দৈনিক ফেনীর সময়

আলপনার ও একুশের চালচিত্র

আলপনার ও একুশের চালচিত্র

আলপনা লোকশিল্প ঐতিহ্যের একটি অংশ। বর্তমানে এটি অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক বহুল প্রচলিত সৌন্দর্য শিল্পের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলপনা মূলতঃ লেপন করে করা কারুকার্য যা হিন্দু ধর্মীয় রীতি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আমাদের মাঝে ধরা দেয়। অতীতকালে মাটির ঘরের চৌকাঠ, দেয়াল ও ঘরের দাওয়ায় নকশা করে মাটি ও গোবর মিশ্রণের প্রলেপ লেপনের প্রচলন ছিলো। পরবর্তীতে সাদা চুনকে রংয়ের মত নরম করে সাদা রং হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। একসময় মাটির আকরের লাল গুঁড়ার সাথে পানি মিশ্রণ করে তা লাল রং হিসেবে ব্যবহার করা হত। এতে আলপনায় দুটি রংয়ের ব্যবহারে অন্য রকম সৌন্দর্য ফুটে উঠতো। বর্তমানে আলপনায় সাদা, লাল, হলুদ, নীল বহু মাত্রার রংয়ের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।

অতীতকালে বাড়ির চৌকাঠে, আঙিনায়, বিয়ের পিঁড়িতে, হিন্দু পূজা মন্ডপে ইত্যাদি জায়গায় আলপনার প্রচলন দেখতে পাওয়া যেত। বর্তমানে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্কুল-কলেজের নানাবিধ অনুষ্ঠানের জন্য আলপনা অঙ্কন করা হয়ে থাকে। একসময় যে আলপনা হিন্দু নারীরা ধর্মীয় আবেগ অনুভূতির জায়গা থেকে চর্চ্চা করতেন এখনো বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে হিন্দু নারীরা এ সংস্কৃতির চর্চ্চা করে থাকেন। তবে সময়ের ব্যবধানে আধুনিকতা ও মাত্রা সৌন্দর্যের চর্চ্চা বৃদ্ধির ফলে আলপনা অংকনে পেশাদার শিল্পীদেরও কদর বেড়েছে এবং বাণিজ্যিক চাহিদা তৈরি হয়েছে।

আলপনা একটি ক্ষণস্থায়ী শিল্প। আলপনা চিত্রের ইতিহাস বহু প্রাচীন। প্রাচীন গুহা চিত্র যেমন অজন্তা, ইলোরা ইত্যাদি গুহা চিত্রকে আলপনা বা অংকন শিল্পের আদি যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যদিও সেই রেখা অংকনের মধ্যে প্রাচীন গুহাবাসীর বণ্য প্রাণী শিকার ও জীবন ধারণের কিছু লৌকিক বিশ্বাস কাজ করতো বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
অবন ঠাকুরের ভাষায় -“আলপনার ছবি শেখাও যেমন সহজ, শেখানোও তেমনি সহজ, কেননা সহজে যা মনে আসে, হাতে আসে, চোখে পড়ে তাই হলো আলপনা।”

কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর আলপনা চিত্রে মুগ্ধ হয়ে ১৯২৪ সালে তার প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে আলপনা চিত্রাঙ্কনের উদ্যোগ গ্রহন করেন। সেই ভাবনা থেকে আলপনা অংকনের জন্য পূর্ববাংলা থেকে সুকুমারীদেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি বাংলার গ্রামীণ আলপনার চিরাচরিত মোটিফ গুলিকেই বড়ো করে এঁকে নানাভাবে পুনর্বিন্যাস করেন। সুকুমারীদেবী তার নিজস্ব অলংকরণবোধ এর সঙ্গে রবি ঠাকুরের চিন্তার সংযোগ ঘটিয়ে শান্তিনিকেতনে আলপনার অনবদ্য এক সাবলীল ও সহজ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলেন। এভাবে গ্রামীণ আলপনার কদর বাঙালী সমাজের গন্ডি ছাড়িয়ে আজ বিশ্ব পরিমন্ডলে জায়গা করে নিয়েছে। তবে আলপনার অংকন শৈলীতে গত কয়েক দশক ধরে বহু রংয়ের মিশেল ও রীতি প্রকরণ যোগ হতে দেখা যাচ্ছে । নানান ধরনের শিল্পকৃতি বিমূর্ত রীতিতে উৎসবের অংশ হয়ে উঠেছে। বাঙলা নববর্ষ ও অমর একুশে উদযাপনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সজ্জায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ও আলপনা কারুকার্য চিত্রিত হতে দেখা যাচ্ছে। আলপনা চিত্রের সাথে বিগত কয়েক দশক ধরে যুক্ত হয়ে আসছে পরিবেশের নানান উপাদান যেমন, মানুষ, পশু, পাখি, জীবজন্তু ইত্যাদি। এসব চিত্রের সাথে প্রাচীন শ্লোক বিভিন্ন মনিষীর বানীও অংকিত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে আলপনার সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবহার কবে থেকে শুরু হয়েছে তার সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়না। তবে ধারনা করা হয়ে থাকে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সমসাময়িক সময়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন প্রতিষ্ঠিত ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্ররা রাজপথ সরগরম করতে রং তুলি হাতে রাস্তায় নেমে আসে। তারা ছাত্র সংগঠন গুলোর সাথে দেয়াল চিত্র অংকন, চিকামারা, পোস্টার চিত্র অংকন ও আলপনা আঁকার মাধ্যমে আন্দোলনে নিজেদের আস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। তবে ষাটের দশক থেকে বিশেষ করে একুশে ফেব্রæয়ারী ঘিরে আলপনার বর্ণিল ব্যবহার মাতৃভাষার আন্দোলন, আত্মত্যাগ ও সহমর্মিতাকে আরো আবেগীয় করে তুলতে আলপনার ব্যবহার যেন বিশেষ মাত্রা ও যুগপৎ ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। কালক্রমে আলপনা চিত্র আমাদের বাংলা বর্ষবরণ আনুষ্ঠানিকতারও অন্যতম অংশ হয়ে উঠে। এছাড়াও আলপনা চিত্রের আরো বহুল প্রচলন দেখা যায় বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দাওযাত পত্রে এর বর্ণিল চিত্রে।

একুশে ফেব্রæয়ারী মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের খোলা চত্বর এবং এর আশপাশের সড়ক পথ ও খোলা দেয়াল সমূহে দলগত ভাবে আলপনা চিত্র অংকন হতে শুরু করে। মাতৃভাষার জন্য জীবনদানের গভীর শোকগাঁথা হৃদয়ে ধারণ করে সারাদেশে প্রতিকী শহীদ মিনার নির্মাণ ও একুশে ফেব্রæয়ারী মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের চেতনা শহর থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই চেতনা আবেগ ও আহবান মফস্বল শহর তথা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুবক, তরুণ, শিশু, কিশোর ছাত্র ছাত্রীরা চিত্রশিল্পীর মত রং তুলি হাতে নিয়ে রাত্রী জাগরণ করে শহীদ মিনার সাজানো, শহীদ মিনারের বেদী ও আশপাশের মসৃণ পথে বা প্রশস্ত জায়গায় আলপনা অংকন করে থাকে। শহীদ বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পনের আগে সেই আলপনা আঁকা স্থান কেহ যেন নষ্ট করতে না পারে তার জন্য কিশোর তরুণরা নিজেদের মত করে পাহারাও দিয়ে থাকে স্বউৎসাহে। এভাবে আলপনার সৃজনশীল ও নান্দনিক ব্যবহার হয়ে উঠছে বাঙালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে।

লেখক : চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!