উপ-সম্পাদকীয়
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ মানুষের কাছ থেকে সব সময় সামাজিক আচরণ প্রত্যাশা করে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প ও প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব সভ্যতা। আধুনিক সভ্যতার দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রচলিত নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। ক্রমশই বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। অস্থির হয়ে উঠছে সমগ্র সমাজব্যবস্থা। দেশে দেশে চলছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম দুর্ভিক্ষ।
সমাজ ও রাষ্ট্রের সুখ-সমৃদ্ধির নিয়ন্ত্রক আমরাই। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংহতি শান্তিপ্রিয় মানুষের কাম্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবার-সমাজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চিন্তা-চেতনায় বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। পারস্পারিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ্বাস প্রায় শূণ্যের কোঠায়। মানুষের মধ্যে প্রাণ আছে কিন্তু মন নেই। আবেগ অনুভূতি নিরুদ্দেশ। মানুষের অবচেতন হৃদয় শান্তির সন্ধানে ঘুরপাক খাচ্ছে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সমাজকে সক্রিয় হতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে জাগ্রত করতে হবে সমাজকে। তবেই প্রতিষ্ঠা হবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ।
বর্তমান সামাজিক দুর্যোগের ক্রান্তিলগ্নে নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুশীল সমাজের প্রত্যাশা। “নীতি” হচ্ছে সমাজস্থ মানুষের আচরণের মানদণ্ড। প্রত্যেক সমাজে তার সদস্যদের আচরণ পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি থাকে। নীতিহীন সমাজ উচ্ছৃঙ্খল, বিভ্রান্তিকর ও অনিশ্চিত। নৈতিকতা শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ হতে। যার অর্থ হলো ধরণ, ভাল আচরণ, চরিত্র প্রভৃতি। নৈতিকতা হলো কতিপয় বিধান, যার আলোকে মানুষ তার বিবেকবোধ ও ন্যায়বোধ ধারণ করে এবং প্রয়োগের চর্চা করে। নৈতিকতা হলো এক ধরণের মানসিক অবস্থা যা কাউকে অপরের মঙ্গল কামনা করতে এবং সমাজের প্রেক্ষিতে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা দেয়। যেমন সত্য বলা, গুরুজনকে মান্য করা, অসহায়কে সাহায্য করা, চুরি , দূর্নীতি থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এগুলো মানুষের নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ।
সমাজ বিজ্ঞানী জনাথন হ্যাইট বলেন, “ধর্ম, ঐতিহ্য ও মানব আচরণ এ তিনটি হতে নৈতিকতার উদ্ভব ঘটে।” মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাববিস্তারকারী ধারণা বা আদর্শ। সামাজিকভাবে বাস করতে গিয়ে মানুষ কতগুলো আদর্শ বা মানদণ্ড সাধারণভাবে গ্রহণ করে নেয়। সমাজে মানুষের যা কিছু করা উচিত, যা কিছু মঙ্গলজনক মনে করে তার আদর্শ রূপই হচ্ছে মূল্যবোধ।তাই সামাজিক মূল্যবোধ হচ্ছে সততা, বিশ্বস্ততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়নীতি, শিষ্টাচার, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা, মায়া-মমতা, ক্ষমা, উদারতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ, কর্তব্যপরায়ণতা, সদাচরণ প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি বা মানবীয় গুণাবলির সমষ্টি। ইসলাম মানবজাতিকে এসব মহৎ গুণ অর্জনের জন্য আজীবন প্রয়াস চালাতে বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। কিন্তু নৈতিকতা ও মূল্যবোধের মতো মানবীয় গুণের চর্চা বর্তমান সমাজে নেই। সমাজ চলছে বিপরীত স্রোতধারায়। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ে মানুষের হৃদয়বৃত্তিতে ঘটছে অকাম্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। সমাজ ও পরিবারে বেজে উঠছে ভাঙনের সুর। নষ্ট হচ্ছে পবিত্র সর্ম্পকগুলো। চাওয়া পাওয়ার ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ধর্মীয় নীতি-আদর্শ দ্বারা পরিচালিত জীবনব্যবস্থা নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মানুষ জন্মগতভাবে মানুষ হিসাবে পরিচিতি পেলেও ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে পারিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মানুষের ভেতরে ক্রমশ বিকশিত হওয়া মৌলিক বিশ্বাস- অবিশ্বাস, মানবিক মূল্যবোধ, সহমর্মিতা, নৈতিকতার চর্চা ও বিকাশের অন্যতম স্থান হলো পরিবার। পরিবারকে মানব জাতির প্রাথমিক শিক্ষালয় বলা হলেও বর্তমান সমাজ চিত্র ভিন্ন।বদলে যাচ্ছে সমাজ, বদলে যাচ্ছে রীতিনীতি। পরিবার ভেঙে হচ্ছে টুকরো টুকরো। ভালোবাসার বন্ধন ছিঁড়ে হচ্ছে খান খান। বড় পরিবার বা যৌথ পরিবার এখন সবার কাছেই ঝামেলা। ছোট পরিবার বা সংসার গড়তে এখন উদগ্রীব সবাই।শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্র একই অবস্থা। যথার্থ জীবন আদর্শের অভাবে পরিবারগুলো এখন ভোগবিলাস ও পরশ্রীকাতর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আমরা বাবা-মায়েরাই সন্তানের কাছে আদর্শের মডেল হতে পারছি না। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা ও ধনবাদী ধ্যান-ধারণায় গড়ে উঠেছে ভারসাম্যহীন পরিবার ব্যবস্থা। সবচেয়ে নিরাপদ ও আস্থার জায়গা পরিবারের ভেতরেই এর সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করছেন। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ট্র্যাজেডি। পরিবারে সংঘটিত নেতিবাচক ঘটনার প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়। পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের নেতিবাচক প্রভাব কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রকেই বহন করতে হয়। বাংলাদেশে তা-ই হচ্ছে।
মানুষকে সত্যিকারের মানুষে পরিণত করার শিক্ষা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হচ্ছে না।।শিক্ষার ক্ষেত্রে নৈতিক বা আদর্শিক দিকটা বার বার উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, সন্ত্রাস ও নকলপ্রবণতার মতো মারাত্মক বিষয়গুলো। সমকালীন মানুষের শিক্ষা ও নৈতিকতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আহমদ শরীফ বলেছিলেন- “ শিক্ষা এখন সোলেমানি আংটির মতো। ঘষা দিলে আলাদিনের দৈত্য আসে এবং সব রকমের ইচ্ছা পূরণ করে দিয়ে যায়।” আহমদ শরীফের কথায় একটু শ্লেষ আছে। শিক্ষাকে বর্তমানে ইচ্ছাপূরণের চাবি বানিয়ে নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীন করে ফেলা হয়েছে বলেই তার কথা থেকে মনে হয়। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ডাকাতদের গ্রাম’ বলেতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। আমাদের শিক্ষার অন্তঃসারশূন্য অবস্থা ফুটে উঠেছে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের কথায়- “ডাক্তারী মতে ‘ক্লিনিক্যালি’ জীবিত বলে রোগীর যে অবস্থাটা বোঝানো হয় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটা তাই। মৃত্যুর সব চিহ্ন প্রকট, সর্ব শরীর অসাড়, সর্ব ইন্দ্রিয় নিস্ক্রিয়, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াহীন তবু মৃত্যু ঘটেছে বলা যায় না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও আজ সব অর্থে বিকল। গোটা দেশ জুড়ে বিরাট একটা কাঠামো পড়ে আছে গল্পের দানবের মতো। গল্প হচ্ছেঃ দানবের হা মুখ এতো বিরাট যে কেউ পায়ে হেঁটে পেট পর্যন্ত পৌঁছে এতটুকু স্পর্শিত না হয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। এটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও সম্ভব যে দেশের একজন নাগরিক প্রাথমিক শিক্ষায় ঢুকে উচ্চ শিক্ষার ভিতর দিয়ে স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে আসতে পারেন শিক্ষা বস্তুটি দ্ধারা এতটুকু স্পর্শিত না হয়ে। মানুষকে এমন চরম অপদার্থ ও অকর্মণ্য বানাবার কারখানা দুনিয়ার আর কোথায় আছে আমার জানা নাই।”
নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানুষ দেশ ও জাতির গর্ব। সত্যকে সত্য বলা, অন্যায়কে অন্যায় বলা এবং ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যার ভেদাভেদ বুঝে নিজের মানবিক গুণাবলি দ্বারা সমাজকে আলোকিত করা প্রয়োজন। কারণ নৈতিক মূল্যবোধ ছাড়া মনুষ্যত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়। কাজী মোতাহার হোসেন বলেছেন, “জীবন বৃক্ষের শাখায় যে ফুল ফোটে, তাই মনুষ্যত্ব। বৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালতে হবে এই ফুলের দিকে লক্ষ্য করে। শুধু শুধু মাটির রস টেনে গাছটা মোটা হয়ে উঠবে এই ভেবে কোনো মালী গাছের গোড়ায় পানি ঢালে না। সমাজব্যবস্থাকেও ঠিক করতে হবে মানুষকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে তোলার জন্য নয়, মানুষের অন্তরের মূল্যবোধ তথা সৌন্দর্য, প্রেম ও আনন্দ সম্পর্কে আনন্দ জাগিয়ে তোলার উদ্দেশে।”সুশৃঙ্খল নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং আদর্শ নীতিবোধ, জীবনচর্চা, নৈতিক মূল্যবোধের অন্তর্গত। নৈতিক মূল্যবোধহীন সমাজ বর্বর সমাজ। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় অবনতি হলে সেই সমাজের সবকিছু ধ্বংসের প্রান্তে চলে যায়। যার পরিণতিতে হত্যা, সন্ত্রাস, অপহরণ, নির্যাতন, ছিনতাই, দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। কেন নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে? তার কারণ বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের আধিপত্য যান্ত্রিক জীবনের গতিশীলতা বিস্তার, একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়া, স্বার্থপরতা বৃদ্ধি, শিক্ষাব্যবস্থায় নীতিশিক্ষার অপ্রতুলতা, সমাজের উঁচুস্তরের মানুষের অপরাধগুলোর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মকে ভয়াবহভাবে প্রভাব বিস্তার করছে।
আজকের এই অগ্নিদগ্ধ পৃথিবীর প্রতিটি সমাজে মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতাহীনতার বীভৎস বিভীষিকাময় দাবানল জ্বলছে ।নৈতিকতার অভাব এখন আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। কলুষিত হয়ে যাচ্ছে সমাজব্যবস্থা। প্রতিদিন একটু একটু করে কলুষিত হতে থাকলে শিগগিরই অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাব। আমাদের এক্ষুনি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়-নীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ছাত্রসমাজ যাতে উন্নত এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে সচ্চরিত্রের অধিকারী হতে পারে সেরকম শিক্ষাব্যবস্থা এবং নীতিশিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। একটি জাতির মধ্যে যখন শৃঙ্খলাবোধ ও সুন্দর মূল্যবোধ গড়ে ওঠে, তখন সেই জাতি মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। আমাদের আছে অনেক মর্যাদাপূর্ণ ইতিহাস। আমরাও চেষ্টা করলে সততা ও নৈতিক মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। দায়িত্ব, নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলাবোধ থাকলে ব্যক্তিজীবন যেমন সুখকর হয়, তেমনি সমাজজীবনেও আসে সুখ ও সমৃদ্ধি।অন্ধকার ঘরে যেমন একটি দিয়াশলাই কাঠি জ্বালালে সমস্ত ঘরই আলোকময় হয়ে ওঠে, তেমনি একটি ভালো আচরণ ও ভালো কাজ করার প্রত্যাশা আমাদের দেশ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে করে তুলবে শান্তির নিবাস,দেশ হয়ে ওঠবে স্বর্গ সুখের আগার।
লেখক : ব্যাংকার, কবি ও প্রাবন্ধিক।