-মাহমুদুল হক
রহমত, বরকত, মাগফিরাত আর নাজাতের অফুরন্ত বার্তা নিয়ে মাহে রমাদান আমাদের মাঝে সমুপস্থিত। এ মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে প্রত্যেকটি মুমিন তাকওয়ার প্রশিক্ষণ নেয়। আত্ম-উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এক অনন্য সুযোগ লাভ করে। গোটা মুসলিম উম্মাহর সর্বত্র শৃঙ্খলা, সাম্য, মানবিকতা ও খোদায়ী রঙ্গে জীবন রাঙ্গানোর ফল্গুধারা বয়ে যায়।
রমাদান হিজরী সনের নবম মাস। ইহা আরবি রমদুন শব্দ থেকে গঠিত। রমদুন মানে ঝলসানো, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিখাদ করা। এ মাসের নামকরণ করা কালে গ্রীষ্মের দাবদাহে মরু সাইমুমের আঘাতে ঝলসানো প্রকৃতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তি সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তার গুনাহগুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিখাদ মুসলিমে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে বিধায় একে রামাদান বলা হয়। তাই রমাদান হচ্ছে সিয়াম সাধনার মাস, তাকওয়ার মাস, প্রশিক্ষণের মাস, আত্মোন্নয়নের মাস ও মানুষের প্রতি মানবিক আচরণ শেখার মাস।
রাসুল (সা.) এর নবুয়্যতে জিন্দেগীর পঞ্চদশ বছরে অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরী সনে আল্লাহ তায়া’লা রমাদান মাসে সিয়াম সাধনা করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য ফরজ করে দেন। ইতোপূর্বে সাওমের সংখ্যা কম-বেশ বা পালনরীতির তারতম্য থাকলেও সকল নবী-রাসুলের শরীয়তে সিয়াম পালনের নিয়ম চালু ছিল। রাসুল (সা.) এর শরীয়তে বর্তমানে প্রচলিত নিয়মে মাসব্যাপী সিয়াম পালনের বিধান চালু হয় এবং তা পূর্ণতা লাভ করে। আরবী মাস ২৯ বা ৩০ দিনে হয় বিধায় সাওমের সংখ্যাও ২৯ বা ৩০টি হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়া’লা বলেন- “হে ঈমানদাগণ! তোমাদের ওপর সাওম (রোযা) ফরয করে দেয়া হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। এ থেকে আশা করা যায়, তোমারা তাকওয়া অর্জন করবে।” (সূরা বাকারা- ১৮৩)
ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় রমাদান মাসের গুরুত্ব অনেক বেশী। কারণ এ মাসে কুরআন অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তায়া’লা বলেন- “রমাদান তো সে মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানব জাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত, যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়। কাজেই এখন থেকে যে ব্যক্তি এ মাসের সাক্ষাত পাবে তার জন্য এই সম্পূর্ণ মাসটিতে রোযা রাখা অপরিহার্য।” (সূরা বাকারা- ১৮৫)
এ মাসে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম লাঈলাতুল ক্বদর (মহিমান্বিত রজনী) বিদ্যমান। আর ক্বদরের রাতেই আল্লাহ কুরআন নাজিল করেন। আল্লাহ বলেন- “আমি এ (কুরআন) নাযিল করেছি ক্বদরের রাতে। তুমি কি জানো, ক্বদরের রাত কি? ক্বদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশী ভালো। ফেরেশতারা ও রূহ এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত।” (সূরা আল-ক্বাদর : ১-৫)
দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যাকে আল্লাহ তায়া’লা ইয়াওমুল ফুরকান বা হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ৮ম হিজরীর ১০ই রমজান ঐতিহাসিক ফাতহে মক্কা বা মক্কা বিজয় হয়। এতে করে এ মাসের গুরুত্ব আরো বেড়ে গিয়েছে।
নিচের হাদীসগুলো থেকেও রমাদান ও সিয়াম সাধনার গুরুত্ব ও ফজিলত উপলব্ধি করা যায় : আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত : আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “রামাদান আসলে রহমতের দরজাসম‚হ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসম‚হ বন্ধ করে দেয়া হয়, শয়তানগুলোকে শিকলবন্দী করে দেয়া হয়। (সহিহ মুসলিম- ২৩৮৬)
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত : আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “(গুনাহ থেকে আত্মরক্ষায়) সাওম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং (রোযাদার) অশ্লীল কাজে জড়াবে না এবং মূর্খের মত কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, সে যেন দু’বার বলে, আমি সওম পালন করছি। সে সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই সওম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ্র নিকট মিসকের সুগন্ধির চাইতেও উৎকৃষ্ট, সে আমার জন্য আহার, পান করা ও যৌন সংগম পরিত্যাগ করে। সাওম আমারই জন্য। তাই এর পুরস্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশ গুণ।” (সহিহ বুখারী- ১৮৯৪)
সাহল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন- জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন সওম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবে, সওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পর পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে। (সহিহ বুখারী- ১৮৯৬)
রমাদান গুনাহ মাফ নেয়ার এক অবারিত সুযোগ এনে দেয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদ্রে ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করে, তার পেছনের সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রামাদানে সিয়াম পালন করবে, তারও অতীতের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হবে।” (সহিহ বুখারী-১৯০১)
রমাদানে গুরুত্বপূর্ণ বরকত হলো সাহরীতে। আহলে কিতাব ও মুসলিমদের সাওমে পার্থক্য হলো সাহরী খাওয়া এবং সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা। প্রত্যেক মুমিনের উচিৎ সে বরকতের অংশিদার হওয়া। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, “তোমরা সাহরি খাও, কারণ সাহরিতে বারাকাত রয়েছে।” (সহীহ মুসলিম- ২৪৩৯)
আমর বিন আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, “আমাদের ও কিতাবিদের সিয়ামের পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া।” (সহীহ মুসলিম- ২৪৪০)
সাহল বিন সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, “যত দিন মানুষ বিলম্ব না করে ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে।” (সহীহ মুসলিম- ২৪৪৪)।
রামাদানের সাথে কুরআনে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। রমাদানে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ায় রাসুল (সা.) বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করতেন এ মাসে। জিব্রাইল (আ.) রাসুল (সা.) কে তেলাওয়াত করে শুনাতেন রাসুল (সা.) মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। আবার রাসুল (সা.) তেলাওয়াত করলে জিব্রাইল শুনতেন। তারাববিহর সালাতের বিধানটাও হয়েছে কুরআন তেলাওয়াতে সুযোগ অবারিত করার জন্য। তাই রমাদানে কুরআন পড়া, কুরআন সহীহ-শুদ্ধ করা, কুরআন বুঝা এবং কুরআন ভিত্তিক জীবন গড়ায় সকল মুমিনের মনোযোগী হওয়া উচিৎ। তদুপরি কুরআনের আইন সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করাই রমাদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। রাসুল (সা.) বদরের যুদ্ধে সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বলেন, “আজ যুদ্ধের দিন তোমরা সাওম ভেঙ্গে ফেল।” এতে বুঝা যায় কুরআন ভিত্তিক দ্বীন কায়েমের কাজ এবং এর জন্য জিহাদ করা সাওমের চাইতেও বড় ফরজ।
আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভাল বাসেন। রমজান মুমিনদেরকে মুহসিন হতে শিক্ষা দেয়। মুহসিন হচ্ছে আল্লাহকে না দেখে ও আল্লাহ সবকিছু দেখছেন সর্বদা এ অনুভ‚তি অন্তরে জাগ্রত রেখে জীবন পরিচালনা করা। মাস ব্যাপী সিয়াম সাধনা মুমিনের অন্তরে এ ভাবের সৃষ্টি করে। কারণ মুমিন ক্ষুৎ পিপাসায় কাতর হওয়ার পরও আল্লাহর ভয়ে পানাহার করেনা। সে মনে করে আল্লাহ আমার দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছু দেখছেন। ইহসানের আরেক অর্থ হচ্ছে দয়ার্দ্র হওয়া, সদাচরণ করা। একজন গরিব ক্ষুধার জালায় কি পরিমাণ কষ্ট পায় রোযাদার সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তা অনুভব করে। ফলে সে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি দরদী হয়। মানব কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করে। রাসুল (সা.) রমাদােেন দানশীলতায় প্রবাহিত বায়ু থেকেও গতিশীল হয়ে যেতেন। কারণ এ মাসে প্রতিটি দানে সাতশত গুণ সাওয়াব পাওয়া যায়।
রমাদান মুমিনকে সততা শিক্ষা দেয়। আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত : আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই।” (সহিহ বুখারী- ১৯০৩)
রামাদানের একটি মৌলিক শিক্ষা হচ্ছে সবর। সিয়াম সাধনা মুমিনকে ধৈর্যশীল করে তোলে। এটা মাসব্যাপী ধৈর্যের প্রশিক্ষণ। রাসুল (সা.) বলেন- “রামাদান হচ্ছে ধৈর্য ও সংযমের মাস। আর সবরের পুরস্কার হচ্ছে জান্নাত।” (সহীহ ইবনে খুযাইমা)
আবু সা’ঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ তাকে সবর দান করেন। সবরের চেয়ে উত্তম ও ব্যাপক কোন নি’আমত কাউকে দেয়া হয়নি।” (সহিহ বুখারী- ১৪৬৯)।
অপর হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “রোযা সবর ও সহিষ্ণুতার অর্ধেক এবং পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।” (জামে আত-তিরমিজি- ৩৫১৯)।
ধৈর্য তিন প্রকার। (১) আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে কষ্ট স্বীকারে ধৈর্য, (২) আল্লাহর নিষিদ্ধ ও হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকার জন্য যে কষ্ট হয় সে ব্যাপারে ধৈর্য, (৩) তাকদীরের কষ্টদায়ক জিনিসের মোকাবেলায় ধৈর্য ধারণ করা। সিয়াম সাধনায় সবগুলো ধৈর্যের প্রশিক্ষণ পাওয়া যায়।
রমাদানে সিয়াম সাধনা শেষে ইফতার মুমিনের চিত্তকে পুলোকিত করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত : আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “রোযা পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দ আছে- একটি আনন্দ যখন সে ইফ্তার করে এবং আরেকটি আনন্দ যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করবে। (ইবনু মাজাহ ১৬৩৮)।
রমাদান আল্লাহর সাথে বান্দাহর সম্পর্ক নিবিড় করে দেয়। সারাদিন সিয়াম সাধনা শেষে বান্দাহ যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত তখন রাতের প্রথম ভাগে সালাতুত তারাবিহ ও শেষভাগে কিয়ামুল লাঈল আদায়ে আত্মনিয়োগ করে। আল্লাহর প্রতি নিতান্ত অনুরাগ ও ভালবাসা ছাড়া পরকালীন জীবনে সাফল্যের মোহে বিভোর ব্যক্তি ব্যতীত এ কাজ তো সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।
রমাদান আত্মিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতার জন্য অনন্য সুযোগ এনে দেয়। শরীরের ম্যাকানিজমকে করে রিফ্রেশ। তাই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান নানা রোগের চিকিৎসায় অটোফ্যাজি বা উপবাস পালনের পরামর্শ দেয়। তবে কোন মুমিন শারীরিক সুস্থতার নিয়তে বা ডায়েট করার মানসে রোজা পালন করেনা। করলে তা আর সিয়াম সাধনা হবেনা। কারণ রাসুল (সা.) বলেন, “নিশ্চয়ই যাবতীয় কাজের প্রতিদান তার নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল।” রোজাতে নিয়তও ফরজ।
রমাদানের মূল উদ্দেশ্য হলো মুমিনকে মুত্তাকীর গুণে ভ‚ষিত করা। ইমাম গাজ্জালীকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘মুত্তাকী কে?’ তিনি জবাবে বলেন, “যে ব্যক্তি শিরক ও যাবতীয় গুনাহর কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পেরেছে সে মুত্তাকী।”
হযরত ওমর ফারুক (রা.) উবাই ইবনে কা’ব (রা.) কে জিজ্ঞেস করেন, “তাকওয়া কি?” উবাই (রা.) জবাবে বলেন- “আপনি কি কাঁটায় ঘেরা বন অতিক্রম করেছেন কখনো? ওমর (রা.) বলেন, “করেছি।” উবাই (রা.) পূণরায় প্রশ্ন করেন, “কিভাবে?” জবাবে ওমর (রা.) বলেন, “আমি খুব সতর্কতার সাথে পা বাড়াই যাতে কাঁটা গায়ে না বিঁধে এবং আমার কাপড় ছিঁড়ে না যায়।” উবাই (রা.) বলেন, “ঠিক তেমনি আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে ও তাঁর কাছে জবাবদিহীর অনুভ‚তি নিয়ে সতর্কতার সাথে দুনিয়াতে জীবন যাপন করাই হলো তাকওয়া।”
আল্লাহ নিজেই তাকওয়ার ভেরিফাইড সংজ্ঞা দিয়েেেছন সূরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতে। “তোমাদের মুখ পূর্ব দিকে বা পশ্চিম দিকে ফিরাবার মধ্যে কোন পূণ্য নেই। বরং নেক কাজ হচ্ছে এই যে, যারা আল্লাহ তায়া’লা, কিয়ামতের দিন, ফেরেশতা, আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব ও নবীদের প্রতি ঈমান আনবে এবং আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রাণপ্রিয় ধন-সম্পদ আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও ক্রীতদাসদের মুক্ত করার জন্য ব্যয় করবে। আর নামায কায়েম করবে এবং যাকাত আদায় করবে। আর যা অংগীকার করে তা পূর্ণ করবে এবং বিপদে-অনটনে ও হক-বাতিলের সংগ্রামে সবর করবে, তারাই সৎ ও সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই মুত্তাকী।
এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, (ক) ঈমান, (খ) মানব কল্যাণে দান-খয়রাত, (গ) সালাত কায়েম, (ঘ) যাকাত আদায়, (ঙ) অংগীকার পূর্ণ করা ও (চ) সবর কমপক্ষে এ ছয়টি গুণ যার আছে সে ঈমানদার ও মুত্তাকী। রমাদান একজন মুমিনকে সবগুলো বিষয়ের ট্রেনিং দিয়ে মুত্তাকী হিসেবে গড়ে তোলার কর্মসূচী রেখেছে। কিন্তু খাবার যত উপাদেয় হোক, পরিবেশন যত সুন্দর হোক, পরিবেশ যত মনোমুগ্ধকর হোক গ্রহণকারী যদি মনোযোগ না দেয় সে আয়োজন যেমন ব্যর্থ হয়, ঠিক তেমনি মুমিন সিয়াম সাধনার প্রশিক্ষণকে তার জীবনধারা ও জীবন চেতনা পরিবর্তনে যদি কাজে না লাগায় তাহলে ফি বছর রমাদান আসবে আর যাবে কিন্তু তারা কোন ফায়দা লাভ করতে পারবেনা।
রাসুল (সা.) লাঈলাতুল ক্বদর অন্বেষণ করার জন্য রমাদানের শেষ দশকে ইতেকাফ পালন করতেন, উম্মতকেও উৎসাহিত করেছেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা রমাদানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদ্রের অনুসন্ধান কর।” (সহিহ বুখারী- ২০১৭)।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন রমাদানের শেষ দশক আসত তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশী বেশী ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্র জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (সহিহ বুখারী- ২০২৪)।
কিন্তু আফসোসের বিষয় মুসলিম সমাজ রমাদানের শেষ দশকে ঈদের কেনাকাটার নামে ব্যাপক বেপর্দায় চলাফেরা, গভীর রাত পর্যন্ত শপিং করা ও গল্পগুজবে সময় নষ্ট করায় মত্ত থাকে। সিয়াম সাধনা, সালাতুত তারাবিহ আদায়, কুরআন অধ্যয়ন ও ক্বিয়ামুল লাঈল আদায়ে চরম ঢিলাঢালা হয়ে যায়। আগামী রমাদান পর্যন্ত কে বাঁচি কে মরি তার কোন ঠিক নেই। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যে উদ্দেশ্যে ও যেভাবে সিয়াম সাধনার নির্দেশ দিয়েছেন তা যথাযথভাবে পালন করে পরকালীন সাফল্য লাভ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন।
লেখক : উপাধ্যক্ষ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।