অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’, সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়। বর্তমান সময়ে আমাদের আপন সমাজের কেমনতর অবয়ব তা সচেতন সামাজিক মাত্রেরই জানা। তথাপি নানাবিধ অপরিহার্য ব্যস্ততা হেতু আপন স্বার্থেই আপন চেহারা অবলোকন করে নেওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। আমাদের বর্তমান সমাজ কাঠামো ক্ষেত্রবিশেষে কেমন অবস্থায় রয়েছে ক্ষেত্রবিশেষ বলতে দেশের বর্তমান আর্থ-ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাক্ষেত্রের অবস্থা, মূল্যবোধ ইত্যাদি সবকিছুকে বোঝায় বলে মনে করি। এককথায় যদি এইমত প্রশ্নের জবাব সন্ধান তাহলে বলব, মোটামুটিভাবে তেমন সুস্থ অবস্থায় নেই।
রমনা পার্ক, নর্থ সাউথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চিটাগাং ইউনিভার্সিটি, কারমাইকেল কলেজ, রেইন। পাঠক শব্দগুলো সবারই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু যদি বলি এগুলোর প্রায়োগিক ভিন্নতাও রয়েছে অর্থাৎ আপনি এ শব্দগুলো বলতে যা বোঝেন তার বাইরেও ভিন্ন অর্থে এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। তখন নিশ্চয়ই একটু খটকা লাগবে। হ্যাঁ এ শব্দগুলো বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে পর্ণো ভিডিও ফুটেজের কোড নেম হিসেবে। যার একেকটি ফুটেজ বিক্রি হচ্ছে ১শ থেকে শুরু করে ৪শ টাকায়। মেমোরি কার্ড, পেনড্রাইভ ইত্যাদি ডিভাইসে এগুলো হস্তান্তর হয়। যার প্রধান ক্রেতা স্কুল-কলেজের তরুণ শিক্ষার্থীরা। আজকাল প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমে নিয়মিতই এর ভয়াবহতা তুলে ধরা হচ্ছে। লেখা হচ্ছে বিস্তর। প্রশাসন মাঝে মাঝেই অভিযান পরিচালনা করছে। জব্দ করছে এ ধরনের ভিডিও সম্বলিত বিপুল পরিমাণ মেমোরি কার্ড-পেন ড্রাইভ। জেল-জরিমানাও কম করা হচ্ছে না। তথাপিও এর ব্যাপকতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশ্ন হল এই ভিডিও ফুটেজগুলোর উৎস কী? এক কথায় এর উত্তর হল প্রেমের নামে বেলেল্লাপনায় মেতে ওঠা প্রেমিক-প্রেমিকারাই এর মূল উৎস। লক্ষণীয় বিষয় হলো, পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এসব ভিডিও ফুটেজের একটিতেও জোর জবরদস্তি করে কেউ কাউকে এই ধরনের ভিডিও তৈরিতে বাধ্য করছে বলে অনুমিত হয় না। অর্থাৎ ফুটেজগুলোতে যাদের অংশগ্রহণ দেখা যায় তারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই এ ধরনের কুকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। যা পরবর্তীতে কোনো এক পক্ষ জেদের বসে বা ব্যবসায়িক স্বার্থে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে, কখনো কখনো তৃতীয় কোনো পক্ষ এই সব দৃশ্য গোপনে ক্যামেরা বন্দি করে বাজারে ছাড়ছে। মোটকথা যেসব পর্নো ভিডিও ফুটেজ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তা বর্তমান প্রজন্মের চরম অবক্ষয়কেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
ফুটেজগুলোতে অংশ নেয়া ছেলেমেয়েরাও যেমন এ সমাজের অংশ। তেমনি যারা এর ক্রেতা তারাও এ সমাজেরই অংশ; এর সিংহভাগই আবার তরুণ প্রজন্ম। যারা স্বাধীনতার নামে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে বেলেল্লাপনার শেষ সীমা অতিক্রম করে চলেছে নিত্য। আমরা জেনেও এর প্রতিকারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করে বরং তাদের সহযোগিতাই করে চলেছি দায়িত্বজ্ঞানহীন অপদার্থের মতো। যে ছেলেটি তার মোবাইলে এই ভিডিও ফুটেজগুলো দেখে রাস্তায় বের হয় তার কাছে সামনে দিে েেহঁটে যাওয়া মেয়েটি আর ফুটেজে দেখা মেয়েটিকে একই মনে হবে এটাই স্বাভাবিক। আর তখন যে সে ওই মেয়েটিকে হেনস্তা করতে চাইবে; ইভটিজিং করবে এটাও কি স্বাভাবিক নয়? আমাদের নাটক-সিনেমার গানে তুমি-আমি ছাড়া কিছু নেই। মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেটাকে উসকে দিচ্ছে আরও। ভাবখানা এমন, যেন বন্ধু পাশে থাকলেই হলো আর কারো প্রয়োজন নেই, বন্ধুত্ব মানেই প্রেম। প্রেমের জন্যই জীবন, আর প্রেম মানেই বেলেল্লাপনা। জীবনের আর কোনো লক্ষ্যই নেই! ঠিক একইভাবে ইন্টারনেট মানেই ফেসবুক, ফেসবুক মানেই ফেক আইডি আর মিথ্যের ছড়াছড়ি! বন্ধুত্ব-প্রলোভন, প্রেম অতঃপর বাস্তবতার ঘাড়ে রক্তাক্ত অন্তর। এরপরে নেশা। বলে রাখা ভালো, ফেসবুকেও আছে জ্ঞানগর্ভ অনেক ভালো ভালো পাতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো তার পাঠক সংখ্য েেনহায়েতই নগণ্য।
অনলাইনের বিশাল তথ্যভান্ডারের ধারেকাছেও ঘেঁষে না বেশিরভাগ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। এমনকি বøগ সম্পর্কেও বেশিরভাগেরই ধারণা নেই। অথচ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার। এরা সারাদিন অনলাইনে কী করে? এ প্রশ্নের উত্তরই এই নিবন্ধের সারকথা। তারা যদি বøগ নিয়ে মেতে থাকত, মেধার অপচয় নয় চর্চায় মনোনিবেশ করত, তাহলে আজকের এই লেখার অবতারণাই হতো না। আজকের শিক্ষিত তরুণ যদি অনলাইনের বিশাল তথ্যভান্ডারের সাথে পরিচিতই না হতে পারে। যদি সেখান থেকে তারা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে না পারে। সর্বোপরি বিশ্ব পরিমন্ডলে নিজেদের সংযুক্তই করতে না পারে তাহলে তাদের অর্জিত শিক্ষাই যে এ দেশের জন্য বোঝা হয়ে দেখা দিবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
অবশ্য আমরা যদি তা অনুধাবনে সক্ষম হই। আমরা সহজ বিষয়টি কেন ভুলে যাই? অবুঝ শিশুকে যেমন মা-বাবা তথা তার অভিভাবকগণই একটি ভালো স্কুলের সাথে- একটি ভালো পরিবেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। নয়ত তার পক্ষে কখনোই নিজে থেকে ভালো পরিবেশ খুঁজে নেয়া সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি অনলাইন জগৎটাকে আপনার সন্তানের সম্মুখে খুলে দেয়ার ক্ষেত্রেও সঠিক পথটা বাতলে দেয়া কি আপনার কর্তব্য নয়? অনেক অভিভাবকের কাছেই শুনি; সন্তান অনলাইনে পড়াশুনা করে। অনলাইনের তথ্যভান্ডার আপনার সন্তানকে সমৃদ্ধ করছে এ তো খুবই ভালো কথা। কিন্তু নিজে কি কখনো তার কাছে বসে জানার চেষ্টা করেছেন সে আদৌ কতটা সমৃদ্ধ হচ্ছে, নাকি নিজেকেই ক্ষয় করে চলেছে দিনকে দিন। আর অনলাইনে লেখাপড়া করতে কেন বদ্ধ ঘরের প্রয়োজন সে প্রশ্নটাও আপনার সন্তানের কাছে করুন। দেখুন সদোত্তর মেলে কিনা। বর্তমান সময়ে নানা কারণেই আমরা আমাদের সন্তানদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেই; এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটাকে কেন মাল্টিমিডিয়া হতে হবে? এর সুফলটি কী, আর এর প্রয়োজনীয়তাই বা কী একটিবারও ভেবে দেখছি না।
আপনার কিশোর ছেলের হাতের মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ডটি ওপেন করুন। যা দেখছেন তা কি আপনি সমর্থন করেন? ইদানীং আরেকটি ভয়াবহ মানসিক রোগ দেখা দিয়েছে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে, তারা নিজেরাই নিছক আনন্দোচ্ছলে একে অপরের; এমনকি নিজেদের দেহের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশের ছবি তুলে বন্ধুদের এমএমএস করছে। এইসব ছবি এক সময় বেহাত হয়ে তারাই আবার এর দ্বারা বøাকমেইলের স্বীকার হচ্ছে। কিশোর-কিশোরীদের নির্মল আনন্দের স্থানগুলো দখল করে নিয়েছে এই সব ভায়োলেন্স। আমরা কতটা খোঁজ রাখছি আমাদের অন্দরের? আমাদের মগজে ধরেছে পচন তাই সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধান করতে পারছি না। নষ্ট হয়ে গেছি আমরা নিজেরাই। তাই সন্তানদের দিকে চোখ তুলে চাইতে পারি না। ফলে উচ্ছন্নে যাচ্ছে একটি প্রজন্ম। যারা নৈতিক অবক্ষয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে। এরাই কি একদিন আবার আমাদের ঘৃণা করবে না, অভিশাপ দিবে না, আমরা ওদের শেখাইনি বলে?
আধুনিক হয়ে ওঠার নামে অনৈতিকতার প্রকাশ গভীর প্রভাব রেখে চলেছে। সদ্য ধনী পরিবারগুলোর জীবনাচরণের দিকে তাকালে অবস্থা কিছুটা বোঝা যায়। এ অবস্থার প্রভাব মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজেও কম নয়। পরিবার আধুনিকতার টানে ছোট হোক বা পূর্ব হিসেবে বড় হোক, পরিবারে সন্তানদের সুস্থ মানসিক বিকাশ ও বড় হয়ে ওঠার দিকে নজর নেই বা থাকলেও তা যথাযথ পর্যায়ের নয়। যে জন্য ছেলে হোক, মেয়ে হোক সন্তান শিক্ষার্থী পর্বে প্রায়ই সঙ্গীদেও প্রভাবে বিপথে যায়। সুস্থ পারিবারিক প্রভাবই (মূলত মা-বাবার) এ অবস্থার যথাযথ প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতি এ বিষয়ে যথাযথ মাত্রায় মানোন্নত নয়। স্নেহ ও শাসনের ভারসাম্য শিশুর সুস্থ মানসিকতায় বেড়ে ওঠার পূর্বশর্ত এ কথা আমরা জানি, কিন্তু মানি না। অতি বিত্তবান ধনী-পুঁজিপতি পরিবারের বখাটে ছেলেমেয়ের কথা বাদ দিলেও মধ্যবিত্ত পরিবারেও এমনটা দেখা যায় এবং তা শৈশব-কৈশোর থেকে দেখভালের অভাবে। মা-বাবা যদি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, পরিবারের উঠতি সদস্যদের দেখভাল করা ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা যদি না থাকে, এর পরিণাম পরিবারের অল্পবয়সী সদস্যদের জন্য সর্বনাশের হয়ে উঠতে পারে। পরিবারে অপরিণত বয়সী সদস্যদের মধ্যে মাদকাসক্তির যে ব্যাপক বিস্তার, তার মূল কারণ পারিবারিক অবহেলা বা উদাসীনতা। অবশ্য ব্যতিক্রমী কারণ থাকতেই পারে।
এই অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মহীনতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরও কিছু বিষয়। ধর্মহীনতার সংস্কৃতি, ধর্মের অনুশীলন কখনোই ধর্মান্ধতা নির্দেশ করে না বরং ধর্মই পারে ধর্মান্ধতার অভিশাপ মুক্ত করতে। ধর্মই মানুষের জীবন প্রণালী অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা করেছে। মানুষকে সভ্য করেছে। আজ ধর্মকে ত্যাগ করে আমরা পুনরায় অসভ্য-বর্বরতার যুগেই ফিরে যাচ্ছি। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে আমরা ধর্মকে মনে করি এগিয়ে চলার পথের প্রধান অন্তরায়। ইতিহাস সাক্ষী দেয় প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতার খোঁজও মেলে না যেটি ধর্মহীনতাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে।
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বালাই নেই সমাজের কোথাও এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটিও দখল করে নিয়েছে ঈর্ষা আর স্বার্থের দ্বন্ধ যা আনন্দঘন একটি পরিবেশকেও করে তুলেছে রণক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রেও সন্তানরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশে সন্তান অস্বাভাবিক মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। সেইসাথে শিক্ষকের ব্যবসায়ী মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সুশাসনের অভাব, পারস্পরিক দূরত্ব বৃদ্ধি, দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সমাজে পেশিশক্তির প্রভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সর্বোপরি লাগামহীন অশ্লীলতাই আজকের তরুণ সমাজকে চরম অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই সর্বগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। সেই সাথে ধর্মীয় অনুশাসনের অনুশীলন, পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা সহ সর্বক্ষেত্রে অশ্লীলতাকে শুধু বর্জনই নয় প্রতিরোধ করা আজ আমাদের সকলের দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। যার শুরুটা হতে হবে গৃহাভ্যন্তর থেকেই। এটা সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, সামাজিক সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্রের সহযোগিতার হয়তো প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু মূল দায়িত্বটি পরিবার তথা সমাজকেই নিতে হয়। সন্তানকে সময় দিন। তাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। তার বন্ধুদের জানুন। তাকে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিন।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।