দৈনিক ফেনীর সময়

মধ্যবিত্ত সমাজে উচ্চশিক্ষার বহুমাত্রিক সংকট

মধ্যবিত্ত সমাজে উচ্চশিক্ষার বহুমাত্রিক সংকট

ইমরান মাহফুজ

মানুষের বয়সের সঙ্গে দেশের বয়স বাড়ছে। নাগরিক জীবনে বাড়ছে ঘরে বাইরে অস্থিরতা। একই সাথে চোখের সামনে ভাসছে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্তি¡ক ক্ষেত্রে চরম এক নৈরাজ্য পরিস্থিতির বিরাজমান চেহারা। যে চেহারার ছায়া সরাসরি প্রভাব ফেলছে তরুণদের ওপর। ফলে হতাশ তরুণরা মিশে যাচ্ছে বিভিন্ন অসামাজিক ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে, আবার কখনো সাধারণ চিন্তা ও কাজ থেকে হয়ে পড়ছে নিষ্ক্রিয়। হতাশা থেকে হিংস্রতার জন্ম হয়। বীভৎস ঘটনা কেউ ঘটাতে পারে সভ্য ও সুস্থ সমাজে। তার জন্য সেই সমাজ ব্যবস্থা দায়ী।

এইভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। দেশে তরুণদের বিশেষত শিক্ষিত তরুণদের এক বৃহদাংশ বেকার জীবন যাপন করছে এবং সেটা বেড়েই চলছে। স¤প্রতি বগুড়ার একজন তরুণ ‘ভাতের বিনিময়ে পড়ানোর বিজ্ঞাপন’ দিয়েছিলো ফেসবুকে। আলোচিত হয় বিজ্ঞাপনটি। এতে করোনা মহামারিতে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি কতটা সংকট তৈরি করেছে তা আরও পরিস্কার হয়।

দেখা যায়, দেশের মাদরাসা, কলেজ ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর কয়েক লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী পাশ করে বের হন। কিন্তু এত শিক্ষার্থীর জন্য চাকরির সুযোগ যে নেই এটি কঠিন বাস্তবতা। প্রসঙ্গে বিআইডিএস এর এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৩৪ শতাংশ আর স্নাতক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশের মত। (বিবিসি বাংলা, ২২ ফেব্রæয়ারি ২০২২)

অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ বলছে, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ দুই বছরে মাত্র ছয় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, অথচ এই সময়ে প্রতিবছর দেশের কর্ম বাজারে প্রবেশ করেছে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ লাখ। অথচ ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর চাকরি বা কাজ পেয়েছে ১৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ এপ্রিল ২০১৬)।

সংবাদপত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ আসে, স্নাতক শেষ করে চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে তাঁরা শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পান না। মাত্র ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি খোঁজার সুবিধা রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে এখন মোট শিক্ষার্থী আছেন ২০ লাখের মতো।

মোটকথা বেকারত্ব এক অভিশাপ। কারণ খুঁজতে মাঠে গিয়ে কথা বললাম, ঢাবি, জাবি, জবি, শাবিপ্রবি, ইডেন কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে, অধিকাংশেরই স্বপ্ন বিসিএস। ব্যতিক্রম দেখেছি ব্র্যাক ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে, তারা নিজে কিছু করতে চায়। তার সংখ্যাও খুব বেশি নয়। কিন্তু শাবিপ্রবিতে পড়েও প্রযুক্তির কাজে আগ্রহী না হয়ে চাকরি করতে চায়। তাহলে এই দেশের উ”চশিক্ষা কি শুধুই চাকরির জন্য? আর চাকরি বা কয়জন পায়!

জানতে চাইলাম কেন সরকারি চাকরি, একজন বললেন সরকারি চাকরিতে একটা সম্মান আছে। আবার বিয়ের ক্ষেত্রেও দেখা যায় সরকারি চাকরি বেশি গুরুত্ব পায়, নিরাপত্তা আছে। বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসে চাকরি এখন বেশ লোভনীয়। তাই হয়ত প্রতিযোগিতাও বেড়ে গেছে লক্ষণীয় হারে।

সাধারণ শিক্ষায় বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে পাশ করা ছাড়াও এখন বিবিএ, আইবিএ, বুয়েট থেকে বেরিয়েও আগ্রহী সরকারি কর্ম কমিশনে! সেই সঙ্গে একদল শিক্ষিত বেকার দাবি তুলেছেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স পঁয়ত্রিশ বছর করতে হবে। খুব হাস্যকর! পথ নিয়ে ভাবে না, পথের মানুষ নিয়ে মাথা ব্যথা। চিন্তার কত সঙ্কট। এতো কষ্ট করে অনার্স মাস্টার্স করে আবার রাস্তায়ও নামতে হয় নিদারুণ ভাবনায়।

তাই আমার মতে অভাবী দেশে সবার উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নেই। কাজের সাথে পড়ার যেখানে মিল থাকে না। যাদের জীবনের সাথে কমিটমেন্ট নেই। পথ ও পথচারীর কাজ আলাদা করতে পারে না। এইভাবেই কাটিয়ে দেয় বছরের পর বছর। নিদারুণ নিষ্ঠুর অমায়িক বাংলাদেশের উচ্চচশিক্ষা!

আবার ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা চাকরিপ্রার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা তাঁদের চাহিদামতো কাজ পাচ্ছেন না।

অন্যদিকে অনেকে জানেনÑ এখনকার সময়ের সবেচেয়ে বড় শিক্ষা ক্লাসরুমে নয়, ক্লাসরুমের বাইরে। যার যার আঙ্গুলের নিচে। চাইলেই আমরা যেকোন বিষয়ে দক্ষ হতে পারি। সেজন্য বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট দরকার নেই। বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট পেয়েও কেউ যদি অদক্ষ হয় তবে তার তুলনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত একজন দক্ষ শিক্ষার্থী বাস্তব জীবনে অনেক ভালো করবে। আরো সোজা কথায় বললে- কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েও এখনকার সময়ে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। আমাদের তরুণদের ভেতরে এই বোধটি সঞ্চার করা দরকার। তাদেরকে নতুন পৃথিবীর জন্য উপযোগী দক্ষতা অর্জনে উদ্ব্দ্ধু করতে হবে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাকি ঢাকা কলেজ, ডিগ্রী না অনার্স না মাস্টার্স সেই অহেতুক বিতর্কে নষ্ট হবে না সময়।

আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দুই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। প্রথমে তারা উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যতটা আগ্রহী, কারিগরি বা কর্মদক্ষতা বাড়ানোর শিক্ষা নিতে ততটা আগ্রহী নন। দ্বিতীয়ত খুব কম ক্ষেত্রেই কাউকে উদ্যোক্তা হতে দেখা যায়। সবাই চাকরি প্রত্যাশা করেন, কেউ চাকরি সৃষ্টির কথা ভাবেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে চাকরির আশায় দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করা এখন সাধারণ বিষয়।

এছাড়াও বর্তমানে সবকিছুতেই প্রবেশাধিকার অনেক বেশি। অনেকেই অন্যদের জীবন-যাপন দেখে নিজের জন্যও অনেক সময় সে রকম জীবনের চিন্তা করে। আর সেটা হয়তো অর্থনৈতিক কারণে কিংবা নিজের ব্যক্তিগত কারণে যখন পায় না তখনই হতাশায় থাকে। অন্যদিকে যখন রাষ্ট্রে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কোনো কিছু হচ্ছে না তখনই তারা হতাশায় ভোগে। এদেশে ঘুষ, দুর্নীতি কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া চাকরি পাওয়া কঠিন। অযোগ্য মানুষরা দলীয় আনুগত্যের কারণে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই দৌড়ে তরুণ মেধাবীরা মার খেয়ে যাচ্ছে। তবে কাজ জানা লোক কোনদিন বেকার থাকছে না, কিংবা আমাদের দেশের ‘উচ্চশিক্ষিতদের’ মধ্যে কর্মদক্ষ এমন লোক খুবই কম!

সরকারের উচিত বছর বছর নতুন প্রতিষ্ঠান না করে সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করে মানুষকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করা। তাহলেই দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ হবে। স্বাধীনতা এবং মুক্তির চেতনা ফিরে পাবে। আজও এই দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদার সমাধান হল না, ঝুলে আছে ২১, ১১ ও মুক্তির সনদ ৬ দফা!

খ.
পৃথিবীতে এমন বহু দেশ রয়েছে যেখানে বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল খুব একটা নেই। বাজেট কখন উত্থাপিত হয়, কখন পাস হয় নাগরিকরা তা জানেন না, খোঁজখবর রাখেন না প্রায়ই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নিঃসন্দেহে। অধীর আগ্রহে খোঁজ খবর রাখলেও হতাশ হয়ে বাসায় ফিরেন বেকার সমাজ! তাছাড়া দেশে প্রতিবছরই বাড়ছে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা। প্রতিবছর নতুন করে কমপক্ষে ২০ লাখ নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে শ্রমবাজারে। কিন্তু তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বাজেটে নির্দিষ্ট করে কোন রূপরেখা থাকে না। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তাই বরাবরের মতো সুনির্দিষ্ট কর্মসংস্থানের কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ঘোষিত হচ্ছে নতুন অর্থবছরের বাজেট।
প্রতিটি দেশের বাজেটে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব কমানোর একটি রূপরেখা থাকে। এটিই থাকে বাজেটে তরুণদের মূল আকর্ষণ, কিন্তু বাংলাদেশে তা উপেক্ষিত। ২০১০ সালে সরকারিভাবে ন্যাশনাল সার্ভিসের আওতায় কিছু সাময়িক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেওয়া হলেও নানা অনিয়মের কারণে তা টেকসই হয়নি। এরপর নতুন করে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। (৭ জুন ২০১৮ শেয়ার বীজ)
বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত¡ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারতে বিদেশ থেকে যে রেমিটেন্স আসে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। অন্যদিকে সিডার বাংলাদেশ সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছে, পরিস্থিতি হয়তো তার চেয়েও ভয়াবহ। ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) এক পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে, বাংলাদেশে শতকরা ৪৭ ভাগ গ্রাজুয়েট হয় বেকার, না হয় তিনি যে কর্মে নিযুক্ত এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না তার। প্রতিবছর বাংলাদেশে ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ চাকরি বা কাজের বাজারে প্রবেশ করছেন। এই বিশাল-সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের মাত্র সাত শতাংশ কাজ পাবেন। এর অর্থ হচ্ছে, দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বেকারের তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন। ভারত, পাকিস্তান বা নেপালের পরিস্থিতিও তেমন একটা ভালো নয়। ভারতে ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ আর নেপালে ২০ শতাংশ মানুষ চাকরির সন্ধান করছেন। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বা সমপর্যায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত।

সার্বিক পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো। ইনডেক্স মুন্ডি বলছে, বাংলাদেশে সার্বিক বেকারত্বের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫.০ শতাংশ, ভারতে ৪.৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ৬.৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় এই সংখ্যা ৫.১ শতাংশ। বিশ্বের সর্বাধিক বেকারের বাস জিম্বাবুয়েতে। শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষেরই কোনও কাজ নেই। আফ্রিকা বাদ দিলে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের অব¯’াও শোচনীয়। কসোভোয় ৩১ শতাংশ, গ্রিসে ২৮ শতাংশ, স্পেনে ২৬.৩ শতাংশ, পর্তুগালে ১৬.৮ শতাংশ, ইতালিতে ১২.৪ শতাংশ, আয়ারল্যান্ডে ১৩.৫ শতাংশ মানুষ বেকার। আর সৌদি আরব, বিশ্বের অন্যতম তেল সমৃদ্ধ দেশে ১০.৫ শতাংশ মানুষের কোনও কাজ নেই। সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ দেশের সমস্যা হচ্ছে, তেলের ভান্ডার তাদের সর্বনাশের প্রধান কারণ।
তারা মনে করেছিল, তেলের প্রয়োজনীয়তা কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। ১৯৬২ সাল হতে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ড. আহমেদ জাকি ইয়ামানি সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী ছিলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ইয়ামানি অত্যন্ত বাস্তববাদী ছিলেন। একপর্যায়ে বলেছিলেন প্রস্তর যুগ শেষ হওয়ার পেছনে প্রস্তরের অপ্রাপ্যতার কারণ ছিল না। কারণ ছিল, মানুষ প্রস্তরের বিকল্প আবিষ্কার করে ফেলেছিল। এক সময় তেলেরও প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যাবে, যা বিকল্প জ্বালানি আবিষ্কারের ফলে এখন অনেক দেশেই দেখা যাচ্ছে। সৌদি তেল এখন বিশ্ববাজারে সর্বনিম্ন দামে বিক্রি হ”েছ। এর ফলে সৌদি রাজকোষে টান পড়েছে। সরকার সেই দেশের সরকারি কর্মচারীদের বেতন ২০ ভাগ কমিয়ে দিয়েছে। সৌদি আরবের এখন আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে হজের মৌসুমের আয়, যে কারণে বর্তমানে একজন মানুষের হজ করতে যেতে হলে দু’তিন বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ-তিনগুণ অর্থ ব্যয় করতে হয়।

পণ্যনির্ভর অর্থনীতির ঝুঁকি অনেক বেশি। ফলে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই সৌদি আরবের উচিত হবে, তেলের অর্থ সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করা আর সৌদি আরবের মানুষকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করা। সেই পরামর্শ আমার দেশের জন্যও। যৌক্তিক সময়ে আবেগকে সংযত করে দেখে এবং ঠেকে শেখার ইতিবাচক মানসিকতা রাখা জরুরী হয়ে পড়েছে।

যত দিন যাচ্ছে তত স্বাভাবিক জীবনে সুখ আকাশে উঠছে। ফলে নির্ভরতার বদলে কথিত পড়ার নামে, উচ্চশিক্ষিত ভাইটি হয়ে উঠছেন বড় বোঝা। বরং কম শিক্ষিত ও অশিক্ষিতরা কোন না কোন কাজ পাচ্ছে; আর সমাজে নিগ্রহের পাত্র হয়ে হতাশায় ডুবছেন উচ্চশিক্ষিতরা। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে অধিকাংশ বেকার চাকরিতে ঢোকার ৩০ বছর বয়সসীমা পার করছেন চাকরির আবেদন করে করেই। মাস্টার্স সম্পন্ন করা ছেলেমেয়েরা আবেদন করছেন এমএলএসএস পদে; কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হচ্ছেন তাঁরা।

প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের কথাগুলো মনে রাখার মত, আমরা চাকরিজীবী।… অধীনতা মানুষের জীবনী-শক্তিকে কাঁচা বাঁশে ঘুণ ধরার মত ভুয়া করিয়ে দেয়। ইহার আবার বিশেষত্ব আছে, ইহা আমাদিগকে একদমে হত্যা করিয়া ফেলে না, তিল তিল করিয়া আমাদের জীবনী-শক্তি, রক্ত-মাংস-মজ্জা, মনুষ্যত্ব বিবেক, সমস্ত কিছু জোঁকের মতো শোষণ করিতে থাকে। আখের কল আখকে নিঙড়াইয়া পিষিয়া যেমন শুধু তাহার শুষ্ক ছ্যাবা বাহির করিয়া দিতে থাকে, এ-অধীনতা মানুষকে-তেমনি করিয়া পিষিয়া তাহার সমস্ত মনুষ্যত্ব নিঙড়াইয়া লইয়া তাহাকে ঐ আখের ছ্যাবা হইতেও ভুয়া করিয়া ফেলে। তখন তাহাকে হাজার চেষ্টা করিয়াও ভালমন্দ বুঝাইতে পারা যায় না।.. দেখাইতে পারো কি, কোন জাতি চাকরি করিয়া বড় হইয়াছে?.. দেখিয়াছ কি চাকরিজীবীকে কখনও স্বাধীন-চিত্ত সাহসী ব্যক্তির মতো মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে? তাহার অন্তরের শক্তি যেন নির্মমভাবে কচলাইয়া দিয়াছে ঐ চাকরি, অধীনতা, দাসত্ব।

তাই এক কথায় বলতে হয় চাকরির লোভ ত্যাগ করা উচিৎ শিক্ষিতদের। এতে তাদেরই মঙ্গল। মনে রাখবেন, রাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। এক সময় ১০০% মানুষ শিক্ষিত হবে। কিন্তু সবাই তো সরকারি চাকরি পাবে না। তাহলে কাউকে ঠেলা চালাতে হবে, কাউকে ধান রোপণ করতে হবে, কাউকে ইলেক্ট্রিশিয়ান হতে হবে। তো, কারা হবে এসব? বুঝা গেলো এক সময় মাস্টার্স পাশ করেও আপনাকে আমাকে ধান লাগাতে হবে, জুতো সেলাই করতে হবে। তাই জ্ঞানদরিদ্র সমাজে চারিত্রিক ও মানসিক; জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি করতে হলে সত্যিকারের শিক্ষা আমাদের লাভ করতে হবে। বাস্তবিক দীক্ষায় দৃষ্টি করতে হবে প্রসারিত। ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে বিশ্বের বিশালতায় উন্মুক্ত করতে হবে বলাকার মত।

গ.
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সমাজ ও রাষ্ট্রের চাহিদা মেটাতে অক্ষম। এ কথা সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্বীকার করলেও সেই শিক্ষাকে কীভাবে যুগোপযোগী করা যায়, সে ব্যাপারে কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায় না। সবকিছুই চলছে গতানুগতিকভাবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন সব বিষয় যুক্ত করছে, যার সঙ্গে চাকরির বাজারের বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই। (১২ সেপ্টেম্বর ২০২১/ প্রথম আলো)

অন্যদিকে করোনায় উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের অটোপাস দিয়েছে সরকার। প্রকাশ থাকে যে শিক্ষাবিদ বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের পরামর্শ ছাড়াই কাÐ ঘটেছে! এই ফলাফলে ক্ষতিটা হবে দীর্ঘস্থায়ী। প্রসঙ্গত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একটি জাতীয়মানের দুঃখ নিয়ে আলাপ করা যাক। রাষ্ট্র কাঠামোর শুরুতে ১৯৭২ সালে গণহারে পাস করানোর ঘটনায় তিনি ভীষণভাবে দুঃখ পেয়েছিলেন, ব্যথিত হয়েছিলেন।

আত্মজৈবনীক রচনা ‘বিপুলা পৃথিবী’তে লিখেছেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আগেই বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ইউসুফ আলী যে-নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন, সে-কথাটা এখানে বলে নিই। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিষয়ে আমি যে কয়েকটি কাগজ তৈরি করেছিলাম, তার একটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে যে-ক্লাসে পড়ত, ১৯৭২ সালের ১ মার্চে তাকে আবার সেখান থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে; এই একটি বছর জাতীয় ক্ষতি হিসেবে পরিগণিত হবে; এবং সরকারী চাকরিতে প্রবেশের বয়ঃসীমা এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হবে। কিš‘ মন্ত্রীসভায় এ প্রস্তাব বিবেচিত হওয়ার আগেই জাতীয় পরিষদ-সদস্য ইউসুফ আলী এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গণউন্নতি দেওয়া হলো, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যে যেখানে পড়ত, ১৯৭২ সালে তার পরবর্তী শ্রেণিতে সে উন্নীত হবে। এই ঘোষণার বিষয়ে তিনি যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেননি, সে-কথা আমি তাজউদ্দীনের কাছ থেকে জেনেছিলাম। বলা বাহুল্য, ঘোষণাটি ছাত্রদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এবং তা প্রত্যাহার করার মতো সাহস সরকারের হয়নি। এতে যে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কী সর্বনাশ হলো, অনেকে তা ভেবে দেখেননি।’

অটোপাসের ফল অচিরেই ভোগ করতে শুরু করে। ‘১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠলো সিলেবাস কমানোর। উঠবে নাই বা কেন? আগের ক্লাসের পড়া যে শেখেনি, পরীক্ষাগারে নির্ধারিত পরীক্ষা করেনি, পরের ক্লাসের পড়া কিংবা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষা তার কাছে তো দুরূহ মনে হবেই। এর প্রতিকার না-পড়া বিষয় জেনে নেওয়া নয়—সেই সময় ও সুযোগ কারো নেই-প্রতিকার আরো না-শেখা। অতএব, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করার আন্দোলন শুরু হলো। প্রথম-প্রথম কেউ গা করেননি এতে, কিন্তু দেখা গেল ছাত্রেরা না-শেখার পণ করেছে।’

১৯৭২ সালের গণপাস পরবর্তী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ শিক্ষার্থীদের অন্যায্য দাবি এবং উদ্ভ‚ত পরি¯ি’তির বাস্তবতাকে মেনে নিতে না পেরে মনের জাতীয় দুঃখে আানিসুজ্জামান চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। ন্য‚নতম দায়বোধে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। বর্তমান রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক সংকট বিশেষত শিক্ষা সংস্কৃতির অরাজকতায় বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ কী করছে? কোথায় হারাচ্ছি আমরা। বেদনাজল গড়িয়ে কোথায় পড়ে! বোকারা জানে না।

অথচ এক স্বাক্ষাতকারে অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান বলেন, ‘৭৫ পর্যন্ত যদি আমরা দেখি, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যে ভিত-ভ‚মি বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন। সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থাকে শুধু পুনর্গঠনের জন্য একটা দর্শন দিয়েছিলেন। সেই দর্শনম‚খি শিক্ষা যেন আমরা পাই, অনেক কিছুই চ‚ড়ান্ত করে ছিলেন তিনি।’

তাদের ভাষ্যে শিক্ষার মান, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার মান, ধ্বসে পড়লেও, শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে অবিশ্বাস্যরূপে। মূল্যবোধের সংকটটা দেখে না। প্রসঙ্গত সময়কে কারা কীভাবে যে দেখে বোঝা মুসকিল। যাই হোক সাধারণ মানুষের এমন শত বেদনার গল্প কেবলমাত্র শিল্প সমাজ থাকে, কেউ রাখে না তাদের খোঁজ।

ঐতিহাসিত সত্য, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ আরও অনেক কিছু যার জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু ত্যাগের হিসাব কে দিবে! বুঝাবে কে কাকে! তবু বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা পাচ্ছে, তা আনন্দের সংবাদ। স্বাধীনতার অর্ধশতক পরে একদিকে যেমন মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে অন্যদিকে সমাজে শ্রেণিবৈষম্য বেড়েছে সাগর সমান দ‚রত্বের বহরে। প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি কিংবা মাথাপিছু আয় অর্থনৈতিক সক্ষমতার স‚চক হলেও আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রভাবে বাংলাদেশের সমাজেও ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে, বেড়েছে সামাজিক অস্থিশীলতা এবং নিরাপত্তাহীনতা।

স্বাধীনতার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর, এখনো মৌলিক অধিকার মিটেনি। সাধারণ মানুষের মধ্যে হাহাকার প্রাত্যহিক। বিশেষ করে শিক্ষা ও চিকিৎসা সমস্যা জটিলতর। বহুমাত্রিক সংকটে গুরুত্বপ‚র্ণ বিষয়গুলো খুব সহজে এড়িয়ে যাচ্ছে।

যেমন করোনা প্রমাণ করে দিলো, টাকা থাকলেই বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ নেই। অথচ তার আগে আমরা দেখেছি দেশের শীর্ষ ব্যক্তিরা হাল্কা অসুখেই অস্থির হয়ে বিদেশে যান। আর দেশে ফিরে চেতনার বুলি আওড়ান। এসব এক ধরনের প্রতারণা। এর মধ্যে দেশের প্রচলিত ব্যবস্থায় জালিয়াতির ঘটনা ত হরহামেশে আছেই।

গণমাধ্যমে আসছে, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ৭০টি বিভাগের ৩০টিতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো শিক্ষকই নেই। বিভিন্ন বিভাগে অধ্যাপকের ৪২টি পদের অনুমোদন থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৪ জন। ৩৮টি বিভাগে নেই বিভাগীয় প্রধান। এর বাইরে সহযোগী অধ্যাপকের ৫৬টি পদের ৪১টি, সহকারী অধ্যাপকের ১১১টি পদের ৬১টি, প্রভাষকের ৬৯টি পদের ৪৪টি শ‚ন্য। এছাড়া, মেডিকেল অফিসারের মোট ২৯০টি পদের মধ্যে ১৯০টি পদই শ‚ন্য (দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ নভেম্বর ২০২১)।

ভয়াবহ অব¯’া। আহহা রে দেশ। কেউ কী জানে এ-সব! শিক্ষা কার্যক্রম এবং সংলগ্ন হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা যে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এইভাবে সারাদেশে প্রায় একই চিত্র। আর ঢাকার যে কোনো সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে গেলে দেখবেন ভীড় কেমন। অভিজ্ঞতা বলে, সারাদেশের বড় বড় হাসপাতালগুলোরও একই অবস্থা। বেসরকারিতে টাকার পাহাড়!

ফলত কখনো কখনো রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাণ যায় যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রায় সবগুলো সরকারি হাসপাতালে জনবলের ঘাটতি আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে খাত জীবন রক্ষাকারী সেবা দেয়, মানুষের জীবন-মরণ যে সেবার ওপর নির্ভরশীল, সেই খাতে নিদারুণ অবহেলা কেন? এতো শুন্যপদ থাকে কীভাবে? কেউ কী দেখার নেই। জবাবদিহি সংস্থা কী করে!
মনে রাখবেন বিপদে অপারগ হয়ে সাধারণ মানুষও দেশের বাহিরে যায়। ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা নিতে। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, অথচ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হলে সেটাও সাশ্রয় হতো। আয় হতো দেশের…

কর্তৃপক্ষ দায় ও দায়িত্ব অনুভব করলে দেশের অভ্যন্তরে স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত করতো। তা না করে ব্রিজ, রাস্তা, সড়ক মহাসড়ক উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে জানান দিচ্ছে। একদিন এই উন্নয়নের নিচে চাপা পড়ে কতো ‘উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ হারিয়ে যাবে রানাপ্লাজার মতোÑ কেউ জানে না। তাই এখনই জরুরী সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থকো সাজানো ও শিক্ষার প্রায়োগিক দিক নিয়ে ভাবা।

লেখক : কবি, গবেষক ও সম্পাদক কালের ধ্বনি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!