ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানুষের সেবার আকাঙ্খা এখন একেবারেই সীমিত। এরপরও হয়রানির শেষ নেই। এরইমধ্যে এ জগতে ভেতরে-ভেতরে হয়রানি-ঠকবাজির কিছু কাণ্ড ঘটেছে যা সরকারের শীর্ষ মহলকেও নাড়া দিয়েছে। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় কেউ হয়রানির ঘটনা শিকার হলে প্রতিকারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘হটলাইন’ নম্বর ১৬২৩৬-এ ফোন করে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে। পরিপত্র জারি করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিজস্ব হটলাইন নম্বর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হটলাইন নম্বরটি দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের এ নিয়ে কোন গরজ নেই। কারণ জনতার অন্তহীন ব্যস্ততা এখন দ্রব্যমূল্য, রুজি-রোজি, অসুখ-বিসুখ মোকাবেলা করা নিয়ে। আর আগামী দিনগুলোতে কোনো মতে বেঁচে থাকা তাদের আরেক ভাবনা। আর তাদের মাথাপিছু আয়, আয়ু, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের রিজার্ভ-প্রবৃদ্ধির মতো বিষয়ের গুরুতর গণিত কষে সরকার। বেশিরভাগ জনগণ এ অংকের ফল জানে সরকারের ঘোষণা বা গণমাধ্যমের কাছ থেকে। তারা সরকারের দেয়া হিসাব কোন সময় মানে, নইলে মানে না। এসব বিষয়ে হাঁ-না বা মাথা নানান দিকে নাড়া পর্যন্তই সীমানা বেশির ভাগ জনতার।
এছাড়া অর্থনীতির এসব অংক অধিকাংশ জনগণের কাছে বড্ড দুর্বোধ্য। নতুন করে এসব অংক বোঝা বা শেখার সময়ই বা কই? বিশেষ করে রিজার্ভের হিসাবের প্রতি তাদের অনেকের গরজও নেই। তারওপর গণমাধ্যমে প্রচারিত রিজার্ভের বিপরীতমুখী হিসাব নিকাশ মানুষকে আরো বিগড়ে দেয়। দেশ রিজার্ভে টন টন, উপচে পড়ছে ধরনের সংবাদ তারা দেখে। আবার কাছাকাছি সময়ে রিজার্ভের অবস্থা বড় করুণ ধরনের সংবাদও তারা দেখে। রিজার্ভের অংকের হিসাব কম বোঝে বলে তখন তারা এসব হিসাবের দিকে চোখ ফেলে না। সত্য-মিথ্যা তো আরো পরের ব্যাপার।
দেশে মাত্র ক’দিন আগে ৭-৮ মে’র দিকের হিসাব ছিল রিজার্ভ কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে ২ হাজার ৯৮৩ কোটি ডলারে চলে গেছে। এর কারণ ডলার সঙ্কট ও মন্দা। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) মার্চ-এপ্রিল সময়ে আমদানি বাবদ ১১৮ কোটি ডলার পরিশোধের পর গত সোমবার ৮ মে রিজার্ভ কমে ২ হাজার ৯৮৩ কোটি ডলারে ঠেকেছে। অর্থাৎ সামনে অবস্থা বড় নিদারুন। দিন দুয়েকের মাঝেই খবরের আপডেটে জানানো হয়, বাংলাদেশের রিজার্ভ আবার ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কী এমন ম্যাজিক বা কুদরত? বাংলাদেশ ব্যাংক এর ব্যাখ্যায় বলেছে, আকুর বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেলেও বিদেশ থেকে ডলার আসায় রিজার্ভ আবার ৩০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। তারওপর যোগ হয়েছে কিছু ঋণ ও অনুদানের অর্থ।
একদিকে কঠিন অংক, আরেকদিকে কড়া তথ্য। মাথা না ঘুরে কি উপায় আছে? ২০২০ সাল থেকে বৈশ্বিক মহামারি করোনার ধাক্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হু হু করে বাড়তে থাকে। বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় ওই সময় সব প্রবাসী আয় বৈধ পথে তথা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আসে। আবার আমদানিও কমে যায়। ফলে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে প্রথমবারের মতো ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি। বেড়ে যায় আমদানি খরচ। কিন্তু, সেই তুলনায় প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বাড়েনি। পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিনিয়ত আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়। এতে রিজার্ভে টান কেবল পড়তেই থাকে।
এমন সরল বর্ণনা বোধগম্য। খুব না বুঝলেও এ সংক্রান্ত খবর অন্তত জানতে বা পড়তে সহজ হয়। রিজার্ভ বৃদ্ধির এখনকার তথ্য আমলে নিলে আশাবাদী হতে হয়। কিন্তু, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ ৩ হাজার ৩৬ কোটি ডলার হলেও এর ৬০০ কোটি ডলার ব্যবহারযোগ্য নয় মর্মে বার্তা দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ ভেজাল লাগাচ্ছে কেন? আইএমএফ গত মার্চে সর্বনিম্ন ২২ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, যা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। আগামী জুনে এই লক্ষ্য বাড়িয়ে ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার শর্ত দিয়ে রেখেছে সংস্থাটি। আগামী সেপ্টেম্বরে নিট রিজার্ভের পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে তারা। তাদের শর্ত পূরনের চেষ্টা সরকা অবশ্যই করবে। কিন্তু হিসাবের অংক ঠিক থাকবে কিনা-এ প্রশ্ন থেকে যায়। দুদিন পর আবার রিজার্ভে খরার অংক এসে হাজির হবে না তো? অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞান না থাকা মানুষ চলতি পথেই অন্তত এতোটুকু বোঝে, দেশে নগদ টাকার জোগান অব্যাহতভাবে কমছে। বাড়ছে ধার-কর্জ। ব্যাংকগুলোর ভেতরের অবস্থাও ভালো যাচ্ছে না।
দিনদিন এ সঙ্কট বেড়ে চলছে। এ সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আর সরকারি ব্যাংক পরস্পর দাতা-গ্রহিতা হয়ে গেছে। সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রির বিপরীতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সমপরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এর পরিনামে এক দিকে নগদ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে চলে যাচ্ছে। আরেকদিকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। এর মাঝে ঝুলছে আইএমএফের ঋণের কিস্তি ছাড় পেতে নিট রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের ওপর রাখার শর্ত। এর বাইরে সরকারি ব্যাংক আর বেসরকারি ব্যাংকের ট্রিটমেন্ট আলাদা। এর পক্ষেও যুক্তি দাঁড় করানো আছে।
সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটা করতে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে হয়। কিন্তু সরকারি ব্যাংকগুলো আমদানি দায় মেটাতে সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করতে পারে না। এ কারণে বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে হিসাবের ভিন্নতা চলে আসছে। ভিন্নতা আইএমএফের হিসাব-নিকাশেও। তাদের কাছ থেকে ঋণ নিতে গেলে বাংলা হিসাব পদ্ধতি চলে না। শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী নিট রিজার্ভ গণনা করতে হয়। এরইমধ্যে ৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল নামে। আইএমএফের হিসাব আমলে নিলে রিজার্ভের যে অংক দেখানো হয় তা টিকবে না। অংক অনেক কমে যাবে। তা একদম লুকিয়ে রাখা যাবে এমনও নয়। সেই হিসাব অনেকটাই স্বচ্ছ। ডলার সঙ্কট কাটাতে ব্যাংকগুলো নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংকের শরনাপন্ন হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদ অর্থে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। সরকারি কেনাকাটার দায় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। এ লেনদেনের হিসাব লুকানো কঠিন। এমন হাওলাতি রাস্তা সহসা বন্ধ হয়ে যাবে- এমন লক্ষণও নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়ায় অনেক ব্যাংকের নগদ টাকায় টান পড়ার তথ্যও এখন ওপনে সিক্রেট। ওইসব ব্যাংকের এখন কলমানিসহ বিভিন্ন পথ বের করতে হয়েছে। তাও লুকানোর মতো নয়। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির কথা। তখনকার গভর্নর ড. আতিউর রহমান তা জেনেও কিছুদিন তথ্যটি ধামাচাপা রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু, অব্যাহতভাবে লুকিয়ে রাখতে পারেননি। সেটি ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় চুরির ঘটনা। যা সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। বাংলাদেশের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে। তথ্য আদান–প্রদান ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার আনে সুইফট। কিন্তু যে দেশের কষ্টার্জিত আয়ের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি হলো, সেই বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ব্যবস্থা নয়েনি। শাস্তি পায়নি কেউ। সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টটিও আজতক প্রকাশ হয়নি। ওই প্রতিবেদনে উঠে আসা চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলো যে অবিরাম অজানা থেকে যাবে-তা বলা যায় না।
সুইফট সার্ভারের সঙ্গে স্থানীয় নেটওয়ার্ক জুড়ে দিয়ে গোপন পাসওয়ার্ড দিয়ে ৮ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৬২৩ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১০ কোটি টাকা) এক চালানে হাতানো হয়নি। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে চুরির তথ্য জানতে পারলেও তা গোপন রাখা হয়েছিল প্রায় মাস খানেক। এর পরের ঘটনা এখন নতুন করে লেখার অবকাশ আপাতত নেই। কিন্তু, তথ্যের চাতুরি করতে গেলে সাধারণত অর্থকর্মেও চাতুরি চলে আসে তা মনে রাখা দরকার কারণ সময়টা এখন বড় খারাপ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।