সকল নবী-রাসূলুল্লাহ তাদের উম্মতের হিতাকাংখী ও কল্যাণকামী ছিলেন। উম্মতের সুখ-শান্তির জন্য তারা সদা চিন্তা করতেন। তবে আমাদের প্রিয় নবী সা. ছিলেন সর্বাধিক উম্মতদরদী নবী। তাঁর চিন্তা- চেতনায়, কথা-বার্তায়, আচার আরণে ও কাজ-কর্মে তা ফুটে উঠেছে। স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন- (হে মানুষ!) তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে এক রাসূল এসেছেন, তোমাদের কোন রকম কষ্ট ভোগ ও ক্ষতিকর বিষয় তার কাছে দুঃসহ ও কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের একান্ত কল্যাণকামী, ঈমানদারদের প্রতি তিনি স্নেহ পরায়ণ ও পরম দয়ালু (সূরা তাওবা- ১২৮)। মহানবী সা. তাঁর উম্মতের শুভ ও কল্যাণ কামনার আগ্রহ পোষণ করেন। তিনি তাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু ও অনুগ্রহশীল। তাদের কষ্টে তিনি কষ্ট পান।
সহজ শরীয়ত : রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন আমাকে সহজ দীন ও সহজ শরীয়ত সহ প্রেরণ করা হয়েছে (আহমদ ৫/২৬৬)। সহীহ হাদীসে রয়েছে, নিশ্চয়ই এই শরীয়ত খুবই সহজ। এটা তার জন্য সহজ বিধায় আল্লাহ তায়ালা সহজ বিধান দিয়ে তাকে পাঠিয়েছেন (ফতহুল বারী ১/১১৬)। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক হারাম ও না জায়েয বিষয় সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করেছেন এবং তিনি জানেন যে, তোমাদের কেহ তা অমান্য করবে। আমি যেন তোমাদের কোমর আঁকড়ে ধরে আছি, যাতে তোমরা আগুনে নিক্ষিপ্ত না হও, যেমনিভাবে পোকা মাকড় আগুনে পতিত হয় (আহমদ ১/৩৯০)।
বিনয়ী হওয়ার নির্দেশ : আল্লাহ তায়ালা বলেন- আর যারা তোমাকে অনুসরণ করে সেই সব মুমিনের প্রতি বিনয়ী হও। তারা যদি তোমার অবাধ্যতা করে, তাহলে তুমি বল তোমরা যা কর তার জন্য আমি দায়ী নই । তুমি নির্ভর কর পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু আল্লাহর উপর (সূরা শুরা ২১৫-২১৭)।
ক্ষমাশীল : রাসূলুল্লাহ সা. অত্যন্ত কোমল ও নরম স্বভাবের ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- অতএব আল্লাহর অনুগ্রহ এই যে, আপনি তাদের প্রতি কোমল চিত্ত; যদি আপনি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয় সম্পন্ন হতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তারা আপনার কাছে থেকে দূরে সরে যেত। অতএব, আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন্ (সূরা আল ইমরান- ১৫৯)। হাসান বসরী র. বলেন- দয়া ও ক্ষমাই রাসূল সা. এর চরিত্র, যার উপর তিনি প্রেরিত হয়েছে। রাসূল সা. হযরত আবু উমামার হাত ধরে বলেন- হে আবু উমামা কতক মুমিন এমন আছে যাদের জন্য আমার হৃদয় স্পন্দিত হয় হয় (মুসনাদ আহমদ)। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর রা. বলেন, আমি পূর্ববর্তী গ্রন্থ সমূহেও রাসূল স.া এর গুণাবলী দেখেছি যে, তিনি কঠিন হৃদয়, কর্কশভাষী বাজারে গোলমালকারী এবং অন্যায়ের প্রতিশোধ অন্যায় দ্বারা গ্রহণকারী নন; বরং তিনি ক্ষমাকারী (ফতহুল বারী ৮/৪৪৯)।
ধৈর্যশীল : দায়িত্ব পালনে সুদৃঢ় ও অবিচল সংকল্প গ্রহণ, বিভিন্ন মানুষের স্বভাবের বক্রতা সহ্য করা, অনেকের প্রত্যাখ্যান, অশালীন ও কটুবাক্য বর্ষণ বরদাশত করা এবং আল্লাহর নির্ধারিত ফরসালার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা এ সব ধৈর্যের আওতাভ‚ক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে তার পূর্বতন এক ভাইয়ের (নবী) কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, যিনি এতো সব কষ্টকর পরি¯ি’তি সহ্য করতে পারেননি। তাই প্রিয় হাবীবকে বলেন- আপনি স্বীয় প্রতিপালকের কয়সালা পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করুন এবং মাছের ঘটনার সাথী (ইউনূস আ.) এর মতো হবেন না (সূরা কলম-৪৮)। তাই মহানবী হাজারো বিপদাপদে এবং কাফির মুশরিকদের বর্ণনাতীত কষ্টে ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল। কাফিররা তাকে মাতাল, গণক, কবি, যাদুকর ইত্যাদি খারাপ গুনে গুনান্বিত করলে তিনি কোন উত্তর দেননি। বরং আল্লাহ তায়ালা তাঁ পক্ষ থেকে এর সবের উত্তর দিয়েছেন।
হাশরের ময়দানের উম্মতের চিন্তা : মানুষের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর এবং চিন্তার ক্ষেত্র হলো হাশরের ময়দান। সেদিন একমাত্র আল্লাহর কর্তৃত্ব চলবে। উলঙ্গ অবস্থায় সকল মানুষ হাশরের মাঠে উঠবে। সেদিন সূর্যকে মানুষের নিকটে আনা হবে, তা হবে তাদের থেকে এক ফরমাখ (তিন মাইল) দূরে। ব্যক্তি আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে অবস্থান করবে। কারো ঘাম হবে টাখনু সমান, কারো হবে হাটু সমান, কারো কোমর সমান, কারো মুখ সমান (মুসলিম, মিশকাত পৃ. ৪৮৩)। প্রত্যেক ব্যক্তি হাশরের মাঠে আল্লাহর ভয়ে বলতে থাকবে নাফসী, নাফসী আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান। এক মাত্র হযরত মুহাম্মদ সা. বলবেন রাব্বী হাবলী উম্মতি- হে রব! আমার উম্মতকে বাঁচান (বুখারী-২৭১২)।
তায়েফে দোয়া : নবুয়্যতের দশমবর্ষের শুরুতে ৬১৯ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসের শেষ দিকে অথবা জুন মাসের প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ সা. তায়েফ গমন করেন। সাথে নিয়ে যান পালক পুত্র জায়েদ ইবন হারেসাকে তায়েফ মক্কা থেকে ৬০ মাইল দূরে অবস্থিত। তায়েফবাসী তাঁর দাওয়াত কবুল করেনি বরং তার সাথে অমানবিক আচরণ করে। তারা উচ্ছৃঙ্খল ও দূর্বৃত্ত ও যুবকদেরকে তাঁর পেছনে লেলিয়ে দেয়। তারা এক সাথে তাকে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে তাঁর দেহ মোবারক রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। হযরত জায়েদ প্রিয়নবীকে ঢালের ন্যায় বাঁচাতে গিয়ে নিজেও চরমভাবে আহত হন। তায়েফ থেকে ফেরার পথে তাহাজ্জুদের নামাযের সময় হলে হযরত জায়েদ জুতা খুলতে গেলে রাসূল সা. বেহুশ হয়ে পড়ে যান। তিনি তাদের জন্য বদ দোয়া করেন নি; বরং তাদের জন্য হেদায়তের দোয়া করেছেন (আর রাহীকুল মাখতুম)।
উহুদে আহত : তৃতীয় হিজরীতে সংঘটিত উহুদের যুদ্ধে তীরান্দাজ যোদ্ধাদের ভ‚লের কারণে যুদ্ধের পট ভ‚মি পরিবর্তন হয়ে যায়। ৭০ জন মুসলমান শহীদ হন এবং মহানবী সা. মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁর নীচের মাড়ির ডানদিকের রুবায়ী দাঁত শহীদ হয় এবং নীচের ঠোঁট কেটে যায়। দু’টি কড়া চেহারায় বিঁধে যায়। হযরত আবু ওবায়দা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে একটি কড়া বের করেন। এতে তাঁর একটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। দ্বিতীয় কড়াটি বের করতে গিয়েও চার আরেকটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। রাসূল সা. তাদের জন্য বদ দোয়া করেননি। শুধু এতটুকু বলেছেন- “এ জাতি কিভাবে সফলতা লাভ করতে পারে যারা তাদের নবীকে রক্তে রঞ্জিত করে দিয়েছে” (যাদুল-মায়াদ, ২য় খন্ড, বুখারী ২য় খন্ড)।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।