দৈনিক ফেনীর সময়

আকাশে জীবন্ত উত্থিত নবীদ্বয়

আকাশে জীবন্ত উত্থিত নবীদ্বয়

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

নবীগণ হলেন আল্লাহ তা’য়ালার মনোনীত ব্যক্তি। যাকে আল্লাহ বাছাই করেন তিনিই নবী হতে পারেন। স্বেচ্ছায় বা সাধনা করে কেউ নবী হতে পারেন না। তাঁদের সঠিক সংখ্যা আল্লাহই অধিক জ্ঞাত। সকল নবী-রাসূলই উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। তাদের মধ্যে দু’জন নবীকে জীবন্ত আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।
হযরত ইদরিস আ: তিনি ছিলেন হযরত নূহ আ. এর প্রপিতামহ এবং হযরত শীশ আ. এর দৌহিত্র। তাঁর আরেক নাম ছিল আখনুখ। অধিক অধ্যয়নপ্রিয় ছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছে ইদরিস।

তার প্রতি ৩০টি সহীফা নাযিল করা হয়। ইমাম বগবী বলেন, হযরত ইদরিস প্রথম কলম দ্বারা লিখার প্রচলন করেন এবং চামড়ার পোশাকের পরিবর্তে কাপড় পরিধান করার প্রথা চালু করেন। তিনি প্রথম যুদ্ধাস্ত্র এবং তা দিয়ে দ্বীনের শত্রæদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাছাড়া তিনি জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত শাস্ত্রের আবিষ্কার করেন। আল্লাহ তা’য়ালা তার সম্পর্কে বলেছেন- এ কিতাবে উল্লেখিত ইদরিসের কথা স্মরণ কর, সে ছিল সত্যবাদী, নবী এবং আমি তাকে দান করেছি উচ্চ মর্যাদা (সূরা মরিয়ম- ৫৬, ৫৭)।

হযরত কাব আহবার প্রমূখ বর্ণনা করেছেন, একদা হযরত ইদরিস প্রখর রোদের মধ্যে সারাদিন পথ চলেন। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে বললেন, হে প্রভু! একদিন পথ চলতেই আমি এতো ক্লান্ত হয়ে পড়লাম, কিন্তু যেদিন সকলে পাঁচশত বছরের পথ অতিক্রম করতে বাধ্য হবে, সেদিন তাদের কি দুরাবস্থাই না হবে। তাই আপনার নিকট আমার একান্ত প্রার্থনা। আপনি সূর্যের উত্তাপ কিছুটা স্তিমিত করে দিন। পরদিন সকালে সূর্য পরিচালনকারী ফেরেশতা সূর্যের উত্তাপ অনেকটা স্তিমিত অনুভব করেন। ফেরেশতা আল্লাহ তা’য়ালাকে জিজ্ঞেস করেন, হে প্রভু! আজ সূর্যের উত্তাপ স্তিমিত হওয়ার কারণ কি? আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, আমার এক বান্দার প্রার্থনার কারণে এরূপ করেছি। ফেরেশতা বলেন, হে প্রভু! আপনি আপনার এ বান্দাহকে আমার বন্ধু বানিয়ে দিন। আল্লাহ তা’য়ালা ফেরেশতাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। অতঃপর ফেরেশতা হযরত ইদরিস আ. এর নিকট উপস্থিত হন। হযরত ইদরিস আ. তাঁর পরিচয় পেয়ে বলেন, আমি জানি আপনি একজন সম্মানিত ফেরেশতা। মৃত্যুর দায়িত্বশীল ফেরেশতা আপনাকে খুবই সমীহ করেন। আপনি তাঁকে বলুন তিনি যেন আমার মৃত্যুর সময় কিছুটা পিছিয়ে দেন। যাতে আমি বেশি ইবাদত করার সময় পাই। ফেরেশতা বলেন, মৃত্যুর সময় তো নির্দিষ্ট। তারপরও আপনার কথা হযরত আজরাঈল আ. কে বলবো। তারপর সূর্যের দায়িত্বশীল ফেরেশতা হযরত ইদরিস আ. কে আকাশে উঠিয়ে নেন। সূর্যের কাছাকাছি এক স্থানে তাঁকে দাঁড় করিয়ে রেখে হযরত আজরাঈল আ. এর নিকট গিয়ে বলেন- আদম সন্তানের মধ্যে আমার এক বন্ধু আছে। সে তার মৃত্যুর সময় কিছুটা পিছিয়ে দেয়ার জন্য আপনার কাছে সুপারিশ করতে বলেছে। হযরত আজরাঈল আ. বলেন- এরকম করার ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমি তার মৃত্যু লগ্নের কথা পূর্বাহ্নে জানিয়ে দিতে পারি। এর ফলে সে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে। এ কথা বলে হযরত আজরাঈল আ. মৃত্যুর তারিখের দপ্তর খুলে বসেন। তারপর বলেন- আপনি এমন এক লোকের কথা বলেছেন যার মৃত্যুর কোন তারিখ আমার দপ্তরে লেখা নেই। তার মৃত্যু পৃথিবীতে হবে না বরং তার মৃত্যু হবে আকাশে। সুতরাং আপনি গিয়ে দেখুন, তিনি আর জীবিত নেই। তখন ফেরেশতা হযরত ইদরিস আ. এর নিকট গিয়ে দেখেন সত্যিই তিনি মৃত।

ওহাব ইবনে মুনাব্বাহ আরো বলেন, হযরত ইদরিস আ. ছিলেন অধিক ইবাদত গুজার বান্দাহ। তার সময়ের সকল বিশ্বাসীর সমপরিমাণ ইবাদত তিনি একাই করতেন। ফেরেশতা তাঁর ইবাদতের কথা শুনে আশ্চর্য হন এবং কৌতুহলী হয়ে একদা মৃত্যুর ফেরেশতা তার সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি নিয়মিত রোজ রাখতেন। তাই ইফতারের সময় মানবরূপী ফেরেশতা মেহমানকে যথারীতি ইফতার করতে বলেন। কিন্তু মেহমান তার ডাকে সাড়া দেন নি। তিন দিন ক্রমান্বয়ে এরূপ করা হয়। অবশেষে হযরত ইদরিস আ. জানতে চান হে প্রিয় অতিথি! আপনার পরিচয় কি? তখন মেহমান বলেন- আমি মৃত্যুর ফেরেশতা! আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি আপনার সঙ্গলাভের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত হয়েছি। হজরত ইদরিস বললেন, তবে আমার একটি কাজ করে দিন। অতিথি বললেন, কি কাজ? হজরত ইদরিস বললেন, আমার প্রাণ হরণ করুন। আল্লাহর হুকুমে মৃত্যুর ফেরেশতা তাঁর জান কবজ করেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আল্লাহর হুকুমে তিনি আবার জীবিত হয়ে উঠেন। অতিথি বললেন, এরকম ঘটলো কেনো? হজরত ইদরিস বললেন, আমি মৃত্যুর স্বাদ পেতে চেয়েছিলাম। মৃত্যুবরণ করা আমার উদ্দেশ্য ছিলো না। আল্লাহ্ আমার ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন। এখন আমি যথাসময়ে মৃত্যুবরণ করার যথাপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারবো। কারণ মৃত্যুর স্মৃতি আমার স্মরণপটে সদা জাগরূক থাকবে। এখন আপনি আমার আরেকটি কাজ করে দিন। আমাকে আকাশে নিয়ে চলুন এবং বেহেশত ও দোজখ দেখিয়ে দিন । মৃত্যুর ফেরেশতা এবারও অনুমতি প্রাপ্ত হলেন এবং হজরত ইদরিসকে নিয়ে প্রথমে দোজখের দ্বারপ্রান্তে যান। হজরত ইদরিস বললেন, দোজখের প্রধান প্রহরীকে বলে দরজা খোলার ব্যবস্থা করুন। তাই করা হলো। হজরত ইদরিস ভালো করে দোজখের অভ্যন্তর ভাগ দেখে নিলেন। তারপর বললেন, দোজখ তো দেখলাম। এবার আমাকে নিয়ে বেহেশতে চলুন। মৃত্যুর ফেরেশতা তাঁকে নিয়ে বেহেশতে উপস্থিত হলেন। আল্লাহর নির্দেশে ও তাঁর অনুরোধে বেহেশতের দরজাও খুলে দেয়া হলো। হজরত ইদরিস ঘুরে ঘুরে বেহেশতের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে লাগলেন । মৃত্যুর ফেরেশতা বললেন, এবার ফিরে চলুন। হজরত ইদরিস একটি বৃক্ষের ডাল আঁকড়ে ধরে বললেন, আমি এখান থেকে আদৌ যাবো না। আল্লাহর নির্দেশে তখন সেখানে আর একজন ফেরেশতা উপস্থিত হয়ে বললেন, আপনি ফিরে যেতে রাজি হচ্ছেন না কেনো? হজরত ইদরিস বললেন, আল্লাহ্ বলেছেন, সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমি তা আস্বাদন করেছি। আল্লাহ্ আরো বলেছেন, সকলকেই দোজখ দেখানো হবে। তাও আমি অবলোকন করেছি। তিনি একথাও বলেছেন যে, বেহেশতে প্রবেশকারীরা আর কখনো বহিষ্কৃত হবে না। আমি তো সেই জান্নাতেই প্রবেশ করেছি। সুতরাং আমি এখান থেকে বের হবো কেনো? আল্লাহ্ তখন মৃত্যুর ফেরেশতাকে বললেন, আমার অনুমতিক্রমেই তো সে বেহেশতে প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে বের হতে হলে আমার অনুমতিক্রমেই তা হবে। তোমাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আর কোনো চেষ্টা কোরো না। এভাবেই হজরত ইদরিস আ. এক ব্যতিক্রমী উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেন (তাফসীরে মাযহারী, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৯৬)। ওহাব ইবন মুনাব্বাহ অন্যত্র বলেছেন, হযরত ইদরিস আ. আকাশে জীবিত অবস্থায় আছেন না মৃত অবস্থায় এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একদল মনীষীর মতে তিনি আকাশে জীবিত অবস্থায় আছেন।

হযরত ঈসা আ: তাফসীরের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, একদল ইহুদী হযরত ঈসা আ. এবং তাঁর পুত-পবিত্রা জননীকে গালি দিলো। তিনি তখন তাদের জন্য বদদোয়া করেন। তাঁর বদদেয়ায়ার ফলে আল্লাহ তায়ালা গালিদাতাদেরকে বানর ও শুকরে পরিণত করে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শক্রমে এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, হযরত ঈসা আ. কে হত্যা করতে হবে। আল্লাহ্পাক তখন হযরত ঈসা আ. কে ওহির মাধ্যমে জানালেন যে, তোমাকে আকাশে উচিয়ে নেয়া হবে। আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেছেন- তারা তাকে হত্যা করেনি ও ক্রুসবিদ্ধও করে নি। তবে তারা সন্দেহে পতিত হয়েছে (সূরা নিসা-১৫৭)। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত ঈসা আ. তাঁর সহচরবৃন্দকে বললেন- তোমাদের মধ্যে কেউ আছো কি আমার আকৃতি বিশিষ্ট হতে চাও? যাকে ইহুদীরা শূলে চড়াবে এবং সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। একজন দাঁড়িয়ে বললো- আমি চাই। তখন আল্লাহ তায়ালা তার আকৃতি হযরত ঈসা আ.-এর আকৃতির মতো করে দেন। এ ব্যক্তিকেই ইহুদীরা শূলে চড়িয়ে হত্যা করে। ইমাম বাগবী বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা এই ব্যক্তিকে হযরত ঈসা আ.-এর আকৃতি বিশিষ্ট করে দেন। ইহুদীরা তাকেই হযরত ঈসা আ. মনে করে ক্রুশবিদ্ধ করে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে- ইহুদীদের নেতা ইয়াহুদা হযরত ঈসা রা. কে হত্যার জন্য এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করে। তার নাম ছিলো তাতিয়ানুস। সে হত্যার উদ্দেশ্যে যখন হযরত ঈসা আ.-এর গৃহে প্রবেশ করলো। তৎক্ষনাৎ আল্লাহ তায়ালা হযরত ঈসাকে আকাশে উঠিয়ে নেন। আর তাতিয়ানুসের চেহারা অবিকল হযরত ঈসার মতো হয়ে যায়। সে ঘর থেকে বের হয়ে এলে অপেক্ষমান ইহুদীরা তাকেই হযরত ঈসা মনে করে প্রথমে বন্দী করে তারপর শূলে চড়ায়। কেউ কেউ বলেছেন- ইহুদীরা হযরত ঈসা আ. কে একটি ঘরে বন্দী করে রাখে এবং তার জন্য একজন পাহারাদার নিযুক্ত করে। আল্লাহ তায়ালা পাহারাদারের চেহারাকে হযরত ঈসা আ. -এর চেহারার মতো করে দেন। ইহুদীরা তাকে হযরত ঈসা আ. ভেবে হত্যা করে। অথচ আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আকাশে উঠিয়ে নেন।

হযরত ঈসা আ.-এর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া নিয়ে ইহুদীদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। কালাবী বলেছেন- ইহুদীরা বলে, আমরা ঈসাকে হত্যা করেছি। খ্রীষ্টানেরা বলে তাকে আমরা হত্যা করেছি। (তাফসীরে মাযহারী, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৯৪)।

লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!