দৈনিক ফেনীর সময়

রোকেয়ার চোখে স্বপ্ন দেখি আজও

রোকেয়ার চোখে স্বপ্ন দেখি আজও

তাহমিনা আক্তার

“মনের মরম ব্যথা প্রকাশিতে নারি
কত পাপ ছিল তাই হয়েছিনু নারী”
বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন

এই উপলব্ধি করেছিলেন নারী মুক্তির পথ প্রদর্শক মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া। যখন নারীরা ছিল অসূর্যস্পর্শী। সময়টা ছিল ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর জমিদার কন্যা রাহাতুনন্নেসা চৌধুরাণীর কোল আলো করে জন্ম নিলেন আলোর পথের পথিক এই সূর্য কন্যা বেগম রোকেয়া । রংপুর জেলার পায়রাবন্দে জন্ম তাঁর । প্রায় সাড়ে তিনশো বিঘা লাখেরাজ জমির মাঝখানে রংপুরের প্রত্যন্ত একালায় সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা জমিদার বাড়ির মহলটি অবস্থিত । তাঁর পিতা ছিলেন জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের। শৈশবে তিনি বড় ভাই ও বোনের কাছে ইংরেজি ও বাংলা ভাষা রপ্ত করেন। তখন ফার্সি ও উর্দু ভাষার প্রচলন ছিল।

সমাজের পিছিয়ে থাকা নারীদের নিয়ে বেগম রোকেয়া লড়াই করেছেন আমৃত্যু। তাঁর লেখনী এবং বাস্তবিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মধ্যদিয়ে তিনি নারীদের মুক্তির পথ সুগম করেছেন। পথটা সহজ ছিল না, ছিল কাটা বিছানো বন্ধুর পথ। অত্যন্ত মেধাবী সাহিত্যিক, সমাজ সংর্স্কা পরিশ্রমী শিক্ষাবিদ ছিলেন তিনি।

১৯০৯ সালে কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৬ সালে আনজুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে নারী সংগঠন গড়ে তোলেন। পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। মতিচুর (২), সুলতান’স ড্রিম, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী।

মতিচুর গ্রন্থটি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উদ্দেশ্যমূলক প্রবন্ধ গ্রন্থ। মতিচুর গ্রন্থটি দুটি খন্ডে বিভক্ত। দুটি খন্ডে মোট ২৭টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলোতে তিনি বেশিরভাগই নারীদের পিছিয়ে পড়ার দৃশ্য এবং সামনে আসার পথ দেখিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ ‘অর্ধাঙ্গী’ তে তিনি দেখিয়েছেন মুসলিম নারীদের পিছিয়ে পড়ার দুর্বহ জীবন ও অধিকারহীনতাকে তিনি দায়ী করেছেন পুরুষ সমাজের নিদারুন স্বার্থপরতা ও আধিপত্যকে। স্ত্রী জাতির অবনতি প্রবন্ধে তিনি নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন- “ভগিনীদিগকে জানাইয়াছি যে, আমাদের একটা রোগ আছে – দাসত্ব”।

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে তিনি নারীদের সমাজের অর্ধেক উল্লেখ করে বারবারই দেখাতে চেয়েছেন যে একটা অংশ দূরে রেখে সমাজের উন্নতি সম্ভব নয় ,তিনি হাস্যরসের সাথে সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন-“প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর বোধোদয় পর্যন্ত। “ স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ মাপেন। স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ নক্ষত্রমালা বেষ্ঠিত সৌরজগতের বিচরণ করেন সূর্য্য মন্ডলের ঘনফল তুলাদন্ডে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন। স্ত্রী তখন রন্ধন শালায় বিচরণ করেন। চাউল ডাউল ওজন করেন এবং রাধুনীর গতি নির্ণয় করেন। বলি জ্যোতিবের্বত্তা মহাশয় আপনার পার্শ্বে আপনার সহধর্মিণী কই? এভাবে তিনি প্রবন্ধে নারীদের মুসলিম আইনে সম্পত্তির অধিকার নিয়েও আলোচনা করেছেন।

পুরুষদের তিনি স্বামী শব্দের বদলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দ বলতে চেয়েছে। ‘অবরোধ বাসিনী’ গ্রন্থে অবরোধবাসিনী বলতে মূলত বুঝানো হয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকা। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের অবরোধবাসিনী গ্রন্থে সে সময়কার নারীদের অবরুদ্ধ করে রাখা শুধু নয় বহু কষ্টের নিদারুন বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তাঁর সে সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে বাস্তবচিত্র তিনি তুলে ধরেছিলেন। নারীদের আবদ্ধ রাখতে রাখতে তাদের মন ও ছিল অবরুদ্ধ । তাদের হাটা চলা বলা সবকিছুতেই ছিলো বিধি নিষেধ। তিনি যে উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর মধ্যে দু’ একটি উল্লেখ করলে তখন তাঁর সময়ের নারীদের করুণ দৃশ্য আমরা দেখতে পাবো- “ঢাকা জিলার জমিদারের প্রকান্ড পাকা বাড়িতে আগুন লাগলে বাড়ির মহিলাদেরও বাহির করার প্রয়োজনবোধ হয়। তবে এতগুলো পালকি একসঙ্গে জোগাড় করতে না সমর্থ হওয়ায় একটা বড় রঙিন মশারির মধ্যে বাড়ির নারীদের একত্র করে রওনা হয়। পথে কাঁটা এবং অন্য কারণে মশারি ছিড়ে ভেতরের সবাই যখন বাইরে বেরিয়ে আসল তখন পর্দা রক্ষায় ধান ক্ষেতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটায় । পরে সন্ধ্যার পর পালকি এনে তাদের নেয়ার ব্যবস্থা হয়।

অবরোধবাসিনী ৮ এ আরেকটি বর্ণনা এসেছে এমন- “এক বাড়িতে আগুন লাগিয়াছিল। গৃহিনী বুদ্ধি করিয়া তাড়াতড়ি করিয়া সমস্ত অলংকার একটা হাত বাক্সে পুরিয়া লইয়া বাহির হইলেন দ্বারে আসিয়ে দেখিলেন সমাগত পুরুষেরা আগুন নিবাইতেছেন তিনি তাহাদের সম্মুখে বাহির না হইয়া অলংকারের বাক্সটি হাতে করিয়া ঘরের ভেতর খাটের নিচে গিয়া বসিল তদাবস্থায় পুরিয়া মরিলেন কিন্তু পুরুষের সম্মুখে বাহির হইলেন না। ধন্য! কুল কামিনীর অবরোধ”। সুলতানার স্বপ্ন নামে রচনাতে তিনি দেখিয়েছেন সমাজের নারী ও পুরুষের প্রচলিত ভূমিকা উল্টে যেতে। নারীরা সমাজের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রধান চালিকা শক্তি। আর পুরুষেরা প্রায় গৃহবন্দি।

এই সমাজে কোন অপরাধ নেই। তিনি যে সময়ে এটি লিখেছেন অত্যন্ত সাহসী ও বিপ্লবী সাহিত্যকর্ম হিসেবে এটি তখন গণ্য হয়। স্বপ্নে অবস্থান করা সুলতানা তাঁর শয়নকক্ষে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি মূলত বৃত্তের খোলস থেকে মুক্ত হয়ে নারীরা যে নিজেদের মুক্ত বিহঙের মত ডানা মেলতে চায় তারই প্রকাশ স্বপ্নটি। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডিয় তত্ত্ব অনুসারে তাঁর অবচেতন মন মুক্তির ইচ্ছেয়ই অবিশ্বাস্য দুঃসাহসী স্বপ্নে ধরা দিয়েছে। হুমায়ুন আজাদ তাঁর নারী গ্রন্থে লিখেছেন- “২৫ বছরের এক আমূল বাস্তবায়িত হয়েছে সুলতানার স্বপ্ন এ”।

প্রাথমিক জীবনে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন মোমবাতি জ্বালিয়ে বড় ভাইবোনদের নিকট পড়াশোনা করেছেন। ১৮৯৮ সালে তাঁর বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দু ভাষী ডেপুটি ম্যাজিস্টেটের সংগে। স্বামীর উদার মুক্ত মন এবং বিজ্ঞান মনস্ক মানসিকতার কারণে তিনি দেশি বিদেশী লেখকদের রচনার সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করার সুযোগ পান। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মারা যায়। এরপর তিনি নিঃসঙ্গ জীবনে বসে লিখেছিলেন জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো। ১৯০৯ সালে স্বামীর প্রদত্ত টাকা দিয়ে মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে তিনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পারিবারিক কারণে তিনি কলকাতা ছেড়ে ভাগলপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। ১৯১১ সালে তিনি মাত্র ৮জন ছাত্রী নিয়ে নতুন রুপে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১৬ সালে ছাত্রীসংখ্যা ১০০ জন পার হয়ে যায় । এরপর ১৯১৬ সালেই মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। পথটি সহজ না হলেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম দেখে কাজের প্রশংসা করে ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী সরোজিনি নাইডু এক চিঠিতে তাকে লিখেছিলেন “কয়েক বছর থেকে দেখছি যে আপনি কি দু:সাহসের কাজ করে চলেছেন। মুসলিম বালিকাদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তারের জন্য আপনি যে কাজ হাতে নিয়েছেন এবং তাঁর সাফল্যের জন্য দীর্ঘকাল ব্যাপি যে কাজ হাতে নিয়েছেন তা বাস্তবিকই বিস্ময়কর”। ১৯৩১ সালে রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা প্রথমবারের মতো প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রায় ৬০০ ছাত্রী কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন।

রোকেয়া সাখাওয়াত জন্ম নিয়েছিলেন এক অন্ধকার পরিবেশে নারীদের আলোর পথের পথিক করেই তিনি ১৯৩২ সালে অন্তিম শ্বাস নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর অবরোধবাসিনী গ্রন্থে লিখেছিলেন “আমরা বহুকাল হইতে অবরোধে থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি ; সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের বিশেষত কিছুই নাই। মেছোনি কে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে পচা মাছের দুর্গন্ধ ভালো না মন্দ ? সে কি উত্তর দিবে”। সে অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছেন বেগম রোকেয়া। তিনি প্রমান করেছিলেন পর্দায় থেকেও নারীরা শিক্ষা লাভ করতে পারে। তিনি পুরুষের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ করে নারীকে আলো দেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন আমৃত্যু লড়াইয়ের মাধ্যমে। ১৯৩২ সালে ৯ ডিসেম্বর রাত ১১টায় নারীর অধিকার শিরোনামে নিবন্ধটি লিখছিলেন তিনি। সেই রাতেই অসুস্থ্য হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বেগম রোকেয়ার ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসের ‘তারিণী ভবন’ আজো বাঙালি নারীদের অনুপ্রেরণা। যেখানে নিগৃহীত নারীদের আশ্রয়, বিদ্যালয় সব তারিণী ভবনে হয়। পদ্মরাগের নারীরা স্বাবলম্বী, কর্মনিষ্ঠ, নিছক আবেগ বর্জিত, বুদ্ধিদীপ্ত । তারা মুক্তমনা, নতুন পথের অভিযাত্রী তারা। আজ নারীরা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা চাকুরি নভোমন্ডলে বিচরণ করছে।

প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্টের সময় দেখা যায় নারী শিক্ষার্থীরা গুণে মানে সংখ্যায় সফলতার হারে অনেক বেশি । স্কুল-কলেজগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় শ্রেণি কক্ষের উপস্থিতিতেও নারী শিক্ষার্থীরা বেশি। এটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয় যে খেলাধুলায় ও আমাদের নারীরা সফল। ২০২৪ এর সাফ গেইম প্রতিযোগীতায় ফুটবলে চ্যাম্পিয়ান হয়ে বিশ্ব জুড়ে প্রশংসায় ভেসেছে।

বেগম রোকেয়া যুগ যুগ ধরে সমগ্র নারী জাতির জন্য প্রেরণা। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর বাস্তবায়ন হয়তো ধিরে ধিরে হচ্ছে কিন্তু দেশের সর্বক্ষেত্রে বিসিএস প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নারী উদ্যোক্তা দ্বারা সমাজ উপকৃত হচ্ছে। কিছু বাধাবিঘ্ন থাকলেও হয়তো এমনই পরিবেশের স্বপ্ন দেখে তাঁর অনেকদুর এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন এই মহিয়সী নারী। শুধু ৯ ডিসেম্বর নয় সারা বছরই বেগম রোকেয়া বাংলার ঘরে ঘরে নারীদের অনুপ্রেরণা শক্তি সাহস হয়ে আছেন থাকবেন।

তথ্যসূত্রঃ রোকেয়া রচনাবলী বাংলা একাডেমী
শাহীদা আক্তার (হোসেন সাখাওয়াত)
মুর্শিদ গোলাম (প্রথম নারীবাদী রোকেয়া সাখাওয়াত)
দৈনিক জনকন্ঠ ২০১৭, রোকেয়া দিবস প্রথম আলো ২০১৮
লেখক : প্রভাষক (বাংলা)
রামপুর নাসির মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজ, ফেনী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!