fenirshomoy logo black

মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা হোসেন

স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর অতিক্রম করছি। মাত্র কিছুদিন আগে সাড়ম্বরে উদযাপন করেছি ‘সুুুবর্ণ জয়ন্তী’। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উৎসবে সামিল হওয়া ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার। কেননা, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া অনেকে প্রয়াত হয়েছেন। যারা আছেন, তাঁরাও জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে অনেকে আবার রোগে-শোকে ভুগছেন, কিংবা চলৎশক্তিহীন হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। তবে জীবদ্দশায় বাংলাদেশের পরিবর্তন দেখতে পাওয়া সবার জন্য একটা বড় তৃপ্তি। বিশেষ করে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দুর্নাম ঘুচিয়ে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে চলেছে তা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি তাবৎ দুনিয়ার প্রশংসাও কুড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নিজস্ব অর্থব্যয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া, নানা বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে রাজধানীতে মেট্রোরেল চালু, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল এবং পাবনার ঈশ্বরদীতে রপƒপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প নির্মাণ কাজ অব্যাহত রেখে বাংলাদেশ শুধু নিজের সক্ষমতাই প্রমাণ দেয়নি, দেশকে মধ্যম সারিতে উন্নীত করার প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করেছে। বিষয়গুলো দেশপ্রেমিক সবার জন্য গর্বের। আর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সবার জন্য এটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি। তবে এতো আনন্দের মাঝেও রয়েছে বিষাদের ছায়া। এর অন্যতম উপসর্গ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস চর্চার অভাব। ঘৃণা, ক্ষোভ ও লজ্জার বিষয় হচ্ছে, স্বাধীন দেশে বাস করেও এখনো অনেকের মাঝে পরাধীনতার ‘অভাববোধ’ রয়েছে।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হচ্ছে আমাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এ স্বাধীনতা কোনো কুসুমাস্তীর্ণ পথে আসেনি। পাকিস্তানীদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৪ বছর আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই আন্দোলনে বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালিদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নস্যাত করে দিতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশে গণহত্যা চালায়। কিন্তু বাঙালিকে দমন করা যায়নি। বরং যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে শত্রæকে প্রতিরোধ করতে রুখে দাঁড়ায়। দীর্ঘ নয়মাস মরণপণ যুদ্ধ করে পাকিস্তানী বাহিনীকে পরাস্ত করেছে। ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। একাত্তরে এদেশীয় কিছু কুলাঙ্গার রাজাকার-আলবদর-আলশামস আর শান্তিবাহিনী করে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমর্থন যুগিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলেও তাদের মনোভাব পাল্টায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এখনও তারা ‘পাকিস্তান প্রেমে’ মশগুল।

এ অপশক্তির কারণেই যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রণয়নে পথে পথে বাধা হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। যেমন পাকিস্তান এখনো একাত্তরের পরাজয় মেনে নেয়নি। সে কারণে তাদের জনগোষ্ঠিকে প্রকৃত ইতিহাস জানতে দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে শিক্ষার্থীদের শিশুকাল থেকেই শেখানো হয় যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের একটি ‘অঙ্গ’ তারা হারিয়েছিল ভারতের ষড়যন্ত্রের কারণে। এখনো ১৬ ডিসেম্বরকে পাকিস্তানে স্মরণ করা হয় ‘ঢাকা পতন দিবস’ হিসেবে! অন্যদিকে বাংলাদেশে বসবাসকারী বর্ণচোরারা কিছুটা কৌশলী হয়ে ইতিহাস বিকৃতিতে বারবার অপচেষ্টা চালিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পরই এটি জোরেশোরে শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবার পর অপতৎপরতায় টান পড়লেও তা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এরই মাঝে বিস্ময়কর ঠেকে কতিপয় রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনের মন্তব্যে।


দেখা যায়, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী কিংবা সুশীল সমাজের কেউ কেউ একাত্তরের গণহত্যা বা নৃশংসতার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নাম উচ্চারণে লজ্জা বা সংকোচবোধ করেন। অনেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ‘পাক বাহিনী’ বলে সম্বাধন করেন। আর ‘পাক বাহিনী’ শব্দটি শুধু মুখে মুখে উচ্চারিত হয় না, অনেক লেখাতেও স্থান করে নিয়েছে। একাত্তরে যারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে জড়িত ছিলÑ তাদের ‘পাক বাহিনী’ বলার হেতু রহস্যময়। এমনকি শীর্ষ রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ “একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার ও তাদের দোসরদের” কর্মকান্ড নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিলেও কারা ‘হানাদার ও তাদের দোসর’ সেই ব্যাখ্যা দেননা। এতে করে বিভ্রান্তি যেমন বাড়ে, তেমনি নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃত দোষীরা আড়াল হয়ে যায়।

স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস প্রণয়নে এটি অন্যতম অন্তরায় হিসেবে বিবেচ্য। আগুন যেমন ছাই দিয়ে ধামাচাপা রাখা যায়না। তেমনি এটিও সত্যি যে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে। তারা এ দেশের মানুষের কাছে হানাদার বা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হিসেবে পরিচিত। আর তাদের দোসর বলতে এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী মানুষের গড়া কুখ্যাত রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীকে বোঝায়। কেনো শব্দের মারপ্যাঁচে এটি বিস্মৃত করা যাবে না। এ ব্যাপারে সবার সচেতনতাই নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে সহায়ক হবে।

লেখক : ডেপুটি ক্যাম্প চীফ, মুহুরী ইয়ুথ ট্রেনিং ক্যাম্প, ত্রিপুরা মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক, ফেনী জেলা আওয়ামী লীগ ও সভাপতি, খাজা আহমদ পরিষদ।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!