কিশান মোশাররফ
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের কালো রাতে সংগঠিত নির্মম হত্যাকাÐের কথা স্মরণ করে প্রতি বছর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আজকের এই দিনে আমরা গভীর মর্মবেদনা, শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি বাঙালি জাতির সেই সব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যাঁদের আমরা হারিয়েছি নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শুরু থেকে চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। যাঁরা ছিলেন জাতির বিবেক, মুক্তচিন্তা ও প্রগতির বাতিঘর। কৃতজ্ঞতা, সহমর্মিতা ও গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করছি তাদের জন্য, যাঁরা চিরদিনের মত হারিয়েছেন তাদের আপনজন। যারা ফিরে আসেনি, আর আসবেনা কোনোদিন। সেই চির হারা মানুষগুলো কারো স্বামী, কারো পিতা, কারো স্ত্রী, কারো মা, কারো ভাই, ভগিনী, সন্তান। অভিভাবক শূণ্য পথ চলার বেদনা, হাহাকার কখনোই পূরণ হবার নয়।
পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের শাসন, শোষণ, অবজ্ঞা, অবহেলা, বঞ্চনা, উৎপীড়ন ও ন্যার্যতা প্রদানে ক্রু’র ষড়যন্ত্রের বীরুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষকে উজ্জীবিত করতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। এই বুদ্ধিজীবীরা কেহ ছিলেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেহ ছিলেন সাংবাদিক, প্রকৌশলী, শিল্পী, কবি ও লেখক, নির্মাতা, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবকসহ সকল শ্রেণী পেশার এই জ্ঞানতাপস মানুষ গুলো সর্বস্তরে সর্বাত্মক মুক্তির সংগ্রামে আলোর পথের দিশারী হয়ে পথ দেখিয়েছেন জাতিকে। নয় মাস যুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও, যুদ্ধের শেষদিকে অর্থাৎ নিশ্চিত পরাজয় আঁচ করতে পেরে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় তীব্র আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে, নাকেখত দিয়ে, সারেন্ডার করে, পলায়নের উপায়অন্তর না দেখতে পেয়ে দেশকে মেধাশূণ্য করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র কষতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে পীশাচেরা মাঠে নামে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিকল্পিত হত্যাকাÐ বাস্তবায়নে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তখন তাদের বিভিন্ন প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ব্যক্তি গোষ্ঠীর সহযোগিতায় বেছে বেছে হত্যা করছিল জাতির অগ্রণী শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী চিকিৎসক ও রাজনীতিবীদদের। এসব হত্যার কারণ ছিলো, নিশ্চিত স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া দেশটিকে চিন্তায়, মেধায়-মননে পঙ্গু করে দেয়া।
বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের সঙ্গে এ দেশেরই কিছু মানুষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ঘৃণিত পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী শক্তি আনসার, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এতটা ব্যাপক ও পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়েছিল বলে গবেষকরা মনে করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এই দেশীয় বাহিনীগুলোর সদস্যরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের কখনো আত্মীয়তার মুখোশে, কখনো সামাজিক পরিচয়ের মুখোশে নানান চলাকলায় তুলে নিয়ে যায় বলে পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগ। অপহরণ ও গুমের ঘটনাও ঘটেছে বিস্তর।
একাত্তরের পাক-হানাদার বাহিনী নিশ্চিত পরাজয় জেনে দেশ পূণঃগঠন ও পরিচালনায় ব্যার্থতার বিষ বাষ্প চড়াতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার টার্গেট করে। যাতে করে বাংলাদেশকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল, ভংঙ্গুর ও পঙ্গু রাস্ট্র হিসেবে থিঁতু ঘেঁড়ে বসে থাকতে হয়। দেশ যেন কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। সেই ভয়াল পরিকল্পনার চুড়ান্ত বাস্তবায়ন হয় ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাÐ নামে পরিচিত। বন্দী ও অপহরণ অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে লাশ পানিতে কাদা মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিষয়ে তাদের পরিবার স্বজনেরা তেমন বেশি কিছু আঁচ করতে পারে নাই। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং দেশ পূর্ণমাত্রায় স্বাধীণ হলে স্বজনরা প্রিয়জন ফিরে আসার প্রতীক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু প্রতীক্ষার ক্ষণ দীর্ঘ হতে থাকলে তাদের মনে ভয় ও আতংকের কালো ছায়া নামতে শুরু করে। এখানে ওখানে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের বাসাবাড়ি, ম্যাসে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে শেষতক বিভিন্ন মাধ্যমে খবর আসতে থাকে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে অসংখ্য লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রিয়জনের খোঁজে স্তুপকৃত লাশের সারিতে স্বজনের অস্থির চোখ। বিকৃত, গলিত, অর্ধগলিত লাশ। লাশের উপরে লাশ। স্বজনদের গগণ বিধারী আর্ত্ম চিৎকার, কান্না ও হাহাকারে ভারী হয়ে উঠে আকাশ বাতাস। রক্ত, পুঁজ, গলিত র্দুগন্ধ মাড়িয়ে লাশের সন্ধানে থাকা স্বজনেরা কিছু লাশ শনাক্ত করতে পারলেও অনেকের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পাওয়াও যায়নি বহু লাশ। তবুও আশা থেমে থাকেনা। এই বুঝি দরজায় কড়া নাড়বেন। জানালায় উঁকি দিয়ে ক্লান্ত কাতর কন্ঠে ডাক শোনা যাবে, দরজা খোল আমি এসেছি। কিন্তু আশায় থাকা আত্মপ্রলুব্ধ চিরচেনা ডাক আর শোনা যায় না। দিন, সপ্তাহ, মাস বছর করে একসময় তাদের নাম উঠে আসে নিখোঁজ এবং শহীদের তালিকায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা কত তার প্রকৃত হিসাব এখনো অসম্পূর্ণ। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানাযায় ১৯৭২ সালে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। পরে ডাক বিভাগ ১৫২ জন শহীদের ডাকটিকেট প্রকাশ করে। সর্বশেষ ২০২০ সালে প্রকাশিত তথ্যসূত্র মতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জনের একটি তালিকা সরকার অনুমোদন দিয়েছে মর্মে খবর প্রকাশিত হয়। নি¤েœ তালিকায় উঠে আসা শহীদ বুদ্ধিজীবী বিশিষ্ট জনদের সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা তুলে ধরা হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র), ড. মুনির চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), ড. আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য), ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য), ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা), ড. এ এন এম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা), হুমায়ুন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য), রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য), সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা), ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান), এন এম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা), শরাফত আলী (গণিত), এ আর কে খাদেম (পদার্থবিদ্যা), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা), এম এ সাদেক (শিক্ষা), এম সাদত আলী (শিক্ষা), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস), রাশীদুল হাসান (ইংরেজি), এম মর্তুজা (চিকিৎসক)। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ), ড. শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত), মীর আবদুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান)।
চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী (হূদরোগ বিশেষজ্ঞ), অধ্যাপক ডা. আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. আবদুল আলিম চৌধুরী, ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়ুদুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. আজহারুল হক (সহকারী সার্জন), ডা. মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক)।
অন্যান্য শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক)৷ নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক), সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক), সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক), আ ন ম গোলাম মুস্তফা (সাংবাদিক), আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার), ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ), রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর), যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক), জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার), মেহেরুন্নেসা (কবি), ড. আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ), নজমুল হক সরকার (আইনজীবী), নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)।
ঢাকার অদূরে রায়ের বাজার নামক স্থানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে সরকারী ভাবে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বরের এই দিনে রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন।
১৪ ডিসেম্বর কালো পতাকা, কালো ব্যাজ, মৌন মিছিল, পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, সরল গরল ভাষনই শহীদ পরিবারের জন্য শেষ শান্তনা নয়। আপনজন হারানোর বেদনা কোনো কিছুতেই পুরন হবার নয়। মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের প্রতি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা যতখানি দৃশ্যমান শহীদ পরিবারের প্রতি ততখানি দৃশ্যমান নয়। শহীদ পরিবারের আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আজকের এই দিনে এই হোক অঙ্গীকার।
লেখক : চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক,ও সাংবাদিক।