দৈনিক ফেনীর সময়

আঞ্চলিক ভাষা প্রসঙ্গে

আঞ্চলিক ভাষা প্রসঙ্গে

আবু হেনা আবদুল আউয়াল

মানভাষার বাইরে কিন্তু মানভাষার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত আঞ্চলিক ভাষা মানভাষা কৃত্রিম, কষ্টসাধ্য, কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা স্বত:স্ফুর্ত ও সহজসাধ্য মানভাষা সর্বজনীন সকলের কাছে সমান বোধগম্য। তাই মানভাষা হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে যোগাযোগের ও জ্ঞান চর্চার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। আঞ্চলিক ভাষা অঞ্চল বিশেষে দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত ভাষা।

প্রতিটি ভাষাভাষী গোষ্ঠীর একটি মানভাষা ও এবটি আঞ্চলিক ভাষা আছে মানভাষার বিকৃত রূপের উচ্চারণ, সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ, সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বিশেষের জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা উৎপাদন প্রক্রিয়া, উৎপাদন সম্পর্কে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বিশেষের আবহাওয়া, প্রকৃতি, লোক সমাজের ঐতিহ্য, নীতিগত উপাদান প্রভৃতি আঞ্চলিক মানভাষার প্রধান কারণ। প্রতি পনের বিশ মাইল পরপর ভাষার উ”চারণ রূপের কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। এ ভাবে দূরত্ব যত বাড়বে ভাষার উচ্চারণ রূপের পার্থক্য তত বেশী স্পষ্ট হবে। শুধু উচ্চারণরূপই নয়, বস্তুর নামেরও পরিবর্তন ঘটে থাকে। ভাষা বিজ্ঞানীরা আঞ্চলিক ভাষাকে উপ ভাষা বলেছেন তাঁদের মতে আঞ্চলিক ভাষা হচ্ছে মূল মানভাভার উপরূপ বা বিকৃত ভিন্নরূপ।

বাংলাদেশ যেন আঞ্চলিক ভাষার ঘনি মূল বাংলা ভাষা বিভিন্ন ভাষার মিশ্রন সংমিশ্রণে একটি সংকর ভাষা। আঞ্চলিক ভাষা মূল ভাষার চেয়ে আরো বেশি মিশ্রিত সংকর ভাষা। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নানা কারনে এসেছে, থেকেছে আবার কেউ কেউ চলেও গিয়েছে। এর ফলে মূল মানভাষার চেয়ে আঞ্চলিক ভাষা বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। কারন, মানভাষা শব্দ গ্রহনে বাছবিচার করা হয়, অন্য পক্ষে আঞ্চলিক ভাষা তা করা হয় না। যেমন- ভইন, ভঁইশ, তরাগু, কুত্তা, কাউয়া, কেলা ইত্যাদি অনেক শব্দ বিদেশী ভাষা থেকে এসছে আঞ্চলিক ভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব শব্দের মানরূপ হচ্ছে : বোন, মহিষ, পাল্লা, কুকুর, কাক, কলা। বহুল ব্যবহারে বিদেশ আগত কিছু শব্দ কিছুটা বিকৃত হয়ে আঞ্চলিক রূপ নিয়ে মান বাংলা ভাষা এভাবে ঢুকে গেছে যে, সে গুলো যে আঞ্চলিক শব্দ তা টেরই পাওয়া যায় না। যেমন- জেলা নোয়াখালীর ‘নোয়া’ শব্দটির কথা উল্লেখ করা যায়: ফার্সী ‘নও’ শব্দ থেকে উর্দুতে এসে শব্দটি হয়েছে ‘নয়া’ আর ভুলুয়া অঞ্চলে এসে ‘নয়া’ শব্দটি হয়ে গেছে ‘নোয়া’, আঞ্চলিক উচ্চারণে। এ আঞ্চলিক উচ্চারণরূপটি গৃহীত হয়েছে নোয়াখালী জেলার নামকরনে। আবার ‘গ্র্যান্ড এরিয়া’ ইংরেজী শব্দটি আঞ্চলিক উচ্চারণে হয়ে গেছে ‘গেন্ডারিয়া’ এবং পুরান ঢাকার ঐ স্থান এখন গ্র্যান্ড এরিয়া নয়, গেন্ডারিয়াই। এভাবে কোনো কোনো আঞ্চলিক শব্দ মানভাষায় প্রবেশ করে। তাই মানভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার সম্পর্ক যতটা দূরত্বের তার চেয়ে বেশি নৈকট্যের। আর সে কারনে আঞ্চলিক ভাষা মানভাষার উপভাষা।

আঞ্চলিক ভাষা ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠেীর মুখের ভাষা, যা ঐ জনগোষ্ঠী স্বত:স্ফূর্তভাবে যেখানে সেখানে, ঘকেটেই ব্যবহার করে। বাংলাদেশের প্রত্যেক বৃহত্তর জেলায় এক বা একাধিক আঞ্চালিক ভাষা আছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ শব্দ ও শদ্বের উচ্চারণ ভঙ্গি, স্বর ও সীড় থেকে অঞ্চল বিশেষকে সহজে চেনা যায়। এমন এমন ব্যবহার্য শব্দ আছে মাত্র একটি শব্দ উচ্চারনেই বোঝা যায় ঐ ব্যক্তি কোন বিশেষ অঞ্চলের। যেমন- পানিকে ‘হানি’ বললে বোঝা যায় নোয়াখালী অঞ্চলের, তীরকে ‘ধার’ বললে বোঝা যায় রবিশাল অঞ্চলের, ভাইকে ‘বাহে’ বললে বোঝা যায় রংপুর অঞ্চলের, নাকে ‘নো’ বললে বোঝা যায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের, কে কে ‘কেডা’ বললে বোঝা যায় কুমিল্লা অঞ্চলের। এভাবে ভাষা উচ্চারণে এক এক অঞ্চলে এক এক ভাষাভঙ্গি গড়ে ওঠেছে যাকে আমরা বলি আঞ্চলিক ভাষা।

দু:খজনক ব্যাপার হল এই-এই আঞ্চালিক ভাষার প্রতি আমাদের একশ্রেণীর শিক্ষিত মানুষের অশিক্ষিত সুলভ ভুল ধরেনা ও অবজ্ঞা রয়েছে। তাঁরা মনে করেন (ভ‚ল ধারনের বশবর্তী হয়ে) সব ভাভার উচ্চারণ রূপ অবিকল রাখতে হবে, যত কষ্ট ও সুখ বিকৃতই হোক না তাতে/আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করতে হবে এমনকি ঘরে ক্ষেতে খামারেও। এ ভুল ধারনা পোষনের ফলে অনেক সাধারণ শিক্ষিত লোকও বিভ্রান্তিতে পড়েন। ফলে সাধারণ শিক্ষিত লোক ও মফস্বলের এমন কি শহরেরও অনেকে এ ভাষার ও আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রনে কষ্টসাধ্য মানভাষার সঠিক ব্যবহার করতে না পেরে মাঝে মাঝে অজান্তেই আঞ্চলিক শব্দ ও আঞ্চলিক উচ্চারনরূপ ব্যবহার করেন। এর ফলে তার ব্যবহৃত ভাষা না মান, না আঞ্চলিক; কোটের ওপর ঐ ভাষা হয়ে ওঠে সান আঞ্চলিকের মিশ্রনে শ্রæতিকটু জাগাখিচুড়ি। বক্ততা ভাষণে প্রায় ৭০%-৮০% ভাগ লোকেই কোনো না কোনোভাবে এ মিশ্রিত ভাষাই ব্যবহার করেন।

একই মানুষ অনেক ভাষা ব্যবহার করতে পারে। যেমন- বাংলা, ইংরেজী, আরবী, ফার্সি, উর্দু, হিন্দী, জার্মানী, জাপানী, কোরিয়ান। অতএব, যে কোনো লোক মানভাষা ও তাৎসংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক ভাষাও সহজেই ব্যবহার করতে পারে। অসুবিধা কী জাতীয়ভাবে মান বাংলা ও আঞ্চলিকভাবে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করনে অসুবিধা কী, অসুবিধা নেই। বরং আরো সুবধিা। হীনমন্যতা, অজ্ঞতা ও অশিক্ষিত সুলভ দৃষ্টিভঙ্গিই এ ক্ষেত্রে অন্তরায়।

আমাদের বুঝতে হবে মানভাষা যেমন একটি ভাষা তেমনি আঞ্চলিক ভাষাও একটি ভাষা, ক্ষ কিনা রূপ গত ও উচ্চারণগত পরিবর্তন ও পার্থক্যের কারনে পৃথক ভাষারীতিতে রূপ লাভ করেছে। ভাষা গবেষক ও ভাষা তাত্তি¡কগণ মানভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব তাৎপর্য, মূল্য, মর্যাদা, উপযোগিতা স্বীকার করেছেন। তাই আমাদের দেশেও আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চতর গবেষণা হচ্ছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আঞ্চলিক শব্দ সংগ্রহ ও আঞ্চলিক এ ভাষার আভিধান সম্পাদনা করে এ ক্ষেত্রে বিরাট ভ‚মিকা পালন করেছেন। সম্প্রতি একজন বের করেছেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দের অভিধান। প্রত্যেক জেলা থেকে এ ধরণের অভিধান বের হওয়া উচিত।

বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষা যে কত বৈচিত্র্য, সমৃদ্ধ ও ব্যবহার উপযোগী এবং বহু লোকের কাছে বোধগম্য ও উপভোগ্য তা টের পাওয়া যায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে, নোয়াখালীর আঞ্চলিক গানে, উত্তরবঙ্গের ভাওয়াহিয়া গানে। এটা আরো সহজে টের পাওয়া যায়, ইদানীংকার টিভি নাটকে; এসব নাটকে বিশেষত; নোয়াখালী, বরিশাল, ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠেছে। কোনো কোনো নাটক তো পুরোটাই আঞ্চলিক ভাষায় বিক্রিত। যেমন- প্রণব, ভট্টের ‘গাঁও গেরা মের কিচ্ছা’ ‘চেয়ারম্যার সাব’। এ প্রসঙ্গে সেলিম আল দীনের ‘হাত হদাই’ নাটকটির কথা বিশেষভাবে স্মতব্য। এ নাটকের শুধু সংলাপ নয়, শিরোনামটিও নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা থেকে গৃহীত।

আঞ্চলিক ভাষারও নিজস্ব নিয়মনীতি আছে, রূপমূল আছে। এসব থাকা সত্বেও যে কেউ যে কোনো আঞ্চলিক শব্দ ভাষা যথার্থ রূপে উচ্চারণ করতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের লোকমুখেই তার যথার্থ রূপটি ফুটে ওঠে। এক অঞ্চরের লোক অন্য অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করলে তা যথার্থরূপে পরিস্ফুট হয় না; তাই কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হয়। সে কারনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান অন্য অঞ্চলের লোক যতই গাক না কেনো, তা ভালোভাবে, অকৃত্রিম রূপে ফুটে উঠবে না। আঞ্চলিক ভাষার শক্তিও সামর্থ বোঝা যায় আঞ্চলিক গানে ও আঞ্চলিক নাট্য সংলাপে। মনের ভাব-ভাবনা, আবেগ ও প্রেম-বিরহের অনুভ‚তি আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে-আঞ্চলিক আবহে আঞ্চলিক ভাষায় কত সুন্দর ও বিজ্ঞানসম্মত রূপে পরিবেশিত হয় শ্রোতাদেরকে মুগ্ধ করতে পারে একাত্ম করতে পারে, তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আঞ্চলিক গান। তাই বলা যায়, আঞ্চলিক ভাষা আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যমন্ডিত করছে।

আঞ্চলিক ভাষার এ গুরুত্ব; ভ‚মিকা ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হবে এবং অত:পর আঞ্চলিক ভাষার গবেষণাও সৃজনশীন সাহিত্যে ও সঙ্গীতে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগে উদার হতে হবে। উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠীর ভাষার মতো আঞ্চলিক ভাষার চর্চা-গবেষণা ও সংরক্ষনে শিক্ষিত সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কবি ও সমালোচক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!