সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে আল্লাহ তা’য়ালা স্বভাবের বৈচিত্র্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। উত্তম গুণাবলীর পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের এমন কিছু চারিত্রিক স্বভাব রয়েছে, যেগুলো খুবই নিকৃষ্ট ও অপছন্দনীয়। মানুষের এ স্বভাবগুলো ‘আখলাকে সায়্যিআ’ বা মন্দ স্বভাব হিসেবে পরিচিত। এ স্বভাবগুলোর ফলে মানুষের জীবনে অধঃপতন পরিলক্ষিত হয়। তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হল অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ বা রাগ। মানবিক আবেগের অংশবিশেষ রাগ কখনো অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। আর অনিয়ন্ত্রিত রাগ মারাত্মক ক্ষতিকারক। রাগের ফলে মানুষ আল্লাহর নিকট অপ্রিয় হয়ে উঠে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছেও যথাযথ মূল্য হারায়। তদুপরি মানুষ এই মন্দ স্বভাব অনিয়ন্ত্রিত রাগের কারণে দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। অনিয়ন্ত্রিত রাগ মানুষের হিতাহিত জ্ঞান কেড়ে নেয় এবং অন্যায় কাজে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিকে লজ্জিত হতে হয়। রাগের ফলে মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। ইসলাম মানুষকে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দিয়েছে। রাগ মানুষকে জ্ঞান, বিবেক ও ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত করে দেয়। রাগের কারণে মানুষের আচার-আচরণ ও চিন্তায় খারাপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই রাগান্বিত অবস্থায় ক্ষমা করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। বিশেষকরে কোনো ব্যক্তি যদি প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকার পরও প্রতিশোধ না নেয় এবং ক্ষমা করে দেয়, তাহলে তার এ কাজটি ইসলামের দৃষ্টিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘যারা স্বচ্ছলতা ও অস্বচ্ছলতা উভয় অবস্থায় ব্যয় করে, যারা রাগ করা সত্ত্বেও দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে দেয়। এধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন।’ (সুরা ইমরান, আয়াত (১৩৪) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে – ‘যখন তারা ক্রোধান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে দেয়।’ ( সুরা শুরা, আয়াত (৩৭) রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘ওই ব্যক্তি বীরপুরুষ নয়, যে অন্যকে ধরাশায়ী করে। বরং সেই প্রকৃত বীর, যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।’ (সহিহ বুখারী, হাদিস: ৬১১৪) পরিশুদ্ধ ব্যক্তিরা সব সময় অন্যের জন্য দু’আ করেন। মানুষকে সংশোধন করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানান। তাদের কথা হল, কোনো আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব আপনার ওপর রেগে থাকলে ক্ষুব্ধ লোকটির কাছে গিয়ে নম্রভাবে তাকে সান্ত্বনা দিন। তার ক্ষোভ উপশমের ব্যবস্থা করুন, যাতে সে শান্ত হয়। এমনটি করলে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিটির ক্ষোভ কমবে, তার কোনো ক্ষতি করার পরিকল্পনা থাকলে তা থেকে সরে আসবে। বস্তুত রাগ মানুষের জীবনকে সহজেই বিষাক্ত করে তুলতে পারে। রাগের মাথায় এমনসব কাজ ঘটে যেতে পারে যা ব্যক্তি, সমাজ তথা গোটা পৃথিবীর মারাত্মক ক্ষতির কারণ। তাই রাগ হলে ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রাজিম’ পড়ার পরামর্শ দিয়েছে ইসলাম। এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যখন তোমাদের কারো রাগ আসে, তখন সে দাড়িয়ে থাকলে যেন বসে পড়ে। তাতে যদি রাগ দমন না হয়, তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে। (তিরমিজি) অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, রাগ আসে শয়তানের পক্ষ হতে। শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুন নেভাতে প্রয়োজন হয় পানি। তাই যখন তোমরা রেগে যাবে, তখন অযু করে নেবে। (আবু দাউদ) অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রাগের সময় নিজেকে সামলে নিতে পারে, সে-ই প্রকৃত বাহাদুর। (সহিহ মুসলিম) আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, রাগ দেখানোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আল্লাহ তা’য়ালা তাকে কিয়ামতের দিন পুরস্কৃত করবেন। রাগ সম্পর্কে ইসলামের এমন অবস্থানের পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাগকে সঠিক বলে রায় দিয়েছে ইসলাম। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জুলুম ও বৈষম্য দূর করা এবং মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অপরাধী ও জুলুমবাজদের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে রাগ বৈধ। জাতীয়, ধর্মীয় ও মানবিক আদর্শ-মূল্যবোধ রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে রাগকে কাজে লাগাতে হয়। তবে অন্যায় দমন করতে গিয়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
লেখক: তরুণ কলম সৈনিক, শিক্ষার্থী, চরমোনাই আরবী বিশ্ববিদ্যালয় বরিশাল।