দৈনিক ফেনীর সময়

ইসি কি ইভিএম থেকে সরে যাবে, নাকি করেই ছাড়বে?

ইসি কি ইভিএম থেকে সরে যাবে, নাকি করেই ছাড়বে?

টাকা সমস্যা নয়, বিরোধীদলের আপত্তিও সমস্যা নয়; নিজস্ব সমস্যাতেই বরবাদ হতে বসেছে নির্বাচন কমিশনের ইলেক্ট্রনিক ভোট মেশিন-ইভিএম প্রজেক্ট। আর সেই সমস্যাটি হচ্ছে, ইসির নিজস্ব সক্ষমতার ঘাটতি। নিজেদের অক্ষমতা জানার পরও বিশাল এ কেনাকাটা যজ্ঞে হাল ছাড়েনি কমিশন। এগিয়েছে তুখোড় গতিতে। ৩’শ আসনে না পারলেও অন্তত দেড় আসনে এই মেশিনে আগামীতে ভোট নেয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি চলেছে। এখন অনেকটাই ভন্ডুলের অবস্থা। কারণ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক বৈঠকে প্রস্তাবটি উঠানোর অবস্থা নেই। বিষয়টি আকস্মিক নয়। কারো প্রতিবন্ধকতাও নয়। আগেই ঘোষণা ছিল- প্রকল্প অনুমোদন করাতে হবে মধ্য জানুয়ারির মধ্যেই। নইলে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়া সম্ভব হবে না।

তা’হলে এখন কী করবে ইসি? ইভিএম থেকে সরে যাবে? নাকি কোনো না কোনোভাবে তা করেই ছাড়বে? এসব প্রশ্নের এখনো স্পষ্ট জবাব নেই। আবার ইসির ভেতরগত এ অবস্থা কোনো অনুসন্ধানি সাংবাদিকতায় প্রাপ্ত নয়, তা বেরিয়ে এসেছে কমিশারদের কয়েকজনের মুখ থেকেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উপলক্ষে এ বিষয়ে তাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোর দিকে নজর দেয়া যেতে পারে।
‘ইভিএম প্রকল্প খুব একটা এগোচ্ছে বলে মনে হয় না। এটা আসলে খুব বেশি এগোয়নি’ মন্তব্যটি কমিশনার রাশেদা সুলতানার। এর কাছাকাছি সময়ে আরেকজন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বলেছেন, ইভিএম সংরক্ষণের পর্যাপ্ত জনবল নেই। ইভিএম যেভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, চার্জ দিতে হবে; তার (পর্যাপ্ত যোগ্য) জনবল আমাদের নেই।’

উপরোক্ত দু’জন কমশিনারের বক্তব্যে ইভিএম কার্যকরের প্রস্তুতির একটি চিত্র এমনিতেই ভেসে ওঠে। তার ওপর রয়েছে জটিলতাও। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণে ধীরগতির অভিযোগ পর্যালোচনা করেছে কমিশন। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।

সব মিলিয়ে ইভিএম বিষয়ক খবরাখবর মোটেও সুখকর নয়। যদিও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়ার পর খুব বড় গলায় এগোচ্ছিল এই ইভিএম। রীতিমত এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। বিরোধীমত থেকে বলা হয়েছে এটি ভোট চুরির মেশিন। সরকার এবং নির্বাচন কমিশন এ ধরনের রাজনৈতিক অভিযোগকে আমলে নেয়নি কখনোই।

সেইক্ষেত্রে অন্তত নির্বাচন বিষয়ক গবেষক- বিশ্লেষকদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে সমস্যা ছিল না। তারা বলে আসছিলেন নির্বাচন কমিশন এখনো ইভিএমে ভোট নেয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। সেই সামর্থ এখনো হয়নি। তারপর ভোটারদেরও অভ্যস্থ করে তোলার বিষয় রয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপে অধিকাংশই বিতর্ক থাকায় ইভিএমে ভোট না নেওয়ার পরামর্শ দেন। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং নির্বাচন নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোও ইভিএমের কারিগরি ত্রæটির কথা বলে আসছেন শুরু থেকেই।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ব্যবহূত ইভিএমে ভোটার ভেরিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি নেই। এর আগের বিভিন্ন নির্বাচনেও ইভিএমের বেশকিছু দুর্বল দিক ধরা পড়েছে। সর্বশেষ রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট নেওয়া কেন্দ্রগুলোয় ভোট গ্রহণে ধীরগতির অভিযোগ তুলেছেন বিজয়ী মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। এ ছাড়া, বয়স্ক ও নারী ভোটারদের অনেকের আঙ্গুলের ছাপ মিলছিল না। ইভিএমে ভোটারের পছন্দমতো প্রতীকে ভোট দিতে না পারার অভিযোগও ছিল অনেক। অধিকাংশ অভিযোগ ছিল, গোপন কক্ষে আগে থেকেই সরকারি দলের লোকজন অবস্থান নিয়ে থাকা। ভোটার নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে ব্যালট ওপেন করার পর গোপন কক্ষে থাকা ব্যক্তি আগেই বাটন চেপে দেয়ার মতো কেলেঙ্কারিও হয়েছে বহুবার।

তারপরও ইভিএম নিয়ে এমন বিতিকিচ্ছিরির মাঝেও থামেনি কমিশন। ত্রæটি সারানো বা সক্ষমতা অর্জনের চেয়ে তাদের বেশি ব্যস্ততা চলেছে কেনাকাটায়। ফলে এটা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মেশিন চালানোর সামর্থ অর্জন না করে প্রতিটির দাম ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা ধরে ইভিএম কিনতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার প্রকল্প তৈরিতে কমিশন কেন যারপরনাই ব্যস্ত এ প্রশ্নও উঠেছে সর্বত্র। অথচ এখন পুরো বিষয়টিই আটকে যাওয়ার অবস্থা। গণমাধ্যমের খবর: আগামী একনেক বৈঠকে অনুমোদনের তালিকায় ‘নির্বাচন ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এ ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্পটি তালিকায় নেই। তাহলে কী দাঁড়ালো অর্থটা?
আবার মেশিনের দামদস্তুর নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের দিক থেকেও আপত্তি এসেছে। আগে প্রতিটি ইভিএম সেট কেনা হয়েছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকা করে। বর্তমানে আগের দামের চেয়ে প্রতিটি মেশিনে ১ লাখ টাকা করে বেশি দাম ধরা হয়েছে। ইভিএম কিনতে মোট ৬ হাজার ৬৬০ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করার পাশাপাশি প্রস্তাবে চারটি জিপ গাড়ি এবং ৫৩৪টি ডাবল কেবিন পিকআপ কেনার কথাও আছে। এতে খরচ ধরা হয় ২৬২ কোটি টাকা। আর জমিসহ ১০টি ওয়্যারহাউস করতে খরচ ধরা হয় প্রায় ৭৭ কোটি টাকা। অন্যান্য সব সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে অনেক বেশি খরচ ধরার বিষয়টিতে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির খবরও প্রকাশ হয়ে গেছে। যা নির্বাচন কমিশনের মান-মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাদের আসল টার্গেট নির্বাচন না কেনাকাটা?-এ প্রশ্নকেও যৌক্তিক করে তুলেছে। নির্বাচন কমিশন জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছে। পরিকল্পনা কমিশনের প্রশ্ন স্পষ্ট। তাদের প্রশ্নের সারসংক্ষেপ হচ্ছে, দেশে এখন ব্যবহার করা ইভিএমগুলো কেনা হয় ২০১৮ সালে। তখন প্রতিটির দাম পড়েছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। তখন ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দাম ছিল ১৭ হাজার রুপি।

দামের এ বিশাল পার্থক্যকে অতি অস্বাভাবিক বলেছে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। এর বিপরীতে ইসি বলছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় ইভিএমে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। দেশের ইভিএমে বায়োমেট্রিক যাচাইয়ের মাধ্যমে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত করার ব্যবস্থা আছে, যা ভারতের ইভিএমে নেই। অন্যদিকে ভারতের ইভিএমে ভিভিপিএটি, ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন সেটিসহ একটি কাগজ বের হয়ে আসে যা আমাদের ইভিএমে নেই। এর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ইসির জন্য ইভিএম তৈরি করেছিল। তখন প্রতিটির দাম পড়েছিল ২০-২২ হাজার টাকা। অতীতে ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইভিএম কেনাকাটায় তখন বাণিজ্য ও নিয়ম না মানার অভিযোগ উঠেছিল। তখন তা অগ্রাহ্য হলেও এই পরকিল্পনা কমিশন প্রশ্ন তোলায় আরেকটা প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে। আশপাশে আরো নানান কথাও রয়েছে। সেইসঙ্গে এই মেশিন চালানোর সক্ষমতার বিষয়টি এতাদিন এভাবে আড়ালে রেখে এখন স্বীকার ও প্রচার করে আরো জটিলতা ও ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছে।

প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে ইসির সাম্প্রতিক বৈঠকে তেমন কোনো বুদ্ধি আসেনি। এসেছে মাছামাঝি কিছু অস্পষ্ট কথা। ইসির সঙ্গে বৈঠকটির পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ইসির অত্যন্ত সুন্দর একটা ডাটাবেজ আছে। এটি দিয়ে ১৮ বছরের নিচে যারা আছে তাদের তথ্য নেওয়া হচ্ছে। অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, ‘কো-অর্ডিনেশনে আমরা মোটেই ভালো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হায়দার আলী কোনো বুদ্ধি না বাতলালেও বলেছেন, সিদ্ধান্ত কমিশন বা সরকার নেবে। এনআইডির তথ্য কমিশনের কাছে বা সরকারের কাছে থাকার রকমফেরও এসেছে তার বক্তব্যে। বুয়েটের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘এনআইডির তথ্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, সেই গুরুত্ব রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মাঝামাঝি বক্তব্যেরও মাঝামাঝি বক্তব্য নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানার। তার মতে,‘এনআইডি নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকা না থাকা নিয়ে কোনো সংকট নেই।

আসলে কি তাই? এতে সংকটের সঙ্গে প্রশ্ন কি আরো বাড়লো না? জটিলতা তো বেড়েছেই। তবে কবে নাগাদ প্রকল্পটি একনেকে যেতে পারে, সে বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে গেল। তবে এতে নির্বাচন বা ভোটকে অনিশ্চিত না করলেই হয়। চলতি বছরের শেষ কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট না করে হোক, বিদ্যমান সামর্থদৃষ্টে ৬০টিতেই হোক, আবার আগের মতো ম্যানুয়েলে হাতের ভোটেই হোক মানুষ কিন্তু উদগ্রিব একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ নির্বাচনের জন্য। ভোটের বদলে মেশিন নিয়ে এতো কথামালা ভোটপাগলদের তেঁতো করে নির্বাচনের মাঠটিকে যেন আর কর্দমাক্ত না করে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!