দৈনিক ফেনীর সময়

মুমিনের হাসি-কান্না

মুমিনের হাসি-কান্না

হাসি-কান্না মানুষের দু’টি বিশেষ গুণ। মানুষ সুখে হাসে এবং দুঃখে কাঁদে। হাসি ও কান্না মানুষের ইচ্ছায় আসে না। বরং অনিচ্ছায় তা এসে যায়। হাসি-কান্না আসে মনের গভীর থেকে ইচ্ছার বাহিরে। মহানবী সা. কেউ মারা গেলে ক্রন্দন করতে নিষেধ করতেন। কিন্তু তাঁর ছেলে ইবরাহীম যখন ইন্তিকাল করেন তখন রাসূল সা. এর চোখ মোবারক দিয়ে পানি পড়তে দেখে সাহাবায়ে কিরাম আরজ করেন- হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে ক্রন্দন করতে নিষেধ করেন। এখন দেখছি আপনি নিজেই ক্রন্দন করছেন। রাসূল সা. প্রত্যুত্তরে বলেন- তা হলো মায়ার বন্ধনের ফলে, প্রকাশিত হৃদয়ের অনুভূতি। কুরআন মজীদে বর্ণিত আছে নিশ্চয়ই তিনি হাসান এবং তিনিই কাদান (সূরা নাজম- ৪৩)। অর্থাৎ তিনি হাঁসি-কান্নার কারণ সৃষ্টি করেন।

হাসি-কান্না ইবাদত: হাসি ও কান্না মানুষের সত্তাগত ও প্রকৃতিগত বিষয় হলেও কারণ ও উপলক্ষ্য বিবেচনায় তা ইবাদত হিসেবেও গণ্য হতে পারে। মহানবী সা. বলেছেন- জাহান্নামের আগুণ দু’টি চোখকে স্পর্শ করবে না। যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে এবং যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় পাহারা দিয়ে ঘুমহীনভাবে রাত পার করে দেয় (সুনানে তিরমিযী- হাদীস নং- ১৬৩৯।

মহানবী সা. অন্য হাদিসে বলেছেন- তোমার ভাইয়ের সামনে মুচকি হাসা সদকা স্বরূপ (তিরমিযী- হাদীস নং ১৯৫৬)। চোখের পানি প্রিয় আমল: মুমিনের চোখের পানি আল্লাহর কাছে প্রিয় জিনিস। ফলে মু’মিনের কান্না তার প্রিয় আমল। পৃথিবীতে বেশি হাসা ও ক্রীড়া কৌতুক করা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য। মু’মিনের বৈশিষ্ট্য হলো- সে কম হাসে, বেশি বেশি কাঁদে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- অতএব, তারা (পার্থিব জীবনে) কিঞ্চিত হেসে নিক এবং তারা (পরকালে) প্রচুর কাঁদবে, তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ (সূরা তাওবা- ৮২)। এ আয়াতটি মুনাফিকদের প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যের বিপরীত মহানবী সা. মুমিনদেরকে কান্নার বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে বলেছেন। তিনি বলেন- হে মুমিনরা বেশি বেশি কাদো। কান্না না আসে কান্নার ভান করো। কেননা দোযখীরা এমন কাদা কাদবে যে, চেহারা এমন অশ্রু প্রবাহিত করবে যেন সেখানে নৌকা চলবে, অশ্রু প্রবাহ বন্ধ হলে রক্ত প্রবাহিত হবে, রক্ত প্রবাহিত হতে হতে এমন হবে যেন নৌকা চলবে (সুনানে নাসায়ী ৪১৯৬, ইবন মাজাহ)।

আল্লাহর কাছে কান্না অমূল্য সম্পদ: মুমিনের কান্না পার্থিব আবেগ-অনুভূতির জন্য নয়, বরং আল্লাহর ভয়ে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ তায়ালা বিচার দিবসে তাঁর আরশের নিচে ছায়া দান করবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতিত আর কোনো ছায়া থাকবে না। তাদের এক শ্রেণির হলো যারা নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ দু’টি অশ্রুসিক্ত হয় (সহীহ বুখারী হাদীস নং- ৬৮০৬)। অন্য হাদীসে রয়েছে- দু’ ফোটা পানি ও দু’টি (আঘাতের) চিহ্নের চেয়ে বেশি প্রিয় আল্লাহর কাছে আর কিছু প্রিয় নেই। আল্লাহর ভয়ে যে অশ্রুর ফোটা পড়ে। আল্লাহর পথে যে রক্তের ফোঁটা নির্গত হয় এবং আল্লাহর কোনো ফরজ আদায় করতে গিয়ে যে আঘাতের চিহ্ন সৃষ্টি হয়, তা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় (সুনানে তিরমিযী- ১৬৬৯)।

নবী-রাসূলদের কান্না: নবী-রাসূলগণ ছিলেন নিষ্পাপ। তবু তাঁরা আল্লাহর ভয়ে সদা ভীত ছিলেন এবং আল্লাহর ভয়ে বেশি বেশি কান্না করতেন। তারা শুধু নিজেরা কাঁদেন নি উম্মতকে কান্নার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর তায়ালা ইরশাদ করেন- এরা হচ্ছে সে সব নবী-রাসূল, যাদের উপর আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করেছেন, তারা সবাই আদমের বংশোদ্ভূত। যাদের তিনি (মহাপ্লাবনের সময়) নূহের নৌকায় আরোহন করিয়ে ছিলেন, এরা তাদেরই বংশধর, (এদের কিছু লোক) ইবরাহীম ও ইসমাঈলের বংশোদ্ভূত যাদের তিনি হেদায়াত দান করেছেন এবং যাদের তিনি (দ্বীনের জন্য) মনোনীত করেছেন (এরা তাদেরই অন্তর্ভূক্ত)। যখন এদের সম্মানে রহমানের (আল্লাহর) আয়াত সমূহ তিলাওয়াত করা হতো, তখন এরা রহমানকে সিজদার করার জন্য ক্রন্দনরত অবস্থায় যমীনে লুটিয়ে পড়তো (সূরা মারইয়াম-৫৮)। হযরত আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে আসলাম, তখন তিনি নামায় আদায় করছিলেন আর তাঁর ভিতরে শব্দের মতো আওয়াজ হ”িছল অর্থাৎ তিনি ক্রন্দন করছেন (সুনানে নাসায়ী-১২১৪)।

হযরত আয়েশা রা. মহানবী স.-কে বেশি বেশি কাদতে দেখে বলেন- হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কাঁদছেন! অথচ আল্লাহ তায়ালা আপনার পূর্বের ও পরের সবগুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন- আমি কী কৃতজ্ঞশীল বান্দা হবো না (সহীহ ইবনে হিব্বান-২/৩৮৬)। ইবনু কায়্যিম র. বলেন- যখন চোখ আল্লাহ ভয়ে বিগলিত না হয়, তখন জেনে রাখো হৃদয়ের কঠোরতার কারণে তা (চোখের পানি) শুকিয়ে গেছে। আর কঠোর হৃদয় আল্লাহ থেকে অনেক দূরে (বাদায়িউল ফাওয়াইদ ৩/৭৪৩)।

মহানবী সা. হৃদয়ের কঠোরতার থেকে মুক্তি চেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই এমন জ্ঞান থেকে যা কোন উপকারে আসে না’ এমন হৃদয় থেকে, যা (আপনার ভয়ে) ভীত হয় না, এমন আত্মা থেকে তা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন আহবান থেকে, যা আপনার ডাকে সাড়া দেয় না (সহীহ মুসলিম- ২৭২২)। হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন- যখন এ আয়াতটি নাযিল হলো- তবে কি তোমরা এ কথায় বিস্ময়বোধ করছো? অথচ কান্না করছো না? (সূরা আন-নজম-৬০)। তখন আহলে সুফফার সবাই ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলে কাঁদতে লাগলেন। কান্নার শব্দ শুনে প্রিয়নবী সা. ও কাঁদতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন- যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ভয়ে কাঁদে’ সে ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না (তাফসীরে কুরতুবী)। মানুষের চোখের পানির মর্যাদা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি দামী। সুতরাং মুমিনের উচিত বেশি বেশি করে কাঁদা এবং হাসা। একদিন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন- আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে বেশি বেশি কাঁদতে, কম হাসতে। একথা শুনার পর উপস্থিত সাহাবীগণ মাথা নিচু করে এমন কাঁদা কেঁদেছেন যে, তাদের দাড়ি ভিজে গিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বেশি বেশি কাঁদার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!