দৈনিক ফেনীর সময়

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন এর কারণ , লক্ষণ ও প্রতিকার

উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন এর কারণ , লক্ষণ ও প্রতিকার

অনলাইন ডেস্কঃ

আজকাল হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ দুঃখজনকভাবে হলেও একটি পরিচিত নাম , পরিচিত সমস্যা । বহু মানুষই এই রোগে আক্রান্ত । এর জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ দুটোই জরুরি কেননা এটি শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করে, এমনকি হঠাৎ করে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দেয় । তাই এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া খুবই প্রয়োজন ।

উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার কি ?

কোন ব্যক্তির রক্তচাপ যখন প্রায় সময় ই স্বাভাবিকের চেয়ে উপরে থাকে, তখন তাকে হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ বলা হয় । আরেকটু বিশদভাবে বললে, যখন কারো হৃদ-সংকোচন বা সিস্টোলিক রক্ত চাপ উভয় বাহুতে ১৪০ মি.মি (পারদ) অথবা ১৪০ এর  উপরে থাকে কিংবা হৃদ-প্রসারণ বা ডায়াস্টলিক চাপ ৯০ মি.মি (পারদ) অথবা ৯০ এর উপরে থাকে,তাহলে তার উচ্চ রক্ত চাপ বলা যেতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না। এটাই উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে ভীতিকর দিক। যদিও অনেক সময় রোগীর বেলায় কোনো লক্ষণ থাকে না, তবুও নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ও চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় ।

উচ্চ রক্তচাপ এর কারণঃ

বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, তবে, সাধারণত বয়স্ক মানুষের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়ে থাকে । যেসব কারণ উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে সেগুলো হলোঃ অতিরিক্ত মোটা বা মেদ (ভুঁড়ি) , বেশি লবণ খাওয়া, বাড়তি কাজের চাপ, মদ্যপান, পরিবারের আকার, অতিরিক্ত আওয়াজ এবং জরাজীর্ণ ও জনবহুল পরিবেশে থাকা। এর মধ্যে উচ্চমাত্রার লবণের ব্যবহারকে   সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় কারণ, খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন ও চাপ বেড়ে যায়। ধারণা করা হয় প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ রোগীই বেশি লবণ খাওয়ার কারণে উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন । এছাড়াও আরো অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে , যেমনঃ

ধূমপানঃ

অতিরিক্ত ধূমপায়ী ব্যক্তির শরীরে তামাকের নানা রকম বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনি, শিরার নানা রকম রোগ ও হৃদ্রোগ দেখা দিতে পারে।

বংশানুক্রমঃ উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে সন্তানেরও এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

অলসতা বা শ্রমবিমুখতাঃ

যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রের বা হার্টের অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। তাই অধিক মোটা বা ভারী লোকদের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।

এলোমেলো খাদ্যাভ্যাসঃ

অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন—মাংস, মাখন ও ডুবো তেলে ভাজা খাবার খেলে ওজন বাড়ে। ডিমের হলুদ অংশ এবং কলিজা, মগজ এসব খেলে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল হলে রক্তনালির দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্তমানসিক চাপঃ

বয়স বাড়ারসাথে সাথে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এ ছাড়া তাঁদের অন্ধত্ব ও কিডনির নানা রকম রোগ হতে পারে। এছাড়া ও অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। যদি এই মানসিক চাপ অব্যাহত থাকে এবং রোগী ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারেন, তবে এই উচ্চ রক্তচাপ স্থায়ী রূপ নিতে পারে।

উচ্চ রক্তচাপ যেসব জটিলতা সৃষ্টি করেঃ

হাই ব্লাড প্রেশার শরীরের কয়েকটি অঙ্গে্র মারাত্মক ক্ষতি করে । এটি প্রধানত হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি করে । অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তখন দুর্বল  হৃদযন্ত্রে সঠিকভাবে রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর। রক্তনালির গাত্র সংকুচিতহয়ে হার্ট অ্যাটাক বা ইনফ্রাকশন হতে পারে।  এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে, মস্তিষ্কে স্ট্রোক হতে পারে, যা থেকে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। এ ছাড়া চোখের রেটিনাতে রক্তক্ষরণ হয়ে অন্ধ হয়ে যেতে পারে । তবে, এই জটিলতাগুলোর মধ্যে হার্টএটাকে মৃত্যুর পরিমাণ ই সবচাইতে বেশি দেখা যায় ।

উচ্চ রক্তচাপের প্রতিরোধ এবং প্রতিকার বা চিকিৎসাঃ

খাদ্যাভ্যাস বা জীবনযাত্রার পরিবর্তন এনে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বংশগতভাবে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা কমানো সম্ভব নয়। তবে এ রকম ক্ষেত্রে যেসব উপাদান নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেগুলোর ব্যাপারে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত।যেমনঃ

১) সবচাইতে জরুরী হলো ,তরকারিতে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে এবং পাতে লবণ নেয়া যাবে না ।

২) যেসব খাবারে কম চর্বি ও কম কোলেস্টেরল আছে , সেসব  খাবার খেতে হবে। যেমন—খাসি বা গরুর মাংস, কলিজা, মগজ, গিলা, ডিম কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননী তোলা দুধ, অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন—সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে। বেশি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভালো। আটার রুটি এবং সুজি-জাতীয় খাবার পরিমাণমতো খাওয়া ভালো।

 

৩) যে কোন মূল্যে ওজন কমাতে হবে । খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। একবার লক্ষ্য অনুযায়ী ওজনে পৌঁছালে সীমিত আকারে খেতে হবে এবং ব্যায়াম চালিয়ে যেতে হবে । ওষুধ খেয়ে ওজন কমানোর চেষ্টা না করাই ভালো , এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভালো।

৪) ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাক পাতা, জর্দা, গুল লাগানো ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। মদ্যপান পরিহার করতে হবে।

৫)  পরিমিত পরিমাণ পরিশ্রম করতে হবে । অলস বসে থাকা যাবেনা কোনক্রমেই । সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি করলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি একেবারেই কমে যাবে ।

৬) যাদের আছে তারা অবশ্যই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে । মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে। নিজের শখের কাজ করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে।

ওষুধঃ

উপরোক্ত ব্যবস্থাগুলো যথাযথভাবে নেয়ার পর ও যদি কারো উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না আসে , তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে অবশ্যই ওষুধ খেতে হবে । রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য বহু রকমের ওষুধ রয়েছে যেগুলো অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ নামে পরিচিত যা রক্তচাপ কমিয়ে আনে। রক্তচাপ ৫-৬ মিঃমিঃ কমালে তা স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রায় ৪০%, করোনারী হৃদরোগের ঝুঁকি প্রায় ১৫-২০% কমিয়ে আনে এবং হার্ট ফেইলিউরের সম্ভাবনাও কমে আসে। সাধারণভাবে প্রচলিত ঔষধসমূহের মধ্যেরয়েছে বিটাব্লকার, যেমনঃ metoprolol, atenolol, labetalol, carvedilol, এনজিওটেসটিন রিসিপটর ব্লকার (এ আর বি) যেমনঃ losartan, valsartan, irbesartan; আলফা ব্লকার, যেমন, terazosin এবং prazosin ইত্যাদি ।

এসব ওষুধে রক্তচাপ ১৪০/৯০ এর নিচে বা আরো নিচে নিয়ে আসে। প্রতিটি ঔষধ আলাদাভাবে সিস্টোলিক চাপ ৫-১০ মিঃমিঃ কমিয়ে নিতে পারে। তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক ঔষধের প্রয়োজনও হতে পারে । তবে, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনোই কোন ওষুধ খাওয়া যাবেনা ।

অনেক রোগী কিছুদিন ওষুধ খাওয়ার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন। মনে করেন রক্তচাপ ভালো হয়ে গেছে, কাজেই ওষুধ খাওয়ার দরকার কী? এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কোনোক্রমেই চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না। অনেকেই আবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরেও ওষুধ খেতে অনীহা প্রকাশ করেন বা খেতে চান না। এ ধরনের রোগীরাই হঠাৎ করে হৃদ্রোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে। তাই  নিয়মিত ওষুধ খাওয়া ও চেক করাতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!