fenirshomoy logo black

রিন্টু আনোয়ার :

স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলমান থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে সেই সংকট সামাল দিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জান্তা বা সামরিক শাসকরা। তাদের যুদ্ধ বা গণ্ডগোলে নাফ নদীর পেরিয়ে তাদের গোলায় লাশ পড়ছে বাংলাদেশ। এক সময় জান্তাদের তাড়ায় ধেয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে নিরীহ-নিরস্ত্র রোহিঙ্গারা। এখন সেখানকার বিদ্রোহী বা স্বাধীনতাকামীদের ধাওয়ায় টিকতে না পেরে মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ-বিজিপি সদস্যসহ ওই জান্তা সম্প্রদায়ের সশস্ত্র-শক্তিমানরা অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতে বাংলাদেশের ভেতরে থাকা রোহিঙ্গারাও কিভাবে অংশ নিচ্ছে তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। এমন অবস্থায় সীমান্তের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে সীমান্তের বাসিন্দাদের মধ্যেও।

বছর কয়েকের মধ্যে ঘটনার কী হেরফের! দৃশ্যায়নের কী ব্যবধান! আগে মিয়ানমারের বিতাড়িত নাগরিক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্তের কূটনীতি করেছে বাংলাদেশ। সেই রোহিঙ্গারা দিনে দিনে আপদ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের জন্য। মিয়ানমার তাদের ফেরত নিচ্ছে না। প্রতিবেশি ভারত-বন্ধু চীনসহ বিভিন্ন দেশ নানান মিষ্টি কথা বললেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করার প্রশ্নে করছে কেবল চাতুরি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের এবারের সিদ্ধান্ত মিয়ানমারের আর একজনকেও এখানে জায়গা না দেয়ার। কিন্তু, বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর। এবার আর নিরস্ত্র-নিরীহ নয়, একেবারে স্বশস্ত্রদেরই অনুপ্রবেশ ঘটছে। তাদেরকে চিকিৎসাসহ মানবতা দেখাতে হচ্ছে।

রোহিঙ্গা নিয়ে চাতুরি করা ভারতও এবার আচ্ছা রকমে আক্রান্ত। সেখানেও আছড়ে পড়ছে মিয়ানমারের অনেকে। কিছু সংখ্যককে পুশব্যাক করছে, কিছু সংখ্যক লুকিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। নিজেদের জন্য বোঝা হয়ে ওঠায় এখন ভারত এ প্রশ্নে গা ঝাড়া দিচ্ছে। এ রকম সময়ে ভারত সফরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ভারতের বিশেষ বিশ্বস্ত-পরীক্ষিত তিনি। নতুন সরকার গঠনের পর এটিই তার প্রথম ভারত সফর। সফরকালে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দুজনই টেনে এনেছেন মিয়ানমারের সীমান্ত পরিস্থিতি। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, “আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে ভারত-বাংলাদেশ একযোগে কাজ করবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিবৃতি দিয়েছে। বলেছে-আন্ত:সীমান্ত কানেক্টিভিটিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পর্যালোচনা হয়েছে।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই কমন প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। বেশ কিছুদিন ধরে মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন প্রদেশে সে দেশের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সংঘাতের পরিণাম ভুগতে হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশ ‘দুদেশকেই। দুই দেশেই মিয়ানমারের সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শত শত সদস্য পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এরইমধ্যে মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি সামলাতে ভারত-বাংলাদেশ একযোগে কাজ করার কথা বললেও ঠিক কীভাবে তারা কাজ করবে, তা এখনও অস্পষ্ট। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুদীর্ঘ মিয়ানমার সীমান্তের পুরোটা জুড়ে বাংলাদেশ সীমান্তের মতো কাঁটাতারের বেড়া বসানোর কাজ শুরু করবে বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশকেও আগামী দিনে মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে ভারত থেকে।

সমস্যা বেড়া থাকা না থাকায় নয়। কাঁটা তারের বেড়া কেন, উঁচু প্রাচীরের বেড়ায়ও এ ধরনের সমস্যার ফয়সালা আসে না, তা ইতিহাসে প্রমাণিত। পানি এরইমধ্যে অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রান্তের স্থানীয়দের ধারনা ওপারের ক্যাম্পগুলো মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছে। সেজন্যই সীমান্তের ওপাশে কদিন ধরে গোলাগুলি কমেছে। পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত মনে হচ্ছে। এটি এখানকার ধারনা। ওখানে আসলে কী হচ্ছে, এ সংক্রান্ত তথ্য কম। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় আরাকান আর্মিসহ অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চলমান লড়াইয়ের কারণে যেন কারও কোনও ক্ষতি না হয়, সেজন্য বিজিবি মহাপরিচালক স্থানীয় জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। এও বলেছেন, “এটা একেবারে বর্ডার সংলগ্ন। আমাদের সাধারণ জনসাধারণের জন্য এই জায়গাটুকু আসলে নিরাপদ নয়। বিশেষ করে যখন গোলাগুলি শুরু হয়, সেই সময়টুকুতে তো একেবারেই নয়।” নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকা আদৌ সুখকর নয়। তা বাংলাদেশের স্থানীয়দের বেলায়ও, মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্যও। সীমান্তরক্ষী বিজিবির জন্যও এটি অতি বাড়তি কাজ। বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ-বিজিবি জানিয়েছে, চলমান এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। যারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসাদের নিরাপত্তা, খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে বিজিবি। এছাড়া, এদের মধ্যে আহতদের চিকিৎসাও দিতে হচ্ছে।

সীমান্তে চলমান অস্থিরতার মাঝে বিজিবিকে ধৈর্য্য ধরতে বলা হয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে। মিয়ানমারের নিজেদের গোলযোগের কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুর ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করে প্রতিবাদ ও উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের নিজস্ব সীমানায় গোলা নিক্ষেপের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। দ্রুত তাদের নাগরিকদেরকে ফেরত নিতেও বলা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এসব বিবৃতিমূলক কূটনীতির নিউজ ভ্যালু আছে সত্য। কিন্তু, সমস্যা সমাধানের দাওয়াই নেই। বিপরীতে জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে মিয়ানমার পরিস্থিতি। দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের সাথে সীমান্তবর্তী প্রদেশে সামরিক সরকারের লড়াই এখন চরমে।

রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি যেভাবে শক্তি বাড়িয়ে বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিয়েছে তাদের বিচলিত হয়ে পড়েছে মিয়ানমার সরকার। বছর তিনেক আগে মিয়ানমারে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিকে -কে হটিয়ে ক্ষমতা নেয় সামরিক সরকার। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জান্তা বিরোধী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ জোরালো হতে থাকে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। একই সাথে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন তাদের শক্তি আরো বাড়িয়ে তোলে। এসব গ্রুপও জান্তা সরকারের সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করে। তিন বছরের মাথায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির শান ও রাখাইন প্রদেশে তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত, তারা এ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। গত তিন বছরে এসব গোষ্ঠী মিয়ানমারে ৩০০’র বেশি সামরিক চৌঁকি এবং ২০টি শহর দখল করে নিয়েছে।

পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই সংঘাত কিভাবে শেষ হবে তার কোন সুস্পষ্ট নিশানা দেখা যাচ্ছে না। দেশটির এবং নাগরিকদের কী অবস্থা হবে, তাও ধোাঁশাচ্ছন্ন। প্রতিবেশি ভারত-বাংলাদেশ উভয়েই আক্রান্ত। প্রভাবশালী দেশ চীন কী করছে- এ প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। মিয়ানমারের উপর একচেটিয়া প্রভাবশালী দেশ চীন। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর অবস্থা তাদেরই রয়েছে। উভয়ের হাতেই চীনের অস্ত্র। মাসখানেক আগেও চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও জান্তা সরকারের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিটি ছিল শুধু চীন সীমান্ত সংলগ্ন শান প্রদেশের জন্য। এই প্রদেশটিতে ১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সংঘাত চলছে। এই প্রদেশে বিদ্রোহীরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সফলতা পেয়েছে। চীন সেখানে মধ্যস্থতা করেছে তার নিজের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে। মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তাদের কাছে গৌণ। যুদ্ধবিরতি নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতেও তা স্পষ্ট। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চীন সীমান্তে তাদের অধিবাসীদের ক্ষতি না করা এবং মিয়ানমারের ভেতরে চীনের প্রকল্পে যারা কাজ করছে তাদের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সে নিশ্চয়তা দিয়েছে উভয়পক্ষ। মোটকথা, মিয়ানমারের অস্থিরতা যাতে সীমান্ত ছাপিয়ে চীনের ভেতরে না যায় সে জন্য তারা বেশ উদ্বিগ্ন। কারণ, চীনের বিভিন্ন অপরাধী-চক্র শান প্রদেশে কিংবা মিয়ানমারের ভেতরে বসে নানা ধরণের সাইবার অপরাধ, মাদক, মানব-পাচারে জড়িত।

চীন চিকন বুদ্ধিতে তার হিসাব মেলাচ্ছে। ভারতও মেলাবে। বাংলাদেশ কী করবে? তুলামূলক বেশি আক্রান্ত বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা বিষে নীল হওয়া বাংলাদেশ নিয়ে কম খেলছে না কেউই। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার নামে রাজনীতি-কূটনীতি হয়েছে প্রচুর। মানবতার স্বীকৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক পদক-পুরস্কারের বুদ্ধি-টোপ-লোভ ছিল প্রচুর। সেটা ফলেনি। উপরন্তু আপদ চেপেছে। দিনে দিনে বিষফোঁড়া হয়ে ওঠা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে কার্যকর সহায়তা মেলিনি। বরং তামাশা হয়েছে। যদিও আশ্রয় নেওয়া সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের ফেরত পাঠাতে সরকার ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তারওপর নতুন করে বোঝা চাপছে। মিয়ানমারে বাংলাদেশ সীমান্ত-ঘেঁষা এলাকায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে দেশটির সেনাবাহিনীর যুদ্ধের ভয়াবহতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আরো জটিল করে দিয়েছে।

বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমার সীমান্তের সামরিক টহল চৌকিগুলোতে এখন রয়েছে আরাকান আর্মির সদস্যরা যারা মূলত বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারকে এই এলাকায় খুবই সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবে না যাতে করে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছে ভুল কোন বার্তা যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে,প্রত্যাবাসন নিয়ে কথাবার্তা এখন কার সঙ্গে হচ্ছে? মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে না আরাকান আর্মির সঙ্গে? রাখাইনে আরাকান আর্মি একটি রাজনৈতিক শক্তি। রোহিঙ্গারা যেসব এলাকায় বসবাস করতো এবং এখনো যেসব এলাকায় তারা বসবাস করে সেখানে আরাকান আর্মি আরো শক্তিমান। কিন্তু, মিয়ানমারের কাছে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী-বিদ্রোহী। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকে না। আবার আরাকান আর্মির সাথে আলোচনা না করে সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার আলোচনাই কিভাবে সম্ভব? বড় রকমের একটা নতুন জটিলতার ঘুরপাকে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই মিয়ানমারের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। চীন ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে সরকারের তরফে। বাস্তবে সহযোগিতা কদ্দুর মিলবে-পুরোটাই অপেক্ষার বিষয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!