জাহাঙ্গীর আলম :
মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা করতে বাঙালি কতটা উন্মুখ তা খুব সহজে অনুমেয়। প্রায় আঠারো কোঠি মানুষের দেশে স্বেচ্ছায় সানন্দে বই কিনে উন্মুক্ত জ্ঞান চর্চার তেমন আগ্রহ নেই বললেই চলে। এর মূলকারণ হলো আমরা ভোগে বিশ্বাসী, জ্ঞান চর্চায় নয়। জ্ঞানের ক্ষুধা মানুষকে উদ্বেলিত করে, দেহের ক্ষুধা মানুষকে ভোগবাদী ও লোভী করে। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি জ্ঞানের ক্ষুধার চেয়ে, দেহের ক্ষুধাকে নগন্য মনে করে। তারা মনে করে জীবন বাঁচানোর জন্য খাদ্য খেতে হয়, কিন্তু জীবনে অমরত্বের স্বাদ পেতে হলে জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করতে হয়। তাই তারা মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগী হয়, আগ্রহী হয়। মাতৃভাষায় রচিত শিল্পসাহিত্যকে কদর করে, গ্রহণ করে। নিজ দেশের নিজ ভাষার পাণ্ডিত, শিল্পী, সাহিত্যিকদের সম্মান দেখায়। তাদের সৃষ্টিকর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করে, জাতীয় সম্পদ মনে করে এবং জাতির জন্য সংরক্ষণ করে। বিশ্বের উন্নত জাতিগুলোর দৃষ্টান্ত ঠিক তেমনই।এক্ষেত্রে কেবল বাঙালি হিসেবে আমরা ব্যতিক্রম। যদিও মাতৃভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি। তবুও দাসত্বের গোলমী থেকে আমরা এখনো পুরোপুরিভাবে মুক্ত হতে পারিনি। চেতন-অবচেতন মনে আমরা ভিনদেশিদের ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির সমান তালে অন্ধের মতো এখনো পূজা করে চলছি। এর অন্যতম কারণ হতে পারে জাতি হিসেবে দীর্ঘসময় আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকা। পরাধীনতার দীর্ঘ সময় জুড়ে বিদেশি ভাষার চরম দাসত্ব করতে হয়েছে আমাদের। তার জের আজও কাটিয়ে ওঠতে পারেনি জাতি। আজও অফিস আদালতে ইংরেজি ভাষা একক আধিপত্য বিস্তার করে আছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে নীরব সংকট চলেছে তার মধ্যে শিক্ষাদানের মাধ্যম অন্যতম। মানব জীবনে মাতৃভাষার কোন বিকল্প নেই। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ সহজ ও পূর্ণ হয়। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ। মাতৃদুগ্ধ শিশুর পক্ষে যেমন পুষ্টিকর, বিদ্যা শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা তেমন সর্বোৎকৃষ্ট।”
মাতৃভাষা প্রাণ-মনকে দেয় তৃপ্তি আর চিন্তা চেতনাকে দেয় দীপ্তি। কোন ব্যক্তি যদি তার মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে তাকে চরম নির্বোধ না বলে উপায় নেই। আমাদের মাতৃভাষার নাম বাংলা। এ ভাষার রয়েছে বীরত্বব্যাঞ্জক রক্তাক্ত ইতিহাস। ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারদের তাজা প্রাণ আর উষ্ণ রক্ত মূল্যে কেনা আমাদেরই বাংলা ভাষা। এ ভাষার প্রভাব ও প্রবাহ আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত। মনের ভাব আর চিন্তা চেতনা এ ভাষায় যতটা সহজে ও স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয় অন্য কোন ভাষায় তা সম্ভব হয় না। আমাদের মাতৃভাষা আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, মিলন-বিরহের স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশ। এ ভাষাতে আমরা কথা বলি, লিখন লিখি, সুখ-দুঃখের অমর কাব্য রচনা করি। মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই প্রকৃতপক্ষে জাতির চিৎশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি, সৃজনশীলতা ও কল্পনা শক্তির যথার্থ বিকাশ ঘটে। কিন্তু এসত্য বুঝতে ভুল করে আমরা অন্ধের মত সন্তানদের (ইংলিশ মিডিয়াম) বিদেশি ভাষায় শিক্ষা প্রদানে আন্তরিক হয়ে ওঠেছি। শিক্ষার এ উল্টো দিক প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “আমাদের মন তের চৌদ্দবছর বয়স হইতে জ্ঞানের আলোক এবং ভাবের রস গ্রহণ করিবার জন্য ফুটিবার উপক্রম করিতে থাকে। সেই সময়েই যদি তাহার উপর বিদেশি ভাষার ব্যাকরণ এবং মুখস্থ বিদ্যার শীলাবৃষ্টি বর্ষণ হতে থাকে তবে তাহা পুষ্টি লাভ করিবে কী করিয়া।”
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে কেবল ইংরেজি ভাষা চর্চার মাধ্যমে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কবি তার ভুল বুঝতে পেরে মাতৃভাষা চর্চায় আত্মনিয়োগ করেই অমরত্ব লাভ করেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার ভুল বুঝতে পেরে লিখেছেন।
“হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে (অবোধ) আমি অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।”
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হলে তা সহজেই মানুষের হৃদয়জুড়ে থাকতে পারে। শিক্ষার্থী শিক্ষণীয় বিষয়ে আনন্দ খুঁজে পায়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার গাঁথুনিটা খুব মজবুত হয়। এরপর যে কোন ভাষাশিক্ষা স্থায়ী হয়।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “আগে হোক মাতৃভাষার শক্ত গাঁথুনি তারপর বিদেশী শিক্ষার পত্তন।” শিক্ষার সঙ্গে মাতৃভাষার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে চিত্তের বিকাশ সাধন। যে কোন শিশু তার মাতৃভাষায় কথা বলতে শেখে তেমনি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশুর আত্মপ্রকাশ ঘটে। মাতৃভাষার মাধ্যমে তা শুধু সহজ হয় না, বরং স্বতঃস্ফুর্ত হয়। তাই দেখা যায় শিশু তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, আনন্দ, বেদনা সব কিছু সহজে মাতৃভাষায় প্রকাশ করেছে। নিজেকে প্রকাশ করার এই ক্ষমতাইতো প্রথম শিক্ষা। শিশু তার আপন মাতৃভাষাতেই প্রথম শিক্ষার পাঠ গ্রহণ করছে জিজ্ঞাসা ও কৌতূহলের প্রেরণায়।
মাতৃভাষার নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় কোন দেশ, কোন জাতির শিক্ষা ও সাহিত্যকে মজবুত করে দিতে পারলে যে কোন ভাষায় শিক্ষার্থী পারদর্শিতা অর্জন করতে পারে। কঠোর সাধনা করেও যে ক্ষেত্রে অন্য ভাষায় পুরোপুরি জ্ঞান লাভ করা যায় না, সে ক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রতি সামান্যতম স্পৃহা বা আকর্ষণ থাকলে সহজে মাতৃভাষা হৃদয়ঙ্গম করা যায়। দেশজুড়ে শিক্ষাহীনতার গাড়-অন্ধকার বিদূরিত করার একমাত্র উপায় হলো মাতৃভাষার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে শিক্ষাকে সহজলভ্য করা। বলা হয় ইংরেজরা আধুনিক বিশ্বের সভ্য জাতি। বলতে গেলে প্রায় গোটা বিশ্বে তাদের নীরব বিস্তৃতি রয়েছে। এর পেছনে কারণ হলো, তারা সবার আগে নিজেদের মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিয়েছে। নিজ মাতৃভাষাতেই তারা শিল্প, সাহিত্য রচনা করেছে। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক গ্রন্থ তারা নিজ মাতৃভাষায় রচনা করেছে। দুনিয়ার তামাম জাতির নিজস্ব সাহিত্য ও বিভিন্ন গবেষণাকর্ম আহরণ করে ইংরেজরা নিজ মাতৃভাষায় পূণঃমুদ্রণ করে শিক্ষার্থিদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে। ইংরেজরা যেদিন ফরাসি ভাষাকে মাতৃভাষার উপর স্থান দিয়েছিল সে দিন তাদের মাতৃভাষার স্পূরণ হয় নি। স্পূরণ হয়েছিল সেদিন, যেদিন মার্টিন লুথার মাতৃভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করে দেশের মানুষের মনে বাইবেল ও মাতৃভাষা উভয়কেই বিশিষ্ট মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে সর্বস্তরে প্রচলন করতে হবে। এক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও শোনা যায়। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বাংলা গ্রন্থ নেই বলে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা শিক্ষার প্রবর্তন প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন অনেকেই। যেকোন বিদেশি ভাষায় বিদিত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে তার মাতৃভাষায় অনূদিত হয়েই প্রবেশাধিকার পায়। এ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে ভিন্ন ভাষায় রচিত যে কোন গ্রন্থ তা যতই মূল্যবান তথ্যে সমৃদ্ধ হোক একজন পাঠকের কাছে অর্থহীন হতে বাধ্য। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে মাতৃভাষার সাহায্য নিতেই হয়। তাই মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অনুবাদ ও পরিভাষা সৃষ্টির কাজে জোর দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বিকল্প নেই।
মাতৃভাষার গবেষণা কাজে নিয়োজিত গবেষক, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনা যোগাতে হবে। বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় উন্নত জাতিগুলো নিজ নিজ ভাষায় জ্ঞান চর্চা করেই নিজেদেরকে সমৃদ্ধশালী করতে পেরেছে। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কখনোই নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে উন্নত করা সম্ভব নয়। মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষাতে মানুষের নিজস্ব মনোভাব ও চিন্তা কল্পনা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে না। কেবলমাত্র জাতীয় ভাষাতেই জাতির আশা- আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠতে পারে। জীবন ও শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধন করার একমাত্র পথ হচ্ছে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান। এ বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়।আমাদের একটি জাতীয় সমস্যা রয়েছে। নিজের ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতিকে আমরা বড় করে মর্যাদাপূর্ণ চোখে দেখি না। এই কারণে আমরা আমাদের শিশুদেরকে মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তুলতে পারি না। রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা ও পারিবারিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিশু বয়সে পরিবার থেকে বিদেশি ভাষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বেড়ে উঠছে আমাদের সন্তানেরা। মা-বাবার কাছে তারা শিখছে বিদেশি ভাষার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ছবক। আমাদের অভিভাবকদের মাঝে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, লেখা- পড়া করে ভালো একটা চাকুরী পেতেই হবে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে হবে।কিন্ত চাকুরিরর চেয়ে ভালো মানুষ হওয়া জরুরী এই সত্য আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন আমরা আমাদের সন্তানদের দেখাতে ব্যর্থ হই। কারণ আমরা শিল্প সাহিত্য নিয়ে খুব বেশি ভাবি না। শিক্ষার নগদ প্রাপ্তির দিকটা এবং বাজার মূল্যকে আমরা বড় করে ভাবতে শিখি এবং শেখাই। এজন্যই আমাদের প্রজন্ম শিক্ষিত হয়েও মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে। তাই সেবাব্রত নিয়ে অনেকেই এখন কোন পেশায় নিজেকে বিকশিত করতে পারছেন না। রাষ্ট্রীয় ভাবেও আমাদের বাংলা ভাষা বহুক্ষেত্রে অবহেলার শিকার। দেশীয় সাহিত্য ও সুষ্ঠুধারার সংস্কৃতি সে অর্থে উঠে আসছেনা, এর মূলকরণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। ভাষাকে এগিয়ে নিতে হলে শিল্প-সাহিত্যকে রাষ্ট্রীয়ভাবে এগিয়ে আনতে হবে এবং সেগুলোকে রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আক্ষরিক অর্থে বাংলা বিষয়কে খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয় না। গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞানের বিষয়গুলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান যাচাই করা হয় এবং এই বিষয়গুলোকে অধিক অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ফলে নিজস্ব ভাষায় ভাষাগত দক্ষতা অর্জন হয় না শিক্ষার্থীদের।
মজার ব্যাপার হলো প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর কোথায় বাংলা বিষয়কে সে অর্থে গুরুত্বে সঙ্গে মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ অন্যান্য বিষয়গুলোতে তুচ্ছ কারণেও ফেল দেখানো হয়। এতে করে শিক্ষার্থীদের মনে এমন ভাবের উদয় হয় যে, বাংলা বই গুরুত্ব দেওয়ার মতো কোন বিষয়ই নয়, পরীক্ষার আগের রাতে একটু পড়ে নিলেই হয়। এমন ধারণা থেকে অনেক শিক্ষার্থী নিজের মাতৃভাষাকে গুরুত্বহীন মনে করে চলছে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই নিজের ভাষাতে দুর্বল হয়ে গড়ে উঠছে। যে নিজের ভাষায় দুর্বলতা নিয়ে বেড়ে উঠে সে অন্য ভাষা ও অন্যান্য বিষয়ে খুব একটা পারদর্শী হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। তবুও প্রচলিত শিক্ষা তথা বাংলা মিডিয়ামকে অবমূল্যায়ন করে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা পদ্ধতিকে নিজেদের সন্তানের জন্য গ্রহণ করে নিচ্ছে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল মহল, মন্ত্রী, এম. পি, সচিব ও উচ্চাবিলাসী ধনীক শ্রেণীর অনেকই। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে। কারণ, জাতি নেতৃস্থানীয় শ্রেণী-গোষ্ঠীকে অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। যতদিন যাচ্ছে এই মানসিকতা মধ্যবিত্ত -নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজেও জেগে উঠছে। এই অতিরঞ্জিত ইংরেজিভাষা প্রিয়তা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েই বিকশিত হচ্ছে। ইংরেজি ভাষা অবশ্যই শিখতে হবে, জানতে হবে। কারণ, ইংরেজি ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বিশ্বদরবারে নিজের স্থান গড়ে নিয়েছে। তাই বৈশ্বিক কমিউনিকেশনের জন্য ইংরেজি ভাষাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে তা নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে অথবা ছোট জ্ঞান করে নয়। দেশের সকল শিক্ষার্থীর মাঝে বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মানসিকতা থাকা দরকার। অপরদিকে ইন্টারন্যাশনাল ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় সহজ ভাবে পুস্তকায়ন করে পাঠদানের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
একইসাথে বাঙ্গালি ছাত্রদের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। এ জাতীয় শিক্ষা মাধ্যমগুলো শিক্ষার চেয়ে শিক্ষা বৈষম্যই সৃষ্টি করছে। দেশের সকল শিক্ষার্থীর জন্য প্রচলিত বাংলা মিডিয়ামে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে তাতে সকলের জন্য সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় ইংরেজি ভাষা শেখার মতো পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে, সরকারি বেসরকারি অফিস-আদালতে, চাকুরীর ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় সর্বোচ্চ ইন্টার্ভিউ পেইজ করার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা উচিত। কোন ভাষার জ্ঞানচর্চা করা দোষের নয়। দোষ তখনই হয়, যখন ঐ ভাষার অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে নিজের মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা আসে। আমাদের একশ্রেণির বাঙ্গালি উচ্চাবিলাসী মনোবৃত্তি নিয়ে সে পথেই এগিয়ে চলছে। এটা বাঙ্গালি জাতি, বাংলাভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বাঙ্গালি সভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি। যেকোন জাতির পরিচয় টিকে থাকা আর না থাকার বিষয়টি নির্ভর করে সে জাতির মাতৃভাষার উপর। পৃথিবীতে সে জাতি ততো বেশি উন্নত যে জাতির মাতৃভাষা ও সাহিত্য যতো বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ। যে জাতি নিজস্বতাকে হেয় জ্ঞান করে অন্যকে অনুকরণ করে, কালের ব্যবধানে সে জাতি আস্থাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। তাই অতি আধুনিকতার খাতায় নাম লিখাতে ব্যস্ত না হয়ে জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধারণ করা উচিৎ। এভাবে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলা উচিৎ। কাজটি সম্মিলিত ভাবে করতে হবে। সবার মাঝে দেশাত্মবোধ জাগাতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতিগত বিভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্যের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। প্রজন্মের মাঝে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব, চেতনা ও তাৎপর্য যতাযথ ভাবে তুলে ধরতে হবে। মাতৃভাষা বাংলাকে কেমন করে ভালোবাসতে হয় তা জানতে হবে, জানাতে হবে। শিখতে হবে, শেখাতে হবে। মাতৃভাষাকে ভালোবেসে যারা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তাদের আত্মদানের অমরগাথা প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, ভাষা আন্দোলনের চেতনা আমাদের স্বাধীনতার বীজ, জাতির মূলমন্ত্র,জাতির আত্মপরিচয়ের বাহন। মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা করলে সে জ্ঞান স্থায়িত্ব লাভ করে এবং তাতে জাতির ভিত মজবুত হয়, টেকসই হয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক।