উপ-সম্পাদকীয়
হযরত ইবরাহীম (আ) মুসলমানদের জাতির পিতা। তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে পেশ করেন। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে দ্বীনে হানীফের প্রথম মুবাল্লিগ হিসেবে ঘোষনা দেন। পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। মুসলমান, ইহুদী ও খ্রষ্টান সকলেই তাকে নবী ও নেতা হিসেবে মানে। সাতজন নবী-রাসূল ছাড়া সকল নবী-রাসূল তাঁর বংশে প্রেরিত হয়েছেন। ফলে নবী-রাসূলদের মধ্যে তিনি স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ তা’য়ালা যাকে যত বেশী ভালবাসেন তার থেকে পরীক্ষাও নেন তত কঠিন। সমস্ত নবী-রাসূল কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। এ ধারাবাহিকতায় হযরত ইবরাহীম (আ) ও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- আর স্মরণ করো, যখন ইবরাহীমকে তাঁর রব কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করেন, তিনি ঐ সব পরীক্ষাকে পুরোপুরিভাবে আদায় করেছেন তথা পরীক্ষা সমূহে যথাযথ ভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে (সূরা বাকারা- ১২৪)।
হযরত ইবরাহীম- এর পরীক্ষাঃ আল্লাহ তা’য়ালা হযরত ইবরাহীম (আ) থেকে দু’ধরণের পরীক্ষা নিয়েছেন। ক. চরম ত্যাগ স্বীকারের পরীক্ষা খ. কর্মের পরীক্ষা। ক. ত্যাগ স্বীকারের পরীক্ষাঃ ত্যাগ স্বীকারের পরীক্ষা সমূহ হলো- ১. মুর্তিপুজার বিরুদ্ধে অবস্থান : হযরত ইবরাহীম (আ) যখন তাঁর পিতা, চাচা ও বংশের লোকদেরকে মূর্তি তৈরী করতে দেখলেন, তখন তাঁর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে- আপনারা যে সব জিনিসের পূজা করছেন, আমি তা থেকে পবিত্র, এর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমার সম্পর্ক সেই স্রষ্টার সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে হেদায়াত দান করবেন (সূরা যুখরুফ- ২৬-২৭)। আর এ কারণে নমরূদ তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করেন। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে অগ্নিকুন্ড থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহ তা’য়ালা আগুনকে বলেন- হে আগুন! ইবরাহীমের প্রতি শান্তিময় ঠান্ডা হয়ে যাও (সূরা আম্বিয়া- ৬৯)।
২. সিরিয়ায় হিজরতঃ হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশে নিজ বাসস্থান ও আপনজনকে ছেড়ে সিরিয়ায় হিজরত করেন। আপনজনদেরকে ছেড়ে যাওয়া খুবই কষ্টের। কিন্তু তিনি আল্লাহর নির্দেশকে সানন্দে মেনে নিয়েছেন। ৩. মক্কায় স্ত্রী-পুত্রকে নির্বাসনঃ হযরত ইবরাহীম (আ) এর আরেকটি কঠিন পরীক্ষা হলো- সিরিয়া থেকে এসে স্ত্রী হাজেরা ও শিশু পুত্র ইসমাঈলকে মক্কার জন-মানব শুন্য মরু প্রান্তরে নির্বাসন দেয়া। তিনি স্ত্রী-পুত্রকে রেখে যাওয়ার সময় এ দোআ করে ছিলেন- হে আমাদের পালনকর্তা! আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় রেখে যাচ্ছি, হে আমাদের পালনকর্তা, যাতে তারা নামায কায়েম রাখে। অতঃপর আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদেরকে ফলাদি দ্বারা রূযি দান করুন, সম্ভবত তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে (সূরা ইবরাহীম- ৩৭)।
৪. পুত্রকে কুরবাণীর নির্দেশঃ হযরত ইবরাহীম (আ) এর জন্য তখনই সবচেয়ে বড় ও কঠিন পরীক্ষা হয় যখন ইসলাম তাঁর হাতে তুলে দেয় ধারালো ছুরি, যেন তিনি প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে জবেহ করে আল্লাহ তা’য়ালা ব্যতীত অন্য সব কিছুকে কুরবান করে দেন। আর ইসলামই হযরত ইসমাঈল (আ) এর মস্তক অবনত করে দিয়েছিল, যেন তিনি আল্লাহ ত’য়ালার রাহে স্বীয় জীবন বিসর্জন দেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে আল্লাহর নামে জবেহ করছি, অতএব এ প্রসঙ্গে তোমার কি মত জানাও, হযরত ইসমাঈল (আ) (প্রত্যুত্তরে) বলেন, হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তা আপনি পালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলের অন্তর্গত পাবেন (সূরা আস সাফফাত- ১০২)। যখন পিতা-পুত্রকে জবেহ করার জন্য উদ্যত হলেন, তাকে মাটিতে শুয়ালেন, তখন এ কাজ ইসলামের হাতই করেছিল। ইসলামের শিক্ষার কারনেই হযরত ইসমাঈল (আ) নিজেকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেন।
হযরত ইবরাহীম (আ) এর অন্তরে একই সঙ্গে আল্লাহর প্রেম এবং পুত্রের প্রতি অনুরাগ অবস্থান করবে, আল্লাহ তা পছন্দ করেননি। এ ভাবেই হযরত ইসমাঈল (আ) এর অন্তরে স্বীয় প্রাণের মায়া বাসা বেঁধেছে দেখে তিনি তাও সহ্য করেননি। ফলে আল্লাহ তা’য়ালা এ আদেশ দেন- “সর্ব প্রথম প্রেমের স্থান অন্তরকে শুধু আমার জন্য খালি কর। অন্তরে শুধু আমারই প্রেম ও ভালবাসায় ভরপুর থাকবে। অন্য কেউ এখানে ভাগবসাতে পারবে না।” বিশ্ব প্রতিপালকের প্রেমের কি বৈশিষ্ট্য যে, প্রেমের পবিত্র গৃহের যাবতীয় সাজসজ্জা কেবল প্রেমিকদের তাজা রক্ত দ্বারাই করা হয়। পিতার হাতে ছুরি এজন্যই দেওয়া হয় যেন প্রাণাধিক পুত্রকেই কুরবান করে। আর পুত্রকেও এই নির্দেশ দেওয়া হয়- সানন্দে আত্মসমর্পণ কর, নিজকে বিলীন করে দাও এবং জবেহ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। এখানেই শেষ নয়, বরং জবেহ হবার দিনকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দোৎসবের দিনও নির্ধারণ করা হয়েছে।
খ. দ্বিতীয় প্রকারের পরীক্ষা ছিল আল্লাহর বিধি-নিষেধ পালন সংক্রান্ত। হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, বিধি-বিধান সংক্রান্ত হযরত ইবরাহীম (আ) এর পরীক্ষা ছিল ৩০টির বেশী। যা কুরআন মাজীদের সূরা তাওবা, সূরা মুমিনুন, সূরা আহযাব ও অন্যান্য সূরায় বর্ণিত আছে। যেমন- তাওবা করা, ইবাদত করা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, (দুনিয়ার সাথে) সম্পর্কে ছেদ করা, রোযা পালন করা, রুকু করা, সিজদা করা, সৎ কাজের আদেশ করা, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা, আল্লাহর সীমা সমূহের হেফাযত করা, নামাযে বিনম্র ও বিনয়ী হওয়া, অনর্থক কথা না বলা, যাকাত দেওয়া, যৌনাঙ্গ সংযত রাখা, আমানতের হেফাযত করা, অঙ্গীকার পুরন করা, নামাযে যত্নবান হওয়া, মুসলমান হওয়া, ঈমানদার হওয়া, অনুগত হওয়া, সত্যবাদী হওয়া, ধৈর্যশীল হওয়া, বিনয়ী হওয়া, দানশীল হওয়া, জবানের হেফাযত করা, আল্লাহর অধিক যিকর করা ইত্যাদি।
হযরত ইবন আব্বাস (রা) এর আরেক বর্ণনায় রয়েছে- পরীক্ষার অন্তর্ভূক্ত স্বাভাবগত কাজ ১০টি। পাঁচটি মাথায়, পাঁচটি সমস্ত শরীরে। মাথায় পাঁচটি হলো- ১. গোঁফ খাটো করা, ২. কুলি করা, ৩. নাক সাফ করা, ৪. মিসওয়াক করা, ৫. মাথার চুল দু’ভাগ করে আঁচড়ানো। শরীরে পাঁচটি হলো- ১. নখ কাটা, ২. নাভীর নীচের পশম মুন্ডানো, ৩. খতনা করা, ৪. বগলের পশম উপড়ে ফেলা, ৫. মলদ্বার ও মুত্রদ্বার পানি দ্বারা ধৌত করা (মুসলিম, তাফসীরে কুরতুয়ী ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং- ৭৪)।
হযরত ইবরাহীম (আ) ই প্রথম খতনা করেন, প্রথম মেহমানদারীর প্রথা চালু করেন, নাভীর নীচের পশম মন্ডন করেন, নখ কাটেন, চুল কাটেন, নাভীর নীচের পশম মুন্ডন করেন, নখ কাটেন, গোফ খাটো করেন এবং প্রথম তাঁরই চুল পাকে। (তাফসীরে কুরতুবী, হিদায়াতুল কুরআন ১ম খন্ড, ই. ফা. বাংলাদেশ, মুসলিম, মা’রিফুল কুরআন)
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাাসা, ফেনী