ হিসেবে বায়ু দূষণকেও দায়ী করেছেন পরিবেশ আন্দোলনকারীরা।
কোথায় কখন ঘটছে বেশী : সাধারণত গ্রীষ্মের দিনগুলোয় এপ্রিল-মে মাসে বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে। তবে সাম্প্রতিককালে জুন-জুলাইয়েও বেড়েছে বজ্রপাতের হার। আবহাওয়াবিদগণ বলছেন, বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপাত-প্রবণ এলাকাগুলোর অন্যতম। গ্রীষ্মকালে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত এই দুর্যোগ বেশি ঘটছে।এক জরিপ বলছে, সাধারণত সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যার আগপর্যন্ত অর্থাৎ দিনের বেলায় বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে বেশি। আরেক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রায় ৪৩ শতাংশ বজ্রপাতই হয় দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে। সকালে সূর্যের প্রচন্ড তাপমাত্রা জলীয়বাষ্প সৃষ্টি করে, যেটি বজ্রপাতেরপ্রধান শক্তি। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে তখন জলীয় বাষ্প বা এ ধরনের শক্তিও তত বেড়ে গিয়ে বজ্রপাত ঘটায়।
মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে কেন : একসময় দেশের বেশিরভাগ গ্রাম এলাকায় বড় গাছ, যেমন- তাল, নারিকেল, বটসহ নানা ধরনের উঁচু গাছ দেখা যেত। এসব গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নিত। ফলে মানুষের আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা কমত। বজ্রপাত-বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে এখন মুঠোফোন আছে। দেশের অধিকাংশ এলাকায় মুঠোফোনের বৈদ্যুতিক টাওয়ার রয়েছে। দেশের কৃষিতেও যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। আকাশে সৃষ্টি হওয়া বজ্র মাটিতে কোনো ধাতব বস্তু পেলে তার দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। এটি কৃষিকাজে নিয়োজিত মানুষদের বজ্রপাতে মৃত্যুর বড় কারণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেছেন, গাছবিহীন খোলামাঠের গ্রামে বজ্রপাতে মৃত্যু হচ্ছে বেশি। শহরে গাছ না থাকলেও উঁচু উঁচু ভবন আছে। ফলে শহরের মানুষ এই মৃত্যু থেকে রেহাই পাচ্ছে।
বজ্রপাত থেকে বাঁচতে কতটা কাজে আসছে নানামুখী উদ্যোগঃ বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানোর লক্ষ্যে দেশবাসীকে আগাম সতর্কবার্তা দিতে দেশের ৮টি স্থানে পরীক্ষামূলক ভাবে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসিয়েছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ঢাকায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় ছাড়াও ময়মনসিংহ, সিলেট, পঞ্চগড়, নওগাঁ, খুলনা, পটুয়াখালী এবং চট্টগ্রামে এই সেন্সর বসানো হয়েছে। যদিও এসব সেন্সরের কার্যক্রম এখন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।এই যন্ত্র কতটা কার্যকারিতা সম্পর্কে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মুরাদ আহমেদ ফারুখ জানান, রাডার থেকে এই সেন্সরে বজ্রপাতের ১৫/২০মিনিট আগেই কেবল পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বজ্রমেঘ বা বজ্রপাত তৈরি হয় যে মেঘ থেকে, তা খুবই অস্থিতিশীল। এছাড়া বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) এই পূর্বাভাস জানাতে যে ওয়েদার অ্যাপ তৈরি করেছে, তা কেবল অ্যান্ড্রয়েডে চালিত মোবাইল ফোনেই চলবে। বজ্রপাতে উন্মুক্ত স্থানে মারা যান ৮৬ শতাংশ কৃষক, জেলে বা শ্রমিকরা। এরা কেউ যেহেতু অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ব্যবহার করেন না, তাই তাদের কাছে এই পূর্বাভাস পৌঁছানো সম্ভব না।এক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগণকে বাঁচাতে সরকারিভাবে তাল গাছ লাগানোর উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাল গাছ ৩০-৪৫ সে.মি. ব্যাসের গোলাকার গুঁড়িবিশিষ্ট প্রায় ৮০-৯০ ফুট উচ্চতার শাখাবিহীন একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। সরকারিভাবে ২০১৮ সালেই ৩১ লাখ তালের আঁটি লাগানো হয়েছে দেশের ৬১ জেলায়। তবে বজ্রপাতের ঝুঁকিহ্রাসের উপযোগী হতে এই গাছের কমপক্ষে ১৪-১৬ বছর বা তারও বেশি সময় প্রয়োজন। তালগাছ লাগিয়ে সেটি বড় করে তোলা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় একে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য সুপারি গাছ লাগানোয় জোর দেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তালগাছের তুলনায় সুপারী গাছ দ্রুত বর্ধনশীল, প্রায় ৫০-৬০ ফুট উঁচু হয় এবং তালগাছের প্রতি ৩০ ফুটের মধ্যবর্তী স্থানে রোপণ করা যায়।গৃহীত পদক্ষেপ ছাড়ওি বজ্রপাত বিষয়ে অতিসত্বর সরকার যে কাজ গুলো হাতে নিতে পারে তা হলো : ১.দেশে বজ্রপাতের ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণ সনাক্তকরণ;২.বজ্রপাতে দেশে জীবনহানি বৃদ্ধির কারণ নির্ধারণ;৩.বজ্রপাতের ঝুঁকি হ্রাস করতে করণীয় উদ্ভাবন; ৪.বজ্রপাতে ক্ষতি কমাতে করণীয় বিষয় নির্ধারণ; ৫.বজ্রপাতে করণীয় সম্পর্কে সচেতন করতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্য বইয়ে এ সংক্রান্ত প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ;৬.বজ্রপাতের আগাম বার্তা দিতে বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরে গবেষণা কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ ;
পালনীয় কার্যক্রম : বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বজ্রপাত থেকে বাঁচতে ২০টি নির্দেশনাদিয়েছে। নির্দেশনাগুলো হলো-
১. বজ্রপাতের ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না।
২. প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করুন।
৩. খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালে বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০-১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যান।
৪. কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যান।
৫. খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া যাবে না। গাছ থেকে চার মিটার দূরে থাকতে হবে।
৬. ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক তারের নিচ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে।৭. ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির প্লাগগুলো লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে।
৮. বজ্রপাতে আহতদের বৈদ্যুতিক শকের মতো করেই চিকিৎসা দিতে হবে।
৯. এপ্রিল-জুন মাসে বজ্রপাত বেশি হয়। এই সময়ে আকাশে মেঘ দেখা গেলে ঘরে অবস্থান করুন।
১০. যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন।
১১. বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় থাকবেন না এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকুন।
১২. ঘন-কালো মেঘ দেখা গেলে অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হতে পারেন।
১৩. উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, তার, ধাতব খুঁটি ও মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকুন।
১৪. বজ্রপাতের সময় জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করুন।
১৫. বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, মাঠ বা উঁচু স্থানে থাকবেন না।
১৬. কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা, জলাশয় থেকে দূরে থাকুন।
১৭. বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন এবং নিজেরাও বিরত থাকুন।
১৮. বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়ুন।
১৯. বজ্রপাতের সময় গাড়ির মধ্যে অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না। সম্ভব হলে গাড়িটিকে নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন।
২০. বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করুন।
এসব নির্দেশনা মেনে চললে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা কমে আসবে আশা করা যায়। সর্বোপরি আত্মসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা যথাসম্ভব ঘরে অবস্থান করবো তাহলে বজ্রপাতের বিদ্যমান বিপর্যয় থেকে জনজীবন রক্ষা করা সহজ হয়ে উঠবে। অতঃপর বলতেই হয়- “বাইরে যদি পড়ে বাজ/ঘরে থাকাই ভাল কাজ”।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।