দৈনিক ফেনীর সময়

মানবাধিকার : আজকের ভাবনা

মানবাধিকার : আজকের ভাবনা

সাইফুল আলম
বহমান সময়ে উত্তাল বিশ্ব। একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল বিরোধ, আরব বসন্তের ডাকে আজও অস্থিরতায় সে অঞ্চলের কয়েকটি দেশ, উত্তপ্ত ইরান। অনাহারে আফগানিস্তানের ভাগ্যাহত নিষ্পাপ শিশুরা। অন্যদিকে বিশ্বকাপ ফুটবল আনন্দে মাতোয়ারা দেশ সহ বিশ্বের কিয়দাংশ। একদিকে ঠিকরে পড়ছে আগুনের ফুলকি অন্যদিকে ফুটবল নামক বিনোদনের খেলায় চমৎকার শৈল্পিক মুগ্ধতায় মোহাবিষ্ট ফুটবল প্রেমীরা। এরই মধ্যে পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। জাতিসংঘের আহবানে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। এদিন মানবাধিকার বিষয়ে সভা, সমাবেশ ও প্রদর্শনীর আয়োজন থাকে। মানবাধিকার বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে দিনটি পালন করা হয়।

বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার শব্দটি বেশ আলোচিত। ঠিক কবে, কোন মাহেন্দ্রক্ষণে মানুষের মনে মানবাধিকার বিষয়ে চেতনার উদ্রেগ হয় এ বিষয়ে জানতে একটু পেছনে ফেরা যাক। পারস্যের রাজা দ্বিতীয় সাইরাস যিনি ‘সাইরাস দ্য গ্রেট’ নামে অধিক পরিচিত, তিনি ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলন আক্রমণ করেন। ব্যাবিলনের শাসন ক্ষমতা হাতে নেয়ার পর সাইরাস একটি মহান কাজ করলেন। তিনি ব্যাবিলনীয়দের দ্বারা নির্যাতিত সকল দাসকে মুক্ত করে দেন। কেবল তাই নয়, সাইরাস দাসদের নিজ নিজ দেশে চলে যাওয়ার ব্যবস্থাও করে দেন। এরপর সাইরাসের হুকুমে একটি সিলিন্ডার তৈরী করা হয়। এই সিলিন্ডারটি ‘সাইরাস সিলিন্ডার’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সাইরাস তৎকালীন সময়ে সারাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবাধিকার বাস্তবায়নে কাজ করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, সাইরাসের এ পদক্ষেপ বিশ্বের প্রথম মানবাধিকার সনদ। এরপর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) মদীনা সনদ ঘোষণা করেন। মদীনা সনদকে পৃথিবীর প্রথম লিখিত মানবাধিকার সনদ বলে মনে করা হয়।

মূলত মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা, সে অধিকার কোথাও ক্ষুন্ন হলে তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি নিয়েই মানবাধিকারের ব্যাপ্তি। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ মানবাধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে প্রয়োজন মানবাধিকার। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, স্থান, কালভেদে প্রতিটি মানুষের অধিকার সমান। এক্ষেত্রে ধনী, গরীব, উঁচু, নিচু, বংশ মর্যাদা কোনটাই মানবাধিকার প্রাপ্তিতে কারো জন্য অন্তরায় হতে পারে না। বস্তুত মানবাধিকার কোন বয়সের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। লিঙ্গভেদেও এটি সীমাবদ্ধ নয়। শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষ প্রত্যেকটি মানব মাত্রই মানবাধিকার প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকার- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। এগুলোর পাশাপাশি চিন্তার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদিও মানবাধিকারের অন্তর্ভূক্ত।

জাতিসংঘের টহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং এর ১ম অনুচ্ছেদে লেখা রয়েছে- ‘‘সকল মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং সমান সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী”। এ সবুজ গ্রহে মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর অধিকার রক্ষায় আন্দোলন করতে হয় না। মানুষ যেহেতু সৃষ্টির সেরা জীব, তাই তার মর্যাদাও প্রাণীসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ। মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত ৩০টি ধারায় প্রতিটি মানুষ কিভাবে তাদের অধিকার প্রাপ্ত হবে, এর ব্যত্যয় ঘটলে তার প্রতিকার প্রাপ্তিতে কোথায় দ্বারস্থ হতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এতে রয়েছে মানুষের দৈহিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার সম্বলিত আইন। কোন মানুষকে অধীনতায় আবদ্ধ করার ব্যাপারে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

আইনের চোখে প্রতিটি মানুষ সমান, এমন চেতনা থেকে প্রতিটি মানুষের রয়েছে ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার। আমাদের বেশিরভাগ লোকজনের মানবাধিকার নিয়ে তেমন কোন সচেতনতা নেই। তাই আমরা নিজের অধিকার সম্পর্কে যেমন সচেতন নই তেমনি অন্যের অধিকার সম্পর্কেও আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা নেই। আর তাই দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে চলছে মানবাধিকার হরণ। মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতাও মানবাধিকারের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু অন্য ধর্ম বা মত নিয়ে কটাক্ষ করা, নিজ ধর্ম বা মতাদর্শ উর্দ্ধে তুলে ধরার প্রয়াস থেকে ধর্ম নিয়ে চরম বিরোধ দেখা দেয়। ফলে ধর্মীয় উস্কানী থেকে মারামারি, হানাহানি, হত্যার মতো ঘটনা এখন যেন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এতে করে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভেস্তে যাচ্ছে যত্র-তত্র। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো আগের মতো নিরাপদ নয়। সরাসরি অথবা আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ যাচ্ছে অগণিত মানুষের। আবার কারো একান্ত ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ, তার ব্যক্তিত্ব ক্ষুন্ন হয় এমন কথা বা কাজ ইত্যাদি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতিটি নর-নারী তাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনে মত দেবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের মতের তোয়াক্কা না করে জোরপূর্বক অন্যত্র বিয়ে দেয়াও মানবাধিকারের পরিপন্থি।
প্রায়শই কর্মক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। একই কাজের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার রাখেন। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র উল্টো। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে, বিশেষ করে শ্রমজীবী নারীদের এ ক্ষেত্রে অনেক কম মজুরি দেয়া হয় যা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশে এখনও বিবাহিত নারীরা চরমভাবে অধিকারবঞ্চিত। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (নিপোর্ট) এর তথ্যমতে ৭৭শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার। ৩৩শতাংশ অবিবাহিত নারী তাদের কর্মস্থলে, পরিবার, পরিবারের বাইরে নির্যাতিত হয়। এক-তৃতীয়াংশ কিশোর-কিশোরী কোন না কোনভাবে উৎপীড়ন ও সামাজিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এতে করে তাদের মানসিক ভারসম্যা অংকুরেই নষ্ট হচ্ছে। নারীদের ক্ষেত্রে কত বেশী পরিমান মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় তা আরেকটি উদাহরণ দ্বারা বোঝা যায়। গত পাঁচ বছরে দ্রæত আইনী সেবা দেওয়া ৯৯৯ নম্বরে শুধু নির্যাতন বিষয়ক কল এসেছে বিয়াল্লিশ হাজার। এমন রিপোর্টে আমরা শংকিত হই!

“এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার” কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এমন উদাত্ত আহবানে আমরা কজন সাড়া দিয়েছি? শিশু অধিকার রক্ষায় আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ কি যথেষ্ঠ? ফুলের মত নিষ্পাপ শিশুর উপর নির্যাতন, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা এসব খবরে আমরা যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। চট্টগ্রামে সদ্য ঘটে যাওয়া স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্য ঘটনা, শিশু আয়াতকে হত্যার পর লাশ ছয় টুকরো করে ফেলে দেয়ার ঘটনায় বাকরুদ্ধ গোটা দেশ। এ অপরাধীদের ফাঁসির মত কঠোর শাস্তি দেয়ার পরও অন্য অপরাধপ্রবণ লোকদের মানসিকতায় কেন পরিবর্তন আসছে না? মূলত এসব আমাদের নৈতিকতার চরম অবক্ষয় বলতে হয়। খেলাধুলা শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক। এটি তাদের অধিকার। কিন্তু বিশ্ব যখন ফুটবলে মত্ত তখন আমরা আমাদের সন্তানদের খেলাধুলার বিষয়ে কি ভাবছি? দেশে শিশুদের খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ নেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে খেলার মাঠ দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করার হীনপ্রচেষ্টা যখন দেখতে পাই তখন খুবই কষ্ট লাগে। ঝুঁকিপূর্ণ সকল কাজে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে।

অভিবাসীদের ক্ষেত্রেও চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র চোখে পড়ে। কোন দেশে গৃহযুদ্ধ অথবা বহি:শত্রæর আক্রমণের ফলে অন্যদেশে আশ্রয়গ্রহণ করা মানবাধিকারের আওতাভুক্ত। আমরা দেখি সিরিয়া, লিবিয়া, নাইজেরিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষদের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়নি। ভূমধ্যসাগরের তীরে ভেসে আসা শিশু আয়লান কুর্দির লাশ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মানবাধিকার নিয়ে আমরা কতই না তামাশা করছি। স্বদেশ থেকে বিতাড়িত, ভাগ্যাহত মানুষগুলো যারা কিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করতে চাইছে, তাদেরকে সেখানে ঢুকতে না দিয়ে বরং সাগরে ডুবে মরতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের সলিল সমাধি হচ্ছে এ ভূমধ্যসাগরে। এদিকে জাতিসংঘ আজ নখ-দন্তহীন কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ ঘোষণায় বিস্তারিত থাকা সত্তে¡ও জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন: “রোগের মত ছড়াচ্ছে মানবাধিকার লংঘন”। যখনই কোন দেশের যুদ্ধ বন্ধে অথবা মানবাধিকার লংঘন বন্ধে জাতিসংঘ ভূমিকা নিতে চেয়েছে তখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের যেকোন একটি দেশ ‘ভেটো’ দেয়ারক্ষমতা প্রয়োগ করে তা রুদ্ধ করে দিয়েছে। এটি অবশ্যই ভেটো ক্ষমতার অপপ্রয়োগ। নি:সন্দেহে এটি মানবাধিকারের বিরুদ্ধচারণ।

মানবাধিকার রক্ষায় দেশ-বিদেশে রয়েছে অনেকগুলো সংস্থা। কিন্তু মাঝে মধ্যে দেখা যায়, মানবাধিকার লংঘন চরম পর্যায়ে উপনীত হলেও এ প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এ পৃথিবীকে সকলের বাসযোগ্য করতে একে অন্যের প্রতি আরো বেশী সহনশীল হতে হবে। দেশে মানবাধিকার বিষয়ক প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ মানবাধিকার রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোরালো ভূমিকা, জাতিসংঘের কার্যকরী পদক্ষেপ, মানবাধিকার রক্ষায় সচেতনতা এবং অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আজ সময়ের দাবী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!