কিশান মোশাররফ :
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির দীর্ঘ ঐতিহ্য লালন করে কুমিল্লা। পাক ঔপনিবেশিক আমল কিংবা তারও শতাব্দী কাল আগ থেকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, পৌরানিক ও নৃতাত্ত্বিক শিল্পের বিকাশ এবং প্রসার, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান তথা মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব ও সমন্বয় আধুনিক শিল্প যাত্রা এমনই গুরুত্ব বহন করে কুমিল্লা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লায় অসংখ্য পথিকৃৎ মহামনিষীর জন্ম ও কর্ম গুণে গৌরবান্বিত পাদপীঠ। শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, সংগীত জগতের উজ্জ্বল দিকপাল শচীন দেব বর্মন, কবি সুফিয়া কামাল, বুদ্ধ দেব বসু, পল্লী উন্নয়ন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা আখকতার হাহিদ খান, সংগীত শিল্পী আপেল মাহমুদ, আসিফ আকবর, আলম আরা মিনু, একাধিক বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্প নির্দেশক, চিত্রশিল্পী উত্তম গুহ, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মহিলা নওয়াব, নারী শিক্ষার পথিকৃৎ, কবি ও সমাজসংস্কারক নওয়াব ফয়েজুন্নেসা চৌধুরানী। ১৯২১ সাল থেকে এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা কুমিল্লার খাদি ও বাটিক শিল্প।
শত সহস্রবর্ষের শিল্প সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মন্ডিত কুমিল্লার সাংস্কৃতিক অঙ্গন বিশেষ করে যাত্রা ও নাট্য শিল্পে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছিলো। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কুমিল্লার ঐতিহ্য লালনকরা যাত্র শিল্প হারিয়ে গেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনে গ্রæপ থিয়েটার নাট্যচর্চ্চা ও আন্দোলন যেভাবে গণজাগরণে ভূমিকা রেখেছিল, নতুন নতুন নাট্যদলের আত্ম প্রকাশ ঘটেছিল বিগত দেড় দশকে নাট্য চর্চ্চা বিকশিত হয়নি বরং ধ্বংস হয়েছে। রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন, গনতান্ত্রিক মত প্রকাশে বাধা, ক্ষমতাকেন্দ্রীক শ্রেণী শোষণবাদ এর জন্য দায়ী। এমনটাই মনে করেন সাংস্কৃতিক সুধীজন। এর মধ্যে অতিমারি করোনার থাবায় বিপর্যস্ত মধ্যভিত্ত, নিম্ন মধ্যভিত্ত ও নিম্নবিত্তের জনজীবন এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েন।
এতসব অস্থিরতার মধ্যে মফস্বল শহর কুমিল্লার একটি নাট্যদল ১০ দিন ব্যাপী নাট্য উৎসবের আয়োজন করে বসেছে। নাই কোনো স্পন্সর কিংবা কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষক চেইন। শুধু নাট্যপ্রেমী নাট্যসারথীদের আবেগ আর ভলোবসাকে পুঁজি করে এমন আয়োজন দুঃসাধ্যকে সাধন করার গৌর চেষ্টারই নামান্তর। কুমিল্লায় গ্রæপ থিয়েটার, গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন ও চর্চ্চার অন্যতম সংগঠন অধুনা থিয়েটার আয়োজন করেছে ১০দিনের জাতীয় নাটক উৎসব। এটি তাদের ৫ম নাট্য উৎসব। উৎসবে অধুনা থিয়েটারসহ কুমিল্লার অপর একটি দল, ঢাকার তিনটি নাটকের দল, চট্টগ্রাম, সিলেট, মানিকগঞ্জসহ ভারতের একটি নাট্য দল অংশগ্রহন করছে।
গত ৮ ফেব্রæয়ারি কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে এই নাট্য উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের পর বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রবীন নাট্যশিল্পী মোহাম্মদ হাশিম আপ্পু। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন যাত্রিক নাট্যগোষ্ঠীর সভাপতি অধ্যক্ষ হাসান ইমাম ফটিক, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ফারুক, কবি ও সংগঠক ফখরুল ইসলাম রচি, আইনজীবী নেতা এ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ও সৈয়দ নুরুর রহমান, উৎসব পরিচালক মঞ্জুরুল আজীম পলাশ, জেলা সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা আয়াজ মাবুদ। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এ্যাডভোকেট শহীদুল হক স্বপনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট ফারহানা ফেরদৌসী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মাজহার শিহাব। উদ্বোধনের পর একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। শিল্পকলা একাডেমি পার্শ্বস্থ উন্মুক্ত মঞ্চে চলে দলীয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ৮ ফেব্রæয়ারি উদ্বোধনী দিন সন্ধ্যায় শিল্পকলার মূল মঞ্চে প্রদর্শিত হয় কোলকাতা, ভারত থেকে আগত নাট্যদল ‘এলোকোয়েন্টকায়া’ নিবেদিত ২টি নাটক একটি মাছের গল্প এবং ব্যাধ।
প্রখ্যাত মূকাভিনয় শিল্পী সুশান্ত দাশ অভিনিত নাটক সমূহ উপস্থিত দর্শকশ্রোতারা চমৎকার ভাবে উপভোগ করেন। নাটক শেষে মঞ্চে অভিনেতা সুশান্ত দাশের হাতে উৎসব স্মারক ক্রেস্ট এবং উত্তরীয় তুলে দেন অধুনা থিয়েটারের সদস্যবৃন্দ। নাট্য উৎসব জমিয়ে রাখতে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নারী উদ্যোক্তা মেলার আয়োজন করা হয়। মেলা সমন্বয় করছেন নারী উদ্যোক্তা হালিমা খাতুন। উৎসবের চতুর্থ দিন অধুনা থিয়েটার মঞ্চে আনে ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে ড. তুহিন অবন্ত’র নাটক মলুয়া সুন্দরী। নাটকটির প্রধান নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করেন নাট্যকার নিজেই। সহযোগী নির্দেশক ছিলেন মাজহার শিহাব। উৎসব আয়োজনের ব্যস্ততার মধ্যে অধুনার পরিবেশনা ছিলো চমৎকার। কোরিওগ্রাফি, মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা সমগ্র নাটটিকে মাতিয়ে রেখেছিল নাটকের কলাকুশলীগণ। নাট্যাচার্য সেলিম আলদীনের শিষ্য ও স্নেহধন্য ড. তুহিন অবন্তকে অধুনার উৎসব উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানানো হয়।
কুমিল্লা সদর দক্ষিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশিস ঘোষ দর্শক উপস্থিতির দিকে নজর করে বলেন, নাটকের দর্শক বলতে নাটকের কলাকুশলী তাদের বন্ধু আত্মীয়-স্বজনের বাইরে তেমনটা দেখা যায়না। তাঁর কথার যতার্থতা পাওয়া গেছে মিলনায়তন প্রঙ্গনের মেলায় গিয়ে। নাটক শেষে রাত নয়টায়ও মেলায় দর্শনার্থীর ভিড় লক্ষ করা গেছে। মেলার ভিড় গলিয়ে নাটকে ততটা দর্শক আকৃষ্ট হয়েছে বলে মনে হয়নি। তবে উৎসাহ ব্যঞ্জক দর্শক উপস্থিতি নাট্য উৎসবকে জমিয়ে তুলেছে একথা বলতেই হয়। কথা হয় একজন নারী দর্শক জোবেদা আক্তারের সাথে।
তিনি বলেন, সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কতটা দুর্বল তা মিলনায়তনের চেহারার দিকে তাকালে বুঝা যায়। আধুনিক কোন মিলনায়তন কুমিল্লায় নেই। এখানে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য একটি মাত্র শৌচাগার। এসব কুমিল্লার ঐতিহ্যকে ¤øান করছে।
উৎসবে অংশগ্রহণকারী নাট্যদল ও তাদের পরিবেনা, ৮ ফেব্রয়ারি বুধবার ‘একটি মাছের গল্প/ব্যাধ’ এলোকোয়েন্ট কারা, কোলকাতা-ভারত, ৯ তারিখ কোথায় জলে মরাল চলে, নাট্যম রেপার্টরি থিয়েটার, ঢাকা, ১০ ফেব্রæয়ারি ‘খনা’ বটতলা, ঢাকা, ১১ ফেব্রæয়ারি ‘মলুয়া সুন্দরী অধুনা থিয়েটার, কুমিল্লা, ১২ ফেব্রæয়ারি ‘শান্তি’ যাত্রিক নাট্য গোষ্ঠী, কুমিল্ল, ১৩ ফেব্রæয়ারি ‘কহে বীরাঙ্গনা’ মনিপুরী থিয়েটার, মৌলভী বাজার, ১৪ ফেব্রæয়ারি অতি সাধারণ চিকিৎসক’ কথক নাট্য সম্প্রদায়, চট্টগ্রাম, ১৫ ফেব্রæয়ারি দেওয়ানা মদিনা’ প্রসূণ থিয়েটার, সিরাজগঞ্জ, ১৬ ফেব্রæয়ারি ‘জুঁই মালার সই মালা’ নিরাভরণ থিয়েটার, মানিকগঞ্জ এবং উৎসব সমাপনী দিন ১৭ ফেব্রæয়ারি শুক্রবার ঢাকা থিয়েটার পরিবেশন করবে নাটক ‘পঞ্চনারী আখ্যান’। এর মধ্যদিয়ে শেষ হবে অধুনা থিয়েটারের দশদিনের নাট্য উৎসব।