কবিরের মায়ের শরীরটা বেশ কিছুদিন থেকে খারাপ যাচ্ছে। খাওয়া দাওয়ায় একদম রুচি নাই। উঠে বসতে পারেননা। দাঁড়ালে হাঁটতে শক্তি পাননা। ডাক্তারের সেই পুরনো কথা। বার্ধক্য জনিত ব্যাধি বা বয়সের রোগ। ঔষধের পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়া স্বাভাবিক হলে দ্রæত সুস্থ্য হয়ে উঠবেন।
মায়ের এমন কষ্ট দেখে মনটা দুমড়ে মুছড়ে উঠে। বউটা কতো যতœ করে এটা ওটা রান্না করে দেয় কিন্তু একদমই খেতে চায়না। না খেলে শরীরে জোর আসবে কোথা থেকে। ম্যাগি স্যুপ একদিন খেলে আরেক দিন খেতে চায়না। বমি বমি লাগে। মায়ের কষ্টের কথা ভেবে মনটা ছোট হয়ে যায়। আচ্ছা দেশি মাগুর মাছের ঝোল করে দিলে দু’এক বেলায় হয়তো খাবারে রুচি আসবে। বাজারের ব্যাগটা হাতে করে শহরের বড় মাছ বাজারে ডুকলেন। মনের আকুতি, মায়ের জন্য বাজারের সব থেকে বড় দেশি শিং মাছ কিনবে। দুই তিনজন দোকানীর আলতো ভেজা ডালায় বেশ বড়সড় কিছু দেশি শিং জ্যান্ত নড়াছড়া করছে। হৃষ্টপুষ্ঠ। বেশ তামাটে রং। আপনার দেখে মনে হচ্ছে- খুবই পাকাপোক্ত মাছ। সোনালী আভায় রং চিকচিক করছে। এমন সরস মাগুর বুঝি কদাচিৎ মেলে। দাম শুনে আঁৎকে উঠলেও মায়ের কথা ভেবে কষ্টের টাকায় বেশী দাম দিয়ে এক থেকে দেড় কেজি শিং মাছ কিনে কবির বাড়ি ফিরলেন। ডালায় ডেলে মাকে দেখালেন। মা বিছানা থেকে মাথাটা কিঞ্চিৎ কাৎ করে মাছ দেখে খুশিই হলেন মনে হলো। বউকে বললেন- বড় থেকে দু’টা মাছ কষা ঝোলে রান্না কর, বাকী গুলো বালতিতে জিঁই-য়ে রাখো। বিকেল বেলায় কবির মাছের পানি বদলাতে গেলেন।
দেখলেন পানি ঘোলা হয়ে কেমন হলদে হলদে হয়ে আছে। মাছের জন্ডিস হয়নিতো আবার। কিছুটা পানি পেলবার পর যেই মাছের গায়ে হাত দিলেন, অমনি হাতের তালুতে হলদে রং মত আঠা আঠা আভে হাত পিচ্ছিল হয়ে উঠলো। পরিস্কার পানিতে হাত ধুতে গিয়ে দেখলেন আঠালো আভের সাথে হলদে রং গড়িয়ে পড়ছে। আহা মায়ের জন্য কষ্টের টাকায় কেনা শিং মাছ থেকে রং গড়িয়ে পড়ছে। মাছ গুলো সরস তাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রতারক দোকানী কেন এমন রং মেশালো? বাজার করে নিজে নিজে ঠকলে সে কষ্ট হা পিত্যোষ করে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু অসুস্থ্য মায়ের জন্য কেনা মাছ … আহ.. মাগো …।
একসময় বিভিন্ন প্রজাতির মাছে ফরমালিন মেশানো হতো। ইদানিং এক শ্রেণীর অসাধু মাছ বিক্রেতা অধিক লাভের আশায় বড় সাইজের শিং ও কই মাছে জেলির সাথে তামাটে রং মেশাচ্ছে। ওজন বৃদ্ধি ও তেল তেলে ভাব বজায় রাখতে চিংড়ি মাছেও জেলি মেশাচ্ছে। মাছের ভিতরে পেরেক ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
এখন প্রায় সারা বছরই ভ্রাম্যমান আদালতের নানা মুখি অভিযানের খবর পাওয়া যায়। চার-পাঁচ বছর আগেও ভ্রাম্যমান আদালত বলতে আমরা বুঝতাম রমজান মাসে শহরের ইফতারী ও খাবারদাবারের দোকানে ভেজাল বিরোধী অভিযান। বর্তমান সময়ে সরকার এটিকে জোরদার করেছে। প্রায়শই পত্রিকার পাতায় টেলিভিশনের খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেল-জরিমানা, দোকান, কারখানা সিলগালা করার সংবাদ দেখতে পাওয়া যায়। এটি জনমনে একধরনের স্বস্তির সুবাতাস ছড়াচ্ছে। অনেক বড় বড় ব্যান্ড শফ যে গুলোর পণ্য এবং সেবার মানে আছে মানুষের গভীর আস্থা। সেই সব প্রতিষ্ঠান গুলোর ক্ষেত্রেও নানান নেতিবাচক পিলে চমকানো অনিয়মের তথ্য উঠে আসছে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে। মানুষের মধ্যে পন্য কেনার ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ছে। অসংখ্য অনিয়ম, দুর্নীতির ভীড়ে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান ও জরিমানা জনমনে স্বস্তি দিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী ও প্রতারকদের মধ্যে আতংক তৈরী হয়েছে, কখন আসে।
ভ্রাম্যমান আদালত এখানে ডুঁস দিচ্ছে, ওখানে ডুঁস দিচ্ছে। বেকারীর খাদ্যে ভেজাল মেশানোর দায়ে জরিমানা, হোটেলের নোংরা পরিবেশ, ফ্রিজের ভাঁসি খাবার জরিমানা, ওজনে চলচাতুরী জরিমানা, মেয়াদ উর্ত্তীর্ণ খাদ্য সামগ্রী, জীবন রক্ষাকারী ভেজাল ঔষধ ও বেশী দামে বিক্রির দায়ে জরিমানা, স্বাস্থ্যবিধি না মানায় জরিমানা, এসবের বিষয়ে কোনোই বক্তব্য ছিলোনা, বরং দোয়া ও সাধুবাদ।
কিন্তু এমন কিছু জিনিস আছে যার জন্য গ্রাম-গঞ্জের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে ভৎসনা করা যেতে পারে জরিমানা নয়। গ্যাস সিলিন্ডারের কথাই ধরিনা কেন। শহর, গ্রাম, পাড়া-মহল্লা, গলির মোড়ের দোকান কোথায বিক্রি হয়না গ্যাস সিলিন্ডার। ক্রেতা ধরার আশায় ছোট বড় সব দোকানিরা এটা রাখছে। আর কোম্পানির ডিলাররা ফেরি করে যত্র তত্র যে চাইছে তার কাছেই বিক্রি করছে। মুহুর্তেই অগ্নি দূর্ঘটনা ঘটাতে পারে এই গ্যাস সিলিন্ডার। এই বিপদ মোকাবেলার জন্য কার কি প্রস্তুতি আছে, কোনো প্রস্তুতিই নাই। তাহলে যত্রতত্র বিক্রির সুযোগ কিভাবে তৈরী হলো, কারা তৈরী করলো। গ্যাস সিলিন্ডার বাজারজাত হবার প্রাক্কালেই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রচার, প্রচারনা কেন চালায়নি। গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে হলে বিস্ফোরক ছাড়পত্র লাগে এমন আইনি বাধ্যবাদকতা কেন সর্বসাধারণে তুলে ধরা হয়নি। এখনো গ্রাম-গঞ্জের প্রায় ৯৮ ভাগ দোকানী জানেনা গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে হলে বিস্ফোরক ছাড়পত্র নিতে হয়।
কোম্পানীর অনুমোদিত লাইসেন্সধারী ডিলার প্রতি উপজেলায় একাধিক আছে বলে মনে হয়না। কিন্তু এক উপজেলায় হাজারেরও অধিক দোকানে ডিলাররা গ্যাস সিলিন্ডারের মত ঝুঁকি ও অগ্নি বিপদ মমতাভরে তুলে দিচ্ছে। ডিলাররা কোন আইনি ক্ষমতাবলে ফেরি করে যারতার কাছে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছে? গ্রামের সাধারণ একজন দোকানিকে জরিমানা করে ভ্রাম্যমান আদালত কি ম্যাচেজ দিতে চায়? জোতদারেরা নিরাপদে থাক, গরিবের বুকের উপর মারো জোড়া পায়ে লাথি আমার কাছে বিষয়টা এ রকমই মনে হয়। ১৫০০-১৮০০ টাকা পুঁজি খাটিয়ে একজন সাধারণ খুচরা দোকানি একটি গ্যাস সিলিঃ বিক্রয় করে সর্ব্বোচ্চ ৪০-৬০ টাকা লাভ করে। দৈনিক ২/৩ টা বোতল বিক্রি করে মাসে আয় কত হয়? যখন জরিমানার খড়গ আসলো তখন ৩- ৫ হাজার টাকা। জরিমানা দিয়াতো দোকানীর মাথাই নষ্ট। বাড়িতে গিয়া বউকে ধমকাচ্ছে নয়তো ছেলে মেয়েকে ধমকাচ্ছে। আর ভ্রাম্যমান আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট দিন শেষে একটা প্রেস ব্রিফিং করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছে।
জনাব ম্যাজিস্ট্রেট, জরিমানা কিংবা হুঁশিয়ারি তাদেরকেইতো করা উচিত যারা কোম্পানীর ডিলার হয়ে ফেরি করে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে যারতার কাছে নগদ মুনাপায় গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছে। জনাব ম্যাজিস্ট্রেট, আপনারা সভা-সমাবেশে, মাইকিং করে, লিপলেট দিয়ে প্রচার করুন বিস্ফোরক লাইসেন্স ছাড়া যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার মওজুদ ও বিক্রয় করা যাবেনা। তারপর এ্যাকশনে গেলে আর কোনো কথা থাকবেনা।
ইউনিয়নাধিন বাজারের এক দোকানী যিনি হার্ডওয়্যার, স্যানিটারী, রং, সম্যক ইলেক্ট্রিক সামানও বিক্রি করেন। তার ট্রেড লাইসেন্স, টিন সনদ আছে কিন্তু একই দোকানে স্যানিটারী ও ইলেক্ট্রিক সামগ্রী বিক্রির জন্য ডিলিং লাইসেন্স নাই কেন তার জন্য জরিমানা। গ্রাম-গঞ্জের একটা দোকানে হরেক রকমের জিনিস দোকানীরা রাখেন। যেমন মুদি দোকানে ওরস্যালাইন, চুল রং করার কলপ, পাউরুটি, বিস্কুট ইত্যাদি রাখে। আবার ঔষধের দোকানে থাকছে কিছু প্রসাধনী সামগ্রী। এতসব কিছু করার পরও অধিকাংশ দোকানীকে দিন শেষে পেট খরচা ওঠাতে হিমশিম খেতে হয়। অধিকাংশ দোকানী তিন-চারটা এনজিও ঋণ চক্রে বন্ধী। মধ্যভিত্ত এবং নি¤œ মধ্যভিত্ত দোকানীদের অনেকেই কায়ক্লেশে দিন চালাচ্ছে।
পুন্শচঃ মফস্বল শহরে বা গ্রামের হাঁট বাজারের হার্ডওয়ার ষ্টোর নামক দোকানে হার্ডওয়ার, স্যানিটারী, রং, সম্যক ইলেক্ট্রিক ও প্লাস্টিকের টুকিটাকি সামান বিক্রি হতে দেখা যায়। কিন্তু ট্রেড লাইসেন্সের বাহিরে ডিলিং লাইসেন্স থাকতে হয় তা ৯৯ ভাগ দোকানী জানেননা। আমি শহর ও মফস্বলের ১০-১২ টা বড় দোকানে খোঁজ করে শহরের ১টা বড় দোকানে এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছি। তাহলে জরিমানা করার আগে কি করা প্রয়োজন ছিলো। আইন জানানো। তা না করে ক্ষমতা আছে বলেই প্রয়োগ করবেন, এমনটা একজন দ্বায়িত্বশীল সচেতন সুশিক্ষিত মানুষের কাজ হতে পারেনা।
আমার এক বন্ধু যিনি বসুরহাট কোম্পানী গঞ্জের ব্যাবসায়ী। তিনি একটা টিভি চ্যানেলের সংবাদকর্মী এবং সেতুমন্ত্রী কাদের সাহেবদেরও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। একাধিক বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় বাকীবাটটায় মার খেয়ে শেষে নগদ পুঁজি নগদ লাভের আশায় সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির জন্য একটি বিস্ফোরক লাইসেন্স করেছেন। এটি করতে তার খরছ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। সরকারী ফি কত? খুব একটা বেশিনা। কিন্তু এত পদপরিচয়ের পরও ৫০ হাজার, ভাবুন ব্যাপার খানা। তারপর বছর বছর নবায়নের জক্কি জামেলাতো আছেই।
একটি বিস্ফোরক লাইসেন্স করতে পরিবেশ অধিদপ্তরেরও ছাড়পত্র নিতে হয়। নিরাপদ জায়গায় (জনবহুল নয় এমন) গোড়াউন থাকতে হবে। বস্তুত কি তাই? টাকা ঢাললে নিয়ম মানতে হয়না। নিয়ম মানবে গরিবেরা, লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন তুলবে গরিবেরা। অর্থ আর ক্ষমতাধরেরা রঙ্গীন চশমা পরে সর্বত্র ধাপিয়ে বেড়াবে। আইন তখন কালো চশমার পরে ঘুম পাড়ানি মাসিপিসির গল্প শুনবে শুনাবে।
গত কয়েকদিন আগে সিএনজি ট্যাক্সি করে গজারিয়া বাজার হয়ে দাগনভূঞা আসছিলাম। মাঝামাঝি পথে দেখলাম একটা ব্রিকফিল্ড। এই ব্রিকফিল্ডের তিন দিকে ৫০ ফুট দুরত্বের মধ্যে ঘনবসতির ঘরবাড়ি। একটি ব্রিকফিল্ড করার পূর্বে পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তার যা যা অত্যাবশ্যকীয় তার একটিও পূরণ হযেছে বলে মনে হয়নি। কিন্তু সব ধরনের নো অভজেকশন সনদ ব্রিকফিল্ড মালিক পেয়েছে। পেয়েছে একশ্রেণীর প্রশাসনিক দুর্বৃত্ত¡রা তাঁকে এটি পাইয়ে দিয়েছে।
চুটকী : পেলো কড়ি, মাখো তেল।
লেখক : চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধীক ও সাংবাদিক।