মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার
নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ বিধ্বস্তে স্বামী মারা যাওয়ার পর বলেছিলেন যা হারিয়েছি তা অপূরণীয়। কোনো কিছুতে তা আর পূরণ হওয়ার নয়। বেঁচে থাকাটা তাই হয়তো নিরর্থক হয়ে উঠেছিল আকষ্মিক দুর্ঘটনায় প্রিয়তমকে হারানো আফসানার জন্য।
শুভ্র মেঘ ছুঁয়ে এসে নেপালের ত্রিভুবন আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হওয়া ফ্লাইটের ৫০ যাত্রী ও ক্রুর সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান। বিমানে ৭১ জন আরোহী নিয়ে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে রওনা করেন পাইলট আবিদ। বিমানটি কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়। এতে বিমানে থাকা ৫১ জন নিহত হন। বিমান কতৃপক্ষও দাবি করেছে আবিদেও কোন দোষ ছিলনা। বরং ত্রিভুবন বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম থেকে পাইলট আবিদকে বিভ্রান্তিমূলক নির্দেশনা দেয়া হয়।
দুর্ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই হৃদযরেন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় আফসানার। এরপর থেকে চিকিৎসাধীন ছিলেন রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালে।
বিমান দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের জন্য একদিকে সারাদেশে যখন চলছিল শোক, তখন হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিলেন আফসানা। আফসানার অবস্থার উন্নতি হয়েছে- স্বজনরা এমন খবরের অপেক্ষায় থাকলেও ভালো খবর দিতে পারছিলেন না চিকিৎসকরা। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের যুগ্ম-পরিচালক বলেছিলেন, ক্যাপ্টেন আবিদের স্ত্রী বেঁচে আছেন। তবে তার অবস্থা সঙ্কটপূর্ণ। তবে তার কিডনি, হার্ট লিভার সব সচল রয়েছে। তার রক্ত চাপ ১২০-৮০। কিন্তু তার ব্রেন স্বাভাবিক রেসপন্স করছে না। যন্ত্রের সাহায্যে তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে।
একদিন পর তিনি আরও ভয়ঙ্কর খবর জানান। বলেন, আফসানার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। তার কিডনি সঞ্চালন কম করছে। রক্তচাপও কমে গেছে। উন্নত যা চিকিৎসা দেশেই সম্ভব। বিদেশে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থাতেও নেই।
এরপর শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টায় এল সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত খবরটি। এই পৃথিবী ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন আফসানা। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার দেওয়ার মত শোকের সাগর আরও কয়েক ফোঁটা জল দিয়ে উত্তাল করে দিলেন আফসানা। সেই অধ্যাপকই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আফসানার মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ভিড় করেছেন তার স্বজনরা।
প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের আদর্শ ব্যবধান হওয়া উচিত ৩ বছরের কম। সাধারণত মেয়েরা মনের দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে একটু আগেই পরিপক্কতা লাভ করে। আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মানসিক মিল থাকাটা জরুরি। তাই মনে করা হয় যে, স্বামী যদি স্ত্রীর চেয়ে ৩ বছরের বড় হয় তবে দুদজনের মানসিক পরিপক্কতা সমান হবে। তা ছাড়া, ৩ বছর বড় হলে স্বামী একটু আগে পড়ালেখা শেষ করে কোনো একটা পেশা বেছে নেবে এবং নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার সময় পাবে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, কিশোর বয়সে মেয়েদের মানসিক বিকাশ ছেলেদের তুলনায় দ্রুত হয়। কিন্তু ২০ ৩০ বছর সময়কালটায় এ ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না।
আমাদের সমাজে অধিকাংশ ছেলেরা নিজের চেয়ে ১০-১৫ বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করে। কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে করার প্রবণতাও ছেলেদের মাঝে প্রকট ভাবে দেখা যায়। এতে দু’জনের মধ্যে ভুল বোঝার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। দাম্পত্য জীবনে কলহ ও সম্পর্ক ভাঙ্গার অন্যতম প্রধান কারণও এটি। কারন জীবনসঙ্গী সমবয়সী হলেই তার সঙ্গীর প্রতি সহনশীল হয়। শেষ বয়সে এসেও বিপাকে পড়তে হয় চরমভাবে। অন্যদিকে বার্ধক্যকালিন স্বামীর অতিরিক্ত চাহিদাগুলোর প্রতি অসহ্য হয়ে তার যোগান দিতে ব্যর্থ হন স্ত্রী।
একপর্যায়ে স্বামী ইহলোক ত্যাগ করলে স্ত্রীকে ভোগ করতে হয় সঙ্গী হারিয়ে একাকিত্বের মহা যন্ত্রণা। শোক, নিসঙ্গতা ও আরও অন্যার জীবনাচরণের শূণ্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠে সে নারীর জীবন। কোন কোন ক্ষেত্রে এর পরিণতি হয় আরও ভয়ঙ্কর, অপবাদের স্বীকার হয়ে সে নারীকে হয়ে যেতে হয় রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি।
জীবন মৃত্যু নিয়ন্ত্রণের দন্ড অপ্রতিরোধ্য মাহাশক্তির হাতে হলেও স্বাভাবিক ভাবে দু’জন সমান বয়সী হলে পুরো জীবন অতিবাহিত হয় সমান্তরাল ভাবে। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করার সম্ভাবনাও থাকে কাছাকাছি সময়ে। সেক্ষেত্রে সমান্তরাল গতিতে অতিবাহিত হয় উভয়ের জীবন। আনন্দ, বেদনা, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার উত্থান-পতন হয় একসঙ্গে। সুতরাং আফসানারাই ভাগ্যবতী, দু’পারেই হয়ে যায় তাদের নিসঙ্গতার নিরসন।
লেখক : প্রধান প্রতিবেদক, প্রতিষিদ্ধ।