দৈনিক ফেনীর সময়

জীবনের কান্ডারী

জীবনের কান্ডারী

প্রফেসর কামরুন নাহার

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আর সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত যে জিনিসটি চোখের আড়াল করা যায় না তাকে কি বলা যায় ভেবে পাচ্ছি না। ছোট বড় সবার কাছে খুবই জনপ্রিয় ও প্রিয়বস্তু এখন সেটি। নাম তার মোবাইল।

মোবাইল একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম। খুব সহজে দূরের সাথে যোগাযোগ করা যায়। একসময় যখন এটি ছিল না তখন দূরে যোগাযোগ করা হতো চিঠিপত্র, ফ্যাক্স ও টেলিগ্রাম এর মাধ্যমে। খবর পৌঁছাতে কয়েক দিন সময় লেগে যেত। আশির দশকে আমরা দেখেছি কোন সংবাদ বা খবরাখবর চিঠিপত্রের মাধ্যমে জানানো হতো। জরুরি প্রয়োজন হলে টেলিগ্রাম, ফ্যাক্স বা লোক পাঠিয়ে খবর পৌঁছানো হতো। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল আবিষ্কৃত হয়।

মোবাইল ফোন আবিষ্কার করেন ড. মার্টিন কুপার ১৯৭৩ সালে। সেই সময় মার্কিন আবিষ্কারক ড. মার্টিন কুপার মটোরোলা কোম্পানিতে কাজ করতেন। তাই মটোরোলা কোম্পানি প্রথম মোবাইল ফোন বাজারে আনতে সক্ষম হয়। যেটার ওজন ছিল এক থেকে দুই কেজি। প্রথম ফোনের দাম ছিল ২৭০০ মার্কিন ডলার অর্থাৎ দুই লক্ষ টাকা। তারপর চলে মোবাইল ফোনের উন্নতির কাজ। মোবাইল ফোন প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসে ১৯৮৩ সালে নাম মটোরোলা ডায়না টি এস ৮০০০ এক্স । দাম অনেক বেশি থাকায় সাধারণ মানুষের ক্রয় করা অসম্ভব ছিল। শুধুমাত্র বড়লোক ধনী ব্যক্তিরা এটি ব্যবহার করত। এই ফোনে শুধু কথা বলা ও মেসেজ পাঠানো যেতো। তখন মোবাইল ফোনকে সেলফোন বলা হত কারণ ফোনটি সেল টাওয়ার ব্যবহার করে চালানো হতো। বাংলাদেশের ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে মোবাইল ফোন চালু করে হাচিসন বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড (ঐইঞখ)। তারপর সিটিসেল বাংলাদেশ ও এশিয়া মহাদেশে প্রথম মোবাইল অপারেটর হিসেবে কাজ করে।

১৯৯৯ সালে গ্রামীণফোন সুলভ মূল্যে মোবাইল সেবা নিয়ে আসে। তখন থেকে উচ্চ মূল্য হলেও অনেকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। এখন বাজারে অনেক প্রকার ফোন বেরিয়েছে যেমন সেলফোন, এন্ড্রয়েড ফোন, স্মার্ট ফোন, টাচ ফোন। দাম ও গরিব-ধনী সবার নাগালের মধ্যে। এখন মোবাইল দেশের আনাচে-কানাচে যত্র তত্র ব্যবহার হচ্ছে। মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে যেখানে সেখানে যাওয়া যায়। সব জায়গায় এটা ব্যবহার করা যায় খুব সহজে। মোবাইল ফোনের অনেক ভালো দিক রয়েছে। যেমন, মোবাইল এর মাধ্যমে সহজেই যেকোন সংবাদ দূরে পৌঁছানো যায়। আত্মীয়-স্বজন ও ছেলে মেয়ে বাহিরে গেলে খুব সহজে খোঁজ খবর নেওয়া যায়। ইন্টারনেট এর মাধ্যমে গান শোনা, ছবি উঠানো, ভিডিও দেখা, দেশ-বিদেশের সংবাদ, অফিস-আদালতে মেইল পাঠানো, রোড ম্যাপ ব্যবহার করে দূর-দূরান্তের রাস্তা দেখা যায়, রাস্তাঘাটে যানজটের কি অবস্থা অগ্রিম জানা যায় ঘরে বসে, মোবাইলে সংবাদ পড়া ও দেখা যায়, ঘড়ির সময়, ক্যালেন্ডার দেখা যায়, ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে হিসাব নিকাশ করা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক কাজ করা যায়, যে কোন কিছু জানার প্রয়োজন হলে এই মোবাইল থেকেই জানা যায়, বেকারদের জন্য চাকরির খোঁজখবর পাওয়া যায়, এখানে আয় উপার্জন করার অনেক মাধ্যম রয়েছে,পুলিশের যেকোনো তদন্তকাজে মোবাইল ফোন এবং এর কল লিস্ট বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। মোটকথা এই মোবাইল আমাদের অনেক কিছুই সহজ করে দিয়েছে।

কিন্তু এত প্রয়োজনীয় একটি জিনিস তার সঠিক ব্যবহারের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় বা খারাপ কাজে অনেক ব্যবহার হচ্ছে। কিশোর-কিশোরী যুবক-যুবতী স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছেলে-মেয়েদের হাতে এখন এন্ড্রয়েড ফোন, স্মার্ট ফোন এবং অনেক দামি দামি ফোন। অভিভাবকরা ছেলে-মেয়েদের স্কুল কলেজে যাওয়ার সময় এ ধরনের মোবাইল হাতে দিয়ে পাঠানো মোটেও ঠিক নয়। এরা স্কুলে , কলেজে পৌঁছেছে কিনা, না মোবাইল নিয়ে বাইরে ঘোরাফেরা করছে কিনা তা কিন্তু অভিভাবকরা জানে না। এটা তাদের ভালোর চেয়ে খারাপের দিকেই বেশি প্রভাবিত করে। এ বয়সে এত দামি মোবাইল হাতে না দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব ছেলে মেয়েরা মোবাইলে আসক্ত হলে তার ভবিষ্যত জীবনের ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে।

মোবাইলের যেমন ভালো দিক আছে তেমনি অনেক খারাপ দিক ও রয়েছে। যেমন মোবাইলে অনর্থক বেশি কথা বলা, ভিডিও দেখা, এসএমএস করা, গেম খেলা, চ্যাটিং করা, অশ্লীল ছবি দেখা, অপ্রয়োজনে ফেসবুক নিয়ে বসে থাকা, কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা। এ সবকিছু ছাত্র ছাত্রীদের অমনোযোগী করে, দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে যায়, মুরব্বিদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করা ভুলে যায়, এদের মূল্যবোধ ও সময় জ্ঞান হারিয়ে যায়, ফলে নৈতিক অবক্ষয় ঘটে। এসব ছেলে-মেয়েদের হাতে মোবাইল দিতে হলে তাকে মোবাইলের ভালো মন্দ সম্পর্কে বুঝাতে হবে। স্কুল-কলেজ পড়–য়া সন্তানদের সময়েসময়ে খেয়াল রাখতে হবে, ওরা মোবাইল নিয়ে কি কাজ করছে, খারাপ দিকে ব্যবহার করছে কিনা, সন্দেহ হলে ব্যবস্থা নিতে হবে আর তা এখন থেকেই।

মোবাইল এর মাধ্যমে খারাপ মানুষ অন্য মানুষকে বø্যাকমেইল করছে, প্রতারণা করছে, ভুয়া কল দিয়ে বিরক্ত করছে, প্রতারক চক্র ফাঁদ পেতে প্রতারণার বিভিন্ন কৌশল বের করে প্রতারণা করছে এবং বিভিন্ন ভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব নানা অপকর্ম থেকে রক্ষা পেতে হলে মোবাইল ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। আবার এটি অতিরিক্ত ব্যবহারে নানা রকম শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে যেমন, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, স্নায়ুর সমস্যা, মানসিক চাপ, ব্যাক পেইনের সমস্যা, হাতে ব্যথা, মাথা ব্যথা, ঘুমের ব্যাঘাত ইত্যাদি।

আমাদের যোগাযোগ রক্ষার্থে এবং নানা জরুরি প্রয়োজনে মোবাইল সব সময় কাজে লাগে। মোবাইল নিয়ে যাতে অস্বস্তিতে পড়তে না হয় তার ব্যবহার জানতে হবে। বাড়িতে অতিথি এলে বা আড্ডায়, সমাবেশে থাকলে ফোন ধরতে হলে ‘এক্সকিউজ মি’ বা মাফ করবেন বলে ফোন ধরা। বেশি সময় ধরে কথা না বলে সংক্ষিপ্ত করা। কোন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, ব্যাংক, বীমা, অনুষ্ঠান, উপাসনালয়, হাসপাতাল, ডাক্তারের চেম্বার, চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় ফোন বন্ধ রাখা বা সাইলেন্ট করে রাখা। মোবাইলে উচ্চস্বরে বা চিৎকার করে কথা না বলা। রাস্তা পার হওয়ার সময় কিংবা ফুটপাতের ভিরে, চলন্ত গাড়ির জানালার পাশে বসে মোবাইলে কথা না বলা। ফোনের অপব্যবহার করা ঠিক নয়, অন্যের অজান্তে ছবি তোলা, ভিডিও করা, কল রেকর্ড করা আইন সম্মত নয় এবং নিম্ন রুচির পরিচায়ক ও ঘৃন্যতম কাজ।

আজকাল মোবাইলে অনলাইন ব্যবসা অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়াগুলো ব্যবহার করে অনেক মানুষই ব্যবসা-বাণিজ্য করে ভালো অর্থ উপার্জন করছে এবং সফল হয়েছে। অনেক গ্রাহক ঘরে বসে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করে অনেক উপকৃত হচ্ছে। মোটকথা মোবাইল আমাদের চলার পথের নিত্য সঙ্গী। এর ব্যবহার এখন সর্বস্তরে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে মোবাইল ফোনের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছে। অধিক মূল্য স্বল্পমূল্য সুবিধাজনক মূল্যে ও আকর্ষণীয় শর্তে পাওয়া যায় বলে এখন সর্বস্তরের মানুষ ব্যবহার করছে। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের কাছে এর ব্যবহার অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে এর ব্যবহার ও সুফল আরও বৃদ্ধি পাবে। মোবাইল এর খারাপ দিকগুলো বর্জন করে ভালো দিকগুলো গ্রহন করাই সবার জীবনের প্রত্যাশা হোক। বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম এর সুবিধা নিয়ে এবং যুগোপযোগী ব্যবহার করে দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দেশের জনগণের মুখে হাসি ফোটাবে। দেশ ও বিশ্বকে আরও সমৃদ্ধশালী করবে।

লেখক : অধ্যক্ষ, সরকারি জিয়া মহিলা কলেজ, ফেনী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!