মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম :
দ্বীনি কাজে অতিরঞ্চন ও অতি শৈতিল্য প্রদর্শন কোনটাই ভাল নয় বরং মধ্যম পন্থা অবলম্বন করাই উত্তম। পবিত্র কুরআন ও হাদীস দ্বারা তা প্রতীয়মান হয়। মহানবী সা. একদা হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রা. কে বলেন হে আবদুল্লাহ! আমি কি খবর পাইনি যে, তুমি দিনে রোযা রাখ ও সারা রাত সালাত আদায় কর। আবদুল্লাহ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হ্যাঁ, আমি তাই করি। তখন মহানবী সা. বলেন, এরূপ করো না। কখে না রোযা রাখবে, কখনো ভঙ্গ করবে। রাতে নামাজ পড়বে আবার নিদ্রা যাবে। কেননা, তোমার উপর তোমার দেহের হক আছে, তোমার চোখের আছে, স্ত্রীর হক আছে। যে ব্যক্তি সারাজীবন রোযা রাখল সে মূলত রোযাই রাখেনি। প্রতি সাসে তিন দিন রোযা রাখা সারা বছরের রোযা রাখার সমতুল্য।
অতএব প্রতি চন্দ্রমাসের তের, চৌদ্দ ও পনের এ তিন দিন রোযা রাখবে এবং প্রতি মাসে মাসে এক বার কুরআন মাজীদ খতম করবে। হযরত আবদুল্লাহ রা. বলেন, আমি এর চেয়েও অধিক করার সামর্থ রাখি। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, তবে তুমি হযরত দাউদ আ. এর ন্যায় রোযা রাখ, তা উত্তম রোযা। তা’হলো একদিন রোযা রাখা এবং একদিন ভঙ্গ করা। আর সপ্তাহে একবার কুরআন খতম করো, এর অতিরিক্ত কিছু করতে যেও না (সহীহ বুখারী, ইবন মাজাহ)। হযরত সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস রা. বলেন, আমি বিদায় হজ্জের বছর মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন প্রিয় নবী সা. আমাকে দেখতে আসেন, আমি তখন আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার রোগের অবস্থা যে প্রচন্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে তা আপনিই দেখতে পাচ্ছেন। আমার অনেক সম্পদ আছে, অথচ আমার একমাত্র কন্যা ব্যতীত আর কোন উত্তরাধিকারী নেই। আমি কি আমার সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ দান করতে পারব। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, না। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তা’হলে অর্ধেক? তিনি বললেন, না! আমি আরয করলাম, তবে এক-তৃতীয়াংশ? তিনি বললেন, হ্যাঁ! এক তৃতীয়াংশ দান করতে পার, তবে তাও অনেক। তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদেরকে অন্যের কাছে হাত পাতার মত অবস্থায় রেখে যাবার চেয়ে সচ্ছল অবস্থায় রেখে যাওয়াই উত্তম (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)। রাসূলুল্লাহ্ধসঢ়; সা. আরো বলেন, তোমরা স্বীয় সামর্থ অনুযায়ী আমল কর। তোমরা আমলে বিরক্ত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ বিরক্ত হন না (সহীহ বুখারী, মিশকাত)। হযরত হুযায়ফা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, মানুষের জন্য সুসময়ে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা কতই না উত্তম, দুঃসময়ে ভারসাম্য বজায় রাখা কতই না উত্তম। আর ইবাদত-বন্দেগীতে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা কতই না সৌন্দর্যময় (মুসনাদ বাযযায, কানযুল উম্মাল)। মহানবী সা. অন্যত্র বলেন, নিশ্চয়ই দ্বীনি বিধি-বিধান সহজ-সাবলিল।
যে ব্যক্তি দ্বীনের ব্যাপারে কড়া-কড়ি আরোপ করবে দ্বীন তাকে পরাজিত করবে। সুতরাং তোমরা সহজ ও মধ্যম পš’া অবলম্বন কর, উত্তম প্রতিদানের সুসংবাদ গ্রহণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় রাত্রের কিছু অংশের আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর (সহীহ বুখারী, নাসাঈ)। মহানবী সা. এক বৃদ্ধকে তার দুই ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে পা হেঁচড়ে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করেন, এ ব্যক্তির কী হয়েছে? লোকেরা বলল, সে পায়ে হেঁটে আল্লাহর ঘর যিয়ারত করতে মনস্থ করেছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, এ ব্যক্তিকে কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করা থেকে আল্লাহ মুক্ত। মহানবী সা. তাকে তখন বাহনে আরোহণ করার নির্দেশ দেন (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। মহানবী সা হিজরতের পর আনসারী সাহাবী সালমান ও মুহাজির আবু দারদা রা. এর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। একদিন সালমান রা. আবু দারদা রা. এর গৃহে যান। অত:পর উম্মে দারদাকে (আবু দারদা আ. এর স্ত্রীকে) নিম্ন মানের পোষাকে দেখে বলেন আপনার এ অবস্থা কেন? উম্মে দারদা বলেন, আপনার ভ্রাতার পৃথিবীর প্রতি কোন আকর্ষণ নেই। অত:পর আবু দারদা বাড়ী আসেন। হযরত সালমান রা. এর জন্য খাদ্য আনা হলে তিনি হযরত আবু দারদা রা. কেও খেতে বলেন। হযরত আবু দরদা বলেন আমি রোযাদার হযরত সালামা রা. বলেন, আপনি না খেলে আমি খাব না। হযরত আবু দারদা রা. অগত্য রোযা ভঙ্গ করে খানা খান। যখন রাত হয়, তখন হযরত আবু দারদা রা. নফল নামায পড়ার জন্যে নিদ্রা থেকে উঠে যান হযরত সালামান রা. বলেন, শুয়ে পড়ুন। হযরত আবু দারদা রা. শুয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর আবার উঠলে সালমান রা. বলেন, নিদ্রা যান। রাত্রের শেষ ভাগে সালমান রা. বলেন, এখন উঠুন। অত:পর উভয়ে একত্রে নামায পড়েন। অত:পর হযরত সালমান রা. বলেন, আপনার কাছে আপনার প্রভূর হক আছে, নিজের হক আছে স্ত্রীর হক আছে। প্রত্যেকের হক পরিশোধ করুন। সকালে হযরত আবু দারদা রা. মহানবী সা. এর নিকট সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করেন। মহানবী সা. বলেন, সালমান সঠিক কথাই বলেছে (সহীহ বুখারী)।
হযরত মুজিবা বাহেলিয়া বলেন, তাঁর পিতা বা চাচা মহানবী সা. এর নিকট দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণের জন্য আসেন। অত:পর এক বছর পর পূণরায় রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট আসেন, তখন তাঁর স্বাস্থ্য খুবই দূর্বল ছিল। মহানবী সা. শরীরিক পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আপনার কাছ থেকে যাবার পর আমি দিনে আহার করিনি। সদা রোযা রেখেছি। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন তুমি নিজের প্রতি অবিচার করেছ (আবু দাউদ)। একদা মহানবী সা. এর আমল জানার জন্যে তাঁর গৃহে তিনজন সাহাবী আগমন করেন। রাসূলুল্লাহ সা. তখন গৃহে ছিলেন না। তাঁরা স্ত্রীদেরকে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন তাঁর ইবাদত প্রসঙ্গে জানার পর তা একেবারেই নগণ্য মনে করে। তারা মনে মনে বলে, রাসূলুল্লাহ সা. এর অপেক্ষা আমরা কোথায়? তাঁর পূর্বের ও পরের সব গুনাহ আল্লাহ তা’য়ালা ক্ষমা করে দিয়েছেন। “এরপর তাদের একজন বলল, আমি নফল নামাযে সারা রাত অতিবাহিত করব। অপরজন বলল, আমি সব সময় রোযা রাখব, দিনের বেলা কখনো পানাহার করব না। আর একজন বলল, আমি নারীদের এড়িয়ে চলব, কখনো বিয়ে করব না। রাসূলুল্লাহ সা. দূর থেকে তাদের কথা শুনে কাছে এসে বলেন, এসব কথা কি তোমরা বলছিলে? এরপর তিনি বলেন; শোন, আমি আল্লাহ্ধসঢ়;কে তোমাদের চেয়ে অধিক ভয় করি এবং তাঁর নাফরমানী থেকে অধিক পরিমাণে দূরে থাকি। অথচ আমি কখনো নফল রোযা রাখি, আবার কখনো ভঙ্গ করি। রাতে নামায আদায় করি, আবার নিদ্রা যাই। আর আমি বিবাহও করেছি। অতএব যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে উপেক্ষা করে, সে আমার কেউ নয় (সহীহ মুসলিম)।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।