মেহেদী হাসান মেশকাত
আমরা আমাদের প্রত্যহ জীবনের দিকে তাকালেই দেখব, যে ব্যক্তির সাথে আমি আমার মনের সব কথা বলতে পারি, দুঃখ-কষ্ট, সুখের গল্প গুলো বলতে পারি, একসাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গেলেও বিদায় নিতে ইচ্ছে করে না,সেই ব্যক্তিই আমাদের খুব প্রিয় হয়ে থাকে। আল্লাহর সাথে বান্দারও তখনই খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে হবে যখন কিনা বান্দা তার মালিকের সাথে একসাথে একান্ত সময় কাটাতে পারে,মনে খুলে মনের কথাগুলো বলতে পারবে, দুঃখ-কষ্ট,সুখের গল্প করতে পারবে।
ব্যক্তির সাথে কথা বলতে, সময় কাটাতে পূর্বে পরিকল্পনা নিতে হয়। কিন্তু মহান রবের সাথে মন খুলে,দুঃখ-কষ্টের কথাগুলো বলতে কোন সময় প্রয়োজন হয় না। পবিত্র কুরআনের সূরা মূমিনের ৬০ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো,আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব’।
আল্লাহর কাছে মনের আকুতি গুলো বলতে, মন খুলে কথা বলার কোন সময় বা অনুমতি প্রয়োজন হয়। তাইতো রবের কাছে যে যেত চাইতে পারে, আল্লাহ তাকে দিতেও চাওয়ার থেকে বেশি দিয়ে থাকেন।
এই চাওয়ার পাওয়া গুলো আরো বেশি রবের বরকতময় করে পেতে হলে রাব্বে কারিমের স্পেশাল মূহুর্তে দুই হাত তুলা উচিৎ। রাব্বে কারিম বান্দার সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি হয় রাতের শেষাংশে। বুখারীর হাদীসে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা প্রতিদিন রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব! কে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে দান করব! আর কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করব!’
সূরা আল ইমরানের ১৭ আয়াতে শেষাংশে আল্লাহ আরো বলেন,আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ভুলত্রুটির ক্ষমাপ্রার্থী’।
কুরআন ও হাদীসের আলোকে, আমরা শেষ রাত্রের নামাজকে তাহাজ্জুদ বলে থাকি। আমরা আমাদের এই দুনিয়ায় জীবনে প্রতিনিয়ত কর্মব্যস্ততার কারণে ফলে নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তে পারি না। এবং বছরের দশমাস রাত ছোট বলে অথবা বিভিন্ন কারণে দেরীতে ঘুমাই,যার ফলে তাহাজ্জুদে রবের সামনে জায়নামাজে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু বান্দার জন্য আল্লাহ স্পেশাল বসন্ত স্বরূপ শীতকাল রেখেছেন। শীত, এটি মুমিনের ইবাদত করার বসন্তকাল।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-‘শীতকাল হচ্ছে মুমিনের বসন্তকাল।’ (মুসনাদে আহমাদ ১১৬৫৬) বায়হাকির এক বর্ণনায় এসেছে, ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মুমিন রাতের সময় নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখতে পারে।’ (বায়হাকি ৩৯৪০)
অন্য হাদীসে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- ‘শীতকাল ইবাদতকারীদের জন্য গণীমত (ইবাদত করার চমৎকার মৌসুম)।’ (আবু নুআইম)
শীতকাল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত। মানুষের জন্য বরকত নিয়ে আসে এ ঋতু। শীতের দিন ও রাতে মুমিন মুসলমান ইবাদত-বন্দেগির সুযোগ পায়। এ প্রসঙ্গে এসেছে- হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়ল্লাহু আনহু বলেন- ‘শীতকালকে স্বাগতম । এ সময় (আল্লাহর পক্ষ থেকে) বরকত নাজিল হয়। রাত হয় লম্বা। তাই তাহাজ্জুদ পড়া সহজ। দিন হয় ছোট। তাই রোজা রাখা সহজ।’ (লাতা ইফুল মাআরিফ, আল্লামা ইবনে রজব)
শীতকাল ইবাদতের গণীমতও বটে। এ কারণে হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু লোকদের বলতেন- ‘আমি কি তোমাদের শীতকালীন গণীমতের সন্ধান দেব না? তারা বলতো, অবশ্যই! এরপর হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, শীতের মৌসুমে রোজা। (তিরমিজি)
বিখ্যাত তাবেয়ি হজরত হাসান বসরি রাহমাতুল্লাহু আলাইহি বলেছেন- ‘একজন মুমিনের জন্য শীতকাল ইবাদত করার চমৎকার মৌসুম। শীতকালে রাত লম্বা হয়। এতে সে (সহজেই) তাহাজ্জুদ পড়তে পারে। দিন ছোট হয়। ফলে (সহজেই) রোজা রাখতে পারে। এজন্যই (আগের লোকদের মধ্যে) যাঁরা ইবাদত-বন্দেগিতে কঠোর পরিশ্রম করতেন তাঁরা যদি (কোনো কারণে) এ সময়ের রাতগুলোতে তাহাজ্জুদ না পড়তে পারতেন এবং দিনের বেলা রোজা না রাখতে পারতেন তাহলে এর জন্য তাঁরা কাঁদতেন।’
বান্দা রবের স্পেশাল সময় পেতে চাই,হৃদয়ের সকল কথা বলতে চাই মনে খুলে তাহলে শীত কালের মতো এতো চমৎকার দীর্ঘ সময় অন্য কোন মাসে পাওয়া অনেক কঠিন।
শীতকালে আমরা যদি রাতের প্রথমাংশে পরিকল্পিত ভাবে ঘুমাতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য তাহাজ্জুদের এই চমৎকার নিয়ামত ভোগ করতে পারবো। বান্দা রবের সাথে পরিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, হৃদয় চাওয়া গুলো মন খুলে বলতে পারবে তাহাজ্জুদের সিজদায়। তাতেই হতে পারবো রবের প্রিয় বান্দা।
সূরা ফুরকানের ৬৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।’ তাই, এই শীতকালকে আমরা আমাদের জীবনের সেরা বসন্ত হিসেবে পালন করবো। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে এই ঋতুতে বেশি বেশি ইবাদত করে চিরস্থায়ী জীবনের জন্য সম্বল করে রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।