উপ-সম্পাদকীয়
রিন্টু আনোয়ার :
কেউ আমল দিক, না দিক; বিশ্বাস করুক, না করুক- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো- বিবিএসের বিভিন্ন বিষয়ে দেয়া জরিপ গুলোতে তথ্য থাকছে প্রচুর। সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যার যার বিষয়। বিবিএসের করা জরিপ-শুমারিগুলোর গুরুত্বপূর্ণটি ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ’। বিবিএসের সংজ্ঞানুযায়ী যে কয়জন ব্যক্তি একই রান্নায় খাওয়াদাওয়া এবং একসঙ্গে বসবাস করে, তাদের একত্রে একটি খানা বা হাউসহোল্ড বলা হয়। প্রতি পাঁচ বছর পর করা হয় এই খানা জরিপ। এটি থেকে বের করা হয় দেশের দারিদ্র্যের হার, সাক্ষরতার হার, স্কুলে ভর্তি ও ঝরে পড়ার হার, পেশাগত জনসংখ্যার হার, প্রতিবন্ধীর সংখ্যা, অভিবাসনের হার, বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর হার, দেশবাসীর খাদ্যাভ্যাস, মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ, খানার মাসিক আয় ও মাসিক ব্যয়, খাদ্যের পেছনে ব্যয়, ভোগ্য পণ্যে ব্যয় ইত্যাদি।
এই খানা জরিপের ভিত্তিতে দেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র (বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, টিআর, কাবিখা/কাবিটা ইত্যাদি) নেওয়া হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজির অগ্রগতি প্রতিবেদনও তৈরি করা হয় এই জরিপের ভিত্তিতে। আদমশুমারি, অর্থনৈতিক শুমারি, কৃষিশুমারি, শ্রমশক্তি জরিপ, খানা ডাটাবেইস জরিপ-এনএইচডি ইত্যাদি নিয়েও জরিপ শুমারি করে প্রতিষ্টানটি। বিবিএসের করা এসব জরিপ-শুমারির তথ্য-উপাত্তকে ভিত্তি করে সেগুলোর সঙ্গে নিজেদেরগুলো সমন্বয় করে ৫৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ দেশের সব উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রকল্প তৈরি করে, যার ভিত্তিতে সরকার প্রতিবছর অনুমোদন করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি। আর এই এডিপির প্রকল্প ধরেই বাস্তবায়ন হয় দেশের সব উন্নয়ন পরিকল্পনা। এমনকি সরকারের ১০ বছর মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও শতবর্ষী ব-দ্বীপ পরিকল্পনাও প্রণয়ন করা হয়েছে বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে। শুধু তাই নয়, বিবিএস যেসব জরিপ-শুমারি করে থাকে, সেগুলোও এডিপিভুক্ত।
এসব বিবেচনায় দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও ঘটনা বিবিএস জরিপ। এবারেরটিও তাই। এবারের খানা জরিপে কিছু ইন্টারস্টিং বিষয় উঠে এসেছে। দেশে একজন মানুষের মাসিক গড় আয় ৭ হাজার ৬১৪ টাকা। ছয় বছরের ব্যবধানে এই আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৬ সালে একজন মানুষের গড় আয় ছিল ৩ হাজার ৯৪০ টাকা। তাদের এবারের জরিপ আরো বলছে- রংপুরের দারিদ্র্য এখন বরিশালে ‘অভিবাসনে’ চলে গেছে। একসময় রংপুর বিভাগের মানুষ বেশি গরিব ছিল। দারিদ্র্যের হারও ওই অঞ্চলে বেশি ছিল। এখন দেশের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার বরিশাল বিভাগে। বরিশালে দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। অথচ বরিশাল অঞ্চলটি শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত। ২০১৬ সালে ওই বিভাগে দারিদ্র্য হার ছিল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম পার্শ্ববর্তী খুলনা বিভাগে। এই বিভাগের দারিদ্র্যের হার ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। সম্প্রতি দেয়া খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত ফলাফলটি ঘটা করে দেয়া হয়েছে আগারগাঁওয়ের বিবিএস মিলনায়তনে।
রংপুর বিভাগের অর্থনৈতিক মুক্তির গল্প জানিয়ে বিবিএসের হিসাব বলছে, দারিদ্র্যের অভিশাপ কমেছে পুরো দেশেই। গত বছরের হিসাবে পুরো দেশে দারিদ্র্য নেমে এসেছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ছয় বছর আগে যা ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে। অর্থাৎ ২০১৬ থেকে ২০২২ সময়ে দারিদ্র্য কমেছে প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। এ ছাড়া বর্তমানে পুরো দেশে অতি দারিদ্র্য নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে। ২০১৬ সালে যা ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ছয় বছরে অতি দারিদ্র্য কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।
অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমানও বিস্ময় প্রকাশ করেন বরিশালের দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ায়। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বেশি খুলনা জেলায়। সেখানে দারিদ্র্যের হার বেশি হারে বাড়ার কথা; কিন্তু পাশের বিভাগে দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, ‘দারিদ্র্য কমানোর প্রক্রিয়ায় দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা বেশি জরুরি। কারণ, হঠাৎ যেকোনো ধরনের আঘাতে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারেন’। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান থাকার কথা থাকলেও তিনি ছিলেন না। তবে দারিদ্র্য কমা নিয়ে স্বস্তির ভিডিও বার্তা দিয়েছেন।
প্রতিবেদন মতে, ধনীদের আয় বাড়ছে উচ্চহারে, আর গরিবদের বাড়ছে ধীরে। দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক সাত শতাংশে। অতিদারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশে। এছাড়া দেশের সর্বোচ্চ ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের ৩০ দশমিক চার শতাংশ। অপরদিকে সর্বপাঁচ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় মোট আয়ের শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, মানুষের আয়ের সঙ্গে ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণ। আর বেশি ঋণগ্রস্ত শহুরে পরিবারগুলো। তাদের আর্থিক দুর্বলতা বেড়েছে। আর সামগ্রিকভাবে একটি পরিবারের গড় ঋণ ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। মাথাপিছু হিসাবে ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। ২০১৬ সালের একই জরিপে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ২৪৩ টাকা। মাথাপিছু ঋণ ছিল ৯ হাজার ১৭৩ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে প্রতিটি পরিবারের ঋণ বেড়েছে ১১১ দশমিক ১০ শতাংশ। ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড়ে ঋণ জাতীয় পরিবারের ঋণের প্রায় আড়াই গুণ। ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড় ঋণ এক লাখ ৮৭ হাজার ৩০৮ টাকা। এসব পরিবারের মানুষের গড়ে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ৯৬৯ টাকা। খানা জরিপ প্রকাশের এই সময়টাতেই দেয়া হয়েছে, আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতিহার, যা এর সঙ্গে বেশ প্রাসঙ্গিক । যেখানে এবার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে মানুষের রুটি-রোজিসহ জীবন মানকে। জানানো হয়েছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা। স্মার্ট বাংলাদেশ, ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে কর্মসংস্থান। ৯৮ পৃষ্ঠার ইশতেহারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ভিত্তিতে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সেইসাথে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানো, শিল্পের সম্প্রসারণ এবং ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের ক্ষমতায়নেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দেশে ধারাবাহিকভাবে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মাঝে ইশতিহারটির মধ্যে নানা মাত্রার প্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান। তাদের টার্গেট কারা, ভাবনা কাদের নিয়ে-সেই জিজ্ঞাসাও তো থাকেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি পরিবারের সবাই আয় করেন না এবং এমন শিশু-বৃদ্ধ ও নারী আছেন, যাঁরা বাস্তব কারণে কাজ করতে পারেন না। তবে একটি পরিবারে এক বা একাধিক উপার্জনকারী থাকতে পারেন। বিবিএস বলছে, বাংলাদেশে একটি খানা বা পরিবারের গড় সদস্যসংখ্যা ৪ দশমিক ২৬। ওই পরিবারের মাসিক আয় ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। মাসে খরচ হয় গড়ে সাড়ে ৩১ হাজার টাকা। খাবারের পেছনে প্রতি মাসে গড়ে ১৪ হাজার ৩ টাকা খরচ করে একটি পরিবার। এদিকে ধনীদের কাছে সম্পদ আরও পুঞ্জীভূত হওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। আয়বৈষম্য আরও প্রকট হওয়ার চিত্রও উঠে এসেছে। দেখা গেছে, দেশের মোট আয়ের প্রায় ৪১ শতাংশ করে থাকেন দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ। ২০১৬ সালে আয়ের এই হার ছিল ৩৯।
এসব হিসাব বা তথ্য নিয়ে আপত্তি তোলা নিরর্থক। সেই সাবুদ বা সামর্থ কজনেরই বা থাকে! তবে তথ্যগুলো বিশ্লেষণের সুযোগ অবশ্যই রয়েছে। ২০১৫ সালে দেশের সরকারি কর্মচারীদের শতভাগ বেতন বাড়ানোর জেরে যে বেসরকারি খাতে লোকেরা ধাক্কায় পড়েছিল তা আজতক ঠিক হয়নি। সেই লক্ষণও নেই। তখন শ্রমবাজারে নতুন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তার সঙ্গে বেসরকারি খাতের স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা মানিয়ে নিতে পারেননি। কিছু বিষয় জানতে বা বুঝতে গবেষক হওয়া জরুরি নয়। অনেক তথ্যও জরুরি নয়। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষ মাত্রই বোধগম্য যে, মজুরি বেড়ে গেলে দারিদ্র্যসীমাও বেড়ে যায়। অর্থাৎ আগে যে আয় করলে মানুষকে দরিদ্র বলা হতো না, তার সীমা বেড়ে যায়। সবার মজুরি একই হারে বাড়ে না। সে জন্য এই সীমা ১০ শতাংশ বেড়ে গেলে দারিদ্র্য ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। তখন সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ছে—এমন খবর আসামাত্র দ্রুতগতিতে বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। বেতন শুধু সরকারি কর্মচারীদের বাড়লেও বর্ধিত দ্রব্যমূল্যের চাপ সবার ওপরেই পড়েছে। সেই বাড়বাড়ন্তের ঠেলা এখনো সইতে হচ্ছে বেসরকারি খাতসহ বাদবাকি সবাইকে। তা রংপুর-বরিশাল চেনে না। অভাবী আর স্বচ্ছল মানে না। এটিই স্বাভাবিক।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।