রিন্টু আনোয়ার :
ভালো তথা সম্ভাবনাময় জিনিসও আমাদের দেশে বরবাদ হয়ে যায় প্রতারণা, জালিয়াতি, ঠকবাজির কারণে। তা জনপ্রিয়তার বদলে হয়ে যায় জনধিকৃত। উদাহরণের জায়গায় সেখানে উল্লেখ করতে হয় ই-কমার্সের কথা। ই-কমার্সের অর্থ ইলেকট্রনিক বাণিজ্য। জনগণকে বোঝানো বা সচেতন করার আগেই অনেকটা হুট করে দেশে শুরু হয় ব্যবসাটি। ফলে এ নিয়ে দেখা দেয় মিথস্ক্রিয়া। কারো কারো কাছে মনে হতে থাকে বিভিন্ন সময় হঠাৎ গজানো অন্য কটি ঠকবাজি ব্যবসার মতো। আবার কেউ কেউ এ নিয়ে যথারীতি ঠকবাজিই করেছে। অথচ দেশব্যাপী সচেতনতা তৈরি করলে ই কমার্স হতে পারে নতুন যুগের বাণিজ্য পদ্ধতি।
দেশে দেশে সব ধরনের পণ্য ঘরে বসে অনলাইনে পাওয়া নিয়ে নিয়মিত চেষ্টা হচ্ছে। বাড়ছে প্রতিযোগিতাও। আমাদের এখানে এ নিয়ে শুরু থেকেই দ্বন্দ্ব-অবিশ্বাসের দোটানা। এতদিন দেশের একটি বড় সমস্যা ছিল অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এ পেমেন্ট সিস্টেমের সমাধান করছে। এখন জরুরি দৈনিন্দিন জীবনের অন্যান্য কিছুর সহজলভ্যতার জন্য ই-কমার্সকে প্রাতিষ্ঠানিক করা। সবার বোধগম্য করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় আনা। মুখে মুখে বোল না দিয়ে বাংলাদেশকে কার্যকরভাবে ডিজিটাল ও স্মার্ট করতে হলে ই-কমার্সকে গুরুত্ব দিতেই হবে। আয়ত্বেও আনতে হবে। আস্থায় তো আনতেই হবে।
ধারনা হিসেবে ই-কমার্স একেবারেই নতুন। জানার- বোঝার ঘাটতির কারণে এতে কিছু গোলমাল ঘটছে। বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা, স্পেস দেওয়ার নামে লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া, কোনো ধরনের আইন কিংবা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না আনায় এ অবস্থা হয়েছে। প্রতারিত গ্রাহকরা অভিযোগ করায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বেশ কয়েকজন শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে পাড়ি জমিয়েছেন ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। অনেকেই আবার বাড়তি আয়ের জন্য চাকরির পাশাপাশি অনলাইন ব্যবসাও চালিয়ে যাচ্ছেন। না বুঝে এ ব্যবসায় ঢুকে পড়ায় তাদের হাতে মানুষ ঠকছে। কখনো কখনো তারা নিজেরাও ঠকছেন। আর মোটামোটি বুঝজ্ঞান নিয়ে শুরু করা অনেকে ভালো আছেন। বর্তমানে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সঙ্গে নতুন উদ্যোক্তারা ওয়েবসাইট খুলে অনলাইনে সেবা ও পণ্য বিক্রির ব্যবসা শুরু করছেন। এর মধ্যে অনেকের আবার সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসা। সব ধরনের পণ্যই এখন অনলাইনে কেনা-বেচা হয়। এরমধ্যে পচনশীল ফলমূল শাকসবজি থেকে শুরু করে কাপড়-চোপড় ইলেকট্রনিক জিনিসও আছে। একজন সফল অনলাইন উদ্যোক্তা হতে হলে তাকে কিছু বিষয় জানতেই হবে।
পরিকল্পনা নেয়ার সময়ই ভাবতে হবে কী পণ্য বা সেবার ব্যবসা করবেন? সেটা কোথা থেকে সংগ্রহ করা হবে, কতদিন সেটা চালিয়ে যেতে পারবেন। পরবর্তী ধাপগুলো কি হবে, সেগুলো পরিকল্পনা করতে হবে। ব্যতিক্রমী কিছু করার চেষ্টাও থাকতে হবে। অনলাইনে এখন হাজার হাজার উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে টিকে থাকতে হলে, প্রতিযোগিতায় সফল হতে হলে ব্যতিক্রমী কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। কোনো পণ্য সংগ্রহ করেই ছবি তুলেই বিক্রি শুরু না করে বরং সেগুলোয় নতুনত্ব যোগ করতে হবে। অনলাইন ব্যবসায় জায়গা করে নিতে হলে অবশ্যই গতানুগতিকতার বাইরে, ব্যতিক্রমী কিছু নিয়ে আসতে হবে। ই-কমার্স বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুক হোক আর ওয়েবসাইট হোক- ই-কমার্সের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনলাইন জগতে আকর্ষণীয় নাম না হলে মনে রাখতে চায় না। এ ব্যবসায় ফেসবুক একটি বড় মাধ্যম। ফেসবুকে একটি পেজ খুলে ব্যবসা শুরু করা খুবই সহজ একটা উপায়। উদ্যোক্তারা বলছেন, একেবারের শুরুর দিকে ফেসবুকে পাতা খুলে ব্যবসা শুরু করা যেতে পারে। কারণ এক্ষেত্রে বিনিয়োগ খুব কম লাগে। তাছাড়া অনলাইন ব্যবহারকারীদের প্রায় সবাই ফেসবুক ব্যবহার করায় এখান থেকে গ্রাহক পাওয়া, গ্রাহকদের কাছে নিজের পরিচিতি তুলে ধরা সহজ। ফলে ওয়েবসাইট থাকলেও প্রায় সবারই ফেসবুক পাতা থাকে। ফেসবুকে বুস্টিং, অর্থাৎ নিজের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে অপরিচিত মানুষদের কাছে প্রতিষ্ঠানের সংবাদ পৌঁছে দেয়া যায়। বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন। ফলে এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে পণ্য বা সেবার তথ্য তুলে ধরা সম্ভব। কত মানুষের কাছে বিজ্ঞাপনটি পৌঁছাতে চান, তার ওপরে এ ধরনের বুস্টিংয়ের চার্জ নির্ভর করে।
এরপর গ্রাহকদের সাড়া পেলে আস্তে আস্তে ওয়েবসাইট নির্মাণ করা যায়। বাংলাদেশে ১৫ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকার মধ্যে ওয়েবসাইট নির্মাণ সম্ভব। এখানে আইনি বিষয়ও রয়েছে। নিবন্ধনসহ ব্যবসার বৈধতা লাগবেই। বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে যারা পণ্য বা সেবা বিক্রির ব্যবসা করছেন, তাদের বেশিরভাগেরই কোনো আইনগত নিবন্ধন বা বৈধতা নেই। এমনকি ওয়েবসাইট খোলা, ওয়েবসাইটে ব্যবসা করা বা ই-কমার্সের ক্ষেত্রে দেশে এখনও কোনো আইন নেই। তবে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও যারা ই-কমার্স ব্যবসায় স্থায়ী হতে চান, তাদের উচিত অন্তত একটা ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করা। তাহলে সেই ব্যবসার অন্তত একটা আইনগত বৈধতা তৈরি হয়। এ ছাড়া ব্যাংক একাউন্টও জরুরি। ট্রেড লাইসেন্সের পরেই প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ব্যাংক হিসাব চালু করার পরামর্শ দিচ্ছেন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন। ব্যবসা বড় হলে, অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেন করতে হলে ব্যাংক হিসাবের দরকার হবে।
মনে রাখতে হবে, গ্রাহকের কাছে শুধু পণ্যটি বিক্রি করাই শেষ কথা নয়, সেটা প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে পৌঁছে দেয়া নিশ্চিত করতে হবে। কারণ পণ্য পৌঁছাতে বিলম্ব হলে গ্রাহক এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বিরূপ মনোভাব তৈরি হতে পারে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনেকেই অন্য স্থান থেকে পণ্য সরবরাহ করে সেটি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেন। এক্ষেত্রে তাদেরও এমন একটি চেইন তৈরি করতে হবে যাতে, তারাও পণ্যটি সঠিক সময়ে হাতে পান। পণ্য সরবরাহের পরে গ্রাহক সন্তুষ্টির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কারো পণ্য নিয়ে আপত্তি থাকলে তা তাক্ষৎনিকভাবে ফেরত নেয়া, বিকল্প পণ্য বা মূল্য ফেরতের ব্যবস্থাগুলো থাকতে হবে। নতুন বাজার তৈরির চেষ্টাও থাকতে হবে। পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত যেটাই হোক দেশ-বিদেশে সব পণ্যেরই বাজার বাড়ছে। তারওপর বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির সম্প্রসারণে গত কয়েক বছরে এমনিতেই ই-কমার্সের বাজার একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছিল, মাঝে করোনার কারণে এই গতি আরও ত্বরান্বিত হয়। মানুষের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছে চাহিদা মাফিক পণ্য। প্রয়োজনের তাগিদ সেটা ভোক্তা এবং বিক্রেতা উভয়ের ক্ষেত্রেই এই ক্ষেত্রকে আরও প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে। দেশে ই-কমার্স নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনের ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছে অনেকে। যে যেভাবে পারছে লুটপাট করছে। এতকিছুর পর এখন পর্যন্ত আইন করা তো দূরের কথা অনলাইন মার্কেটের সংজ্ঞাই ঠিক করতে পারেনি সরকার। যদিও গত বছর আইন করার কথা জানানো হয়েছিল।
বাস্তবতা হচ্ছে- নানা প্রশ্ন, অবিশ্বাস, অনাস্থার মাঝেও ই-কমার্সের আওতায় এসেছে প্রায় সব ধরনের পণ্যই। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান শুধু ই-কমার্সের কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রচুর সংখ্যক তরুণ-তরুণী কাজ করছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। পাশাপাশি তৈরি করছে নতুন উদ্যোক্তা। ই-কমার্সের পুরোটাই প্রযুক্তি নির্ভর। এর মাঝে নানা মন্দ ও বাজে খবরের মাঝে ভালো খবর হচ্ছে, সরকার ই কমার্সকে একটি আইনের আওতায় আনার পরিকল্পণা নিয়েছে। বর্তমানে দেশে ই-কমার্স মার্কেটটি ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৬ সাল নাগাদ ই-মার্কেটের আকার ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে এমন একটি হিসাব সামনে নিয়ে আইনের খসড়াও প্রায় পাকা করা হয়েছে। এত উদীয়মান এ খাতটির ব্যবসায়কি স্বীকৃতির পাশাপাশি সামাজিক স্বীকৃতি আসবে। মোটকথা বৈধতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণও আসবে-সেই আশা করাই যায়।
সচেতন যে কোনো ব্যক্তিই চাইবে না ব্যবসাটি আর শখের বসের বা ঠুনকা ব্যবসা হিসেবে থাক। কিছু মহলের ঠক-প্রতারণার কারণে এতে অনাস্থা থাক। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, দেশে ওয়েবভিত্তিক অনলাইন শপ আছে আড়াই থেকে তিন হাজার, আর ফেসবুকভিত্তিক পেজ আছে ৫০ হাজারের বেশি। ফেসবুকভিত্তিক পেজগুলোর বাইরে শুধু ওয়েবসাইটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেই গত ১ বছরে ১ লাখেরও বেশি মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থান হয়েছে। এখন আইনি কাঠামোতে এলে ই-কমার্স নিয়ে ভালো কিছু একটা আশা করাই যায়। বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। এখন পাড়ার মুদি দোকান থেকে শুরু করে দেশের বড় বড় শপিং মলগুলোর দোকানদারও অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছেন। শহরের ধনী-শিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক-চাষিরাও শিখেছেন এই মাধ্যমে কেনাবেচা। এটি অবশ্যই সময়ের চাহিদা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।