নবী-রাসূলগণ হলেন মানব জাতির জন্য রহমত। তাঁরা অন্ধকার পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন। হযরত ঈসা (আ) থেকে আমাদের রাসূল (স) পর্যন্ত কোন নবী-রাসূল প্রেরিত না হওয়ায় এ যুগকে আইয়্যামে জাহেলিয়া বলা হয়। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের মহানবী (স)-কে প্রেরণ করে আমাদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন- আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। তিনি তাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন। তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও কাজের কথা শিক্ষা দেন। বস্তুত তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট (সূরা আল-ইমরান: ১৬৪)।তিনি আরো ইরশাদ করেন- আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপ করেছি (সূরা আম্বিয়া- ১০৭)। রাসূল (স.) এর কারণে আমরা কুরআন পেয়েছি, হাদীস পেয়েছি এবং দ্বীনের সঠিক পথ পেয়েছি। ফলে তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করা অপরিহার্য।
দরূদ পাঠের নির্দেশ : স্বয়ং আল্লাহ তা‘য়ালা মহানবী (স)-এর প্রতি দরূদ পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন- অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি সালাত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি যথাযত সালাত ও সালাম পেশ কর (সূরা আহযাব- ৫৬)। সালাত- আরবি শব্দ। তা একধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন- রহমত, দু’আ, দরূদ, ইসতিগফার, তাসবীহ। আল্লাহর পক্ষ থেকে হলে রহমত, বান্দার পক্ষ থেকে দরূদ, ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে ইসতিগ
ফার, দু’আ ও সম্মান অর্থ বুঝায়। সালাম অর্থ নিরাপত্তা, শান্তি। এর উদ্দেশ্য ত্রæটি, দোষ ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকা।
দরূদ পাঠের বিধান : মহানবী (স.)- এর নাম বললে ও শুনলে তাঁর প্রতি দরূদ পড়া ওয়াজিব। তবে বার বার তাঁর নাম বললে ও শুনলে প্রথমবার দরূদ পড়া ওয়াজিব, অন্যান্য বার মুস্তাহাব। মুখে উচ্চারণ করলে যেমন দরূদ ও সালাম ওয়াজিব, তেমনি কলমে লিখলেও ওয়াজিব। জীবনে একবার দরূদ পড়া ফরয। মহানবী (স.) বলেছেন- সেই ব্যক্তি আপমানিত হোক যার সামনে আমার নাম উচ্চারণ করা হলে দরূদ পাঠ করে না (তিরমিযী, মিশকাত হদীস নং ৯২৭)। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (স.) ইরশাদ করেন- সেই ব্যক্তি কৃপণ, যার কাছে আমার নাম উচ্চারণ করা হলে দরূদ পাঠ করে না (তিরমিযী, আহমদ, মিশকাত হাদীস নং- ৯৩৩)।
দরূদ পাঠের ফযিলত : দরূদ পাঠে রয়েছে অনেক ফযিলত। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন- যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তা’য়ালা তার প্রতি ১০টি রহমত বর্ষণ করেন (সহীহ মুসলিম, মিশকাত হাদীস নং- ৯২১)। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স) বলেন- যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ শরীক পাঠ করে, আল্লাহ তা‘য়ালা তার প্রতি দশটি রহমত বর্ষণ করেন, দশটি পাপ মোচন করেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন (নাসায়ী ১/১৪৫, মুসনাদে আহমদ ১/১০২)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমার কাছে অতি উত্তম হবে ঐ ব্যক্তি যে আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পাঠ করে (তিরমিযী)। মহানবী (স) আরো বলেন, জমিনে আল্লাহর একদল বিচরণশীল ফেরেশতা রয়েছে, যারা আমার উম্মতের সালাম আমার নিকট পৌঁছিয়ে দেয় (নাসারী, দারেমী)। তিনি আরো বলেন, আমার প্রতি কেউ দরূদ পাঠ করলে আমি তার উত্তর দেই (আবু দাউদ, বায়হাকী)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, কেউ আমার কবরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে সালাম দিলে আমি তা শুনতে পাই। আর দূর থেকে সালাম দিলে আমাকে তা পৌঁছানো হয় (বায়হাকী)। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যাক্তি রাসূলুল্লাহ (স)-এর প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তা’য়ালা তার প্রতি সত্তরটি রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাঁর জন্যে সত্তর বার ইসতেগফার করেন। (মুসনাদ আহমদ, মিশকাত হদীস নং ৯৩৫)। মহানবী (স.) অন্যত্র বলেছেন, হযরত জিবরাঈল (আ.) আমাকে বলেছেন, আমি কি আপনাকে এমন একটি সুসংবাদ দেব যা আল্লাহ তা’য়ালা আপনাকে বলেছেন, তাহলো যে ব্যক্তি আপনার উপর দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ ত’য়ালা তার প্রতি রহমত বর্ষণ করবেন, আর যে ব্যক্তি আপনাকে সালাম দিবে আল্লাহ তা’য়ালা তার প্রতি শান্তি বর্ষণ করবেন (মুসনাদ আহমদ)। দু’আ কবুল হওয়ার উত্তম পন্থা হলো- প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করা, তারপর প্রিয় নবী (স.) এর প্রতি দরূদ পাঠ করা। অতঃপর কাক্সিক্ষত জিনিস স্বীয় প্রভুর কাছে চাওয়া। হযরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, রাসূল (স.) এর প্রতি দরূদ পাঠ না করা হলে সেই দু’আ আসমান ও যমীনের মাঝে স্থগিত থাকে। সেই দু’আ আল্লাহর দরবারে পৌঁছে না (জামে তিরমিযী)।
দরূদ ও সালাম প্রেরণ : মহানবী (স)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম উভয়ই প্রেরণ করতে হবে। ইমাম নববী বলেছেন- রাসূল (স)-এর উপর যখন কেউ দরূদ পাঠ করে, তখন তার সালামও পেশ করা উচিত। শুধু দরূদ বা সালাম পেশ করে ক্ষান্ত হওয়া উচিত নয়। ফলে “আলাইহিস সালাত ও সালাম” (তাঁর প্রতি দরূদ ও সালাম) বলতে হবে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- হে মু’মিনগণ! তোমরা নবীর উপর দরূদ পাঠাও ও সালাম পাঠাও (সূরা আহযাব: ৫৬)।
অন্যান্য নবীদের প্রতি সালাম: আমাদের রাসূল ছাড়া অন্যান্য নবী-রাসূল ও ফেরেস্তাগণের উপর সালাম পেশ করা মুস্তাহাব। আলেমগদের ঐক্যমতে অন্যান্য নবীদের প্রতি দরূদও পাঠ করা যাবে।
দরূদ পাঠের ভাষা : দরূদের মধ্যে উত্তম দরূদ হলো যাতে মহানবী (স.) এর প্রতি দরূদ এবং তাঁর পরিবার, বংশ, স্ত্রীগণ ও সন্তানদের প্রতি সালাম পেশ করা হয়। মহানবী (স.) বলেছেন পূর্ণাঙ্গ দরূদ পাঠে যে, ব্যক্তি আনন্দ পেতে চায় সে যেন এ ভাবে বলে, আল্লাহুম্মা! সাল্লে আলা মুহাম্মাদিন নবীইল উম্মি ওয়া আযওয়াজিহি উম্মাহাতিল মুমিনীন, ওয়া যুরিরয়া তিহি ওয়া আহলে বাইতিহি কামা সাল্লাইতা আলা আলে ইবরাহীম ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। হে আল্লাহ, আপনি উম্মী নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর প্রতি রহমত বর্ষন করুণ। আরো রহমত বর্ষন করুণ, তাঁর সহধর্মিনী উম্মুল মু’মিনীন, তাঁর বংশ ও পরিবার বর্গের প্রতি, যেমনিভাবে রহমত বর্ষণ করেছেন হযরত ইবরাহীম (আ) এর বংশের প্রতি। অবশ্যই আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত (আবু দাউদ)। ইমাম ইবন মাজাহ হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন, তোমরা যখন রাসূল (স)-এর উপর দরূদ পড় তখন উত্তম দরূদ পড়। কেননা, তোমরা জাননা উক্ত দরূদ তাঁর কাছে পেশ করা হয়। লোকেরা ইবন মাসউদ (রা) কে বললেন, তাহলে আমাদেরকে শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন- তোমরা বল, হে আল্লাহ! আমাদের সমস্ত দরূদ, রহমত ও বরকত নবীদের সরদার, অতীতের সকল মণীষীর নেতা, শেষ নবী, আপনার বান্দা ও রাসূল, কল্যাণের ইমাম, কল্যাণ পথ প্রদর্শক ও রহমতের নবী মুহাম্মদ (স)-এর উপর প্রেরণ করুন। হে আল্লাহ! তাঁকে এমন উচ্চ মর্যাদা দান করুন, যা দেখে অতীতের সকলে তাকে ঈর্ষা করবে। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ (স)-এর উপর দরূদ পেশ করুন যেমন পেশ করেছেন হযরত ইব্রাহিম (আ) ও তাঁর বংশের প্রতি। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও মহান। সাহাবায়ে কিরাম মহানবী (স) কে প্রশ্ন করেন আপনার প্রতি এবং আপনার পরিবার বর্গের প্রতি কিভাবে সালাত ও সালাম পেশ করবো? রাসূলুল্লাহ (স.) প্রত্যুত্তরে বলেন- তোমরা বলবে- হে আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ ও তাঁর বংশের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন, যেমনি ভাবে হযরত ইবরাহীম (আ) ও তাঁর বংশের প্রতি রহমত বর্ষণ করেছে। অবশ্যই আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত। হে আল্লাহ! হযরত মুহাম্মদ ও তাঁর বংশের প্রতি বরকত দান করুন, যেমনিভাবে হযরত ইবরাহীম (আ) ও তার বংশের প্রতি বরকত দান করেছেন। অবশ্যই আপনি প্রশংসিত ও মর্যাদাবান (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।