ড. এ কে এম সাহিদ রেজা :
বেশ মনে আছে সেবার বর্ষাকাল ছিল, তা বোধহয় আটাত্তুর সালের দিকে হবে , চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন যাবে আখাউড়া সেখান থেকে গাড়ীবদল করে সিলেট, বাবার সংগে ফেনী স্টেশন থেকে উঠলাম রবীন্দ্রনাথের সেই বার -চৌদ্দ বছরের বালক, কৈশোরের উদ্দীপনায় ঘড়ের মানুষেরা প্রায় সবাই যখন উদ্বিগ্ন উৎকন্ঠিত তখন মহাপুরুষদের আশীর্বাদের জন্য এই যাত্রা , যদি সুমতি ফিরে আসে , অন্যদিকে অপার কৌতুহল সব কিছুই নতুন সুন্দর ।
আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ চারিদিকে বর্ষার জল , মাঝ খানে রেললাইন চলে গেছে সোজা অথবা মাঝে মধ্যে এঁকে বেঁকে , ভরা বর্ষার ফুলে উঠা পানি এই বোধহয় ডুবিয়ে দিলো ভাসিয়ে নিলো , ফুটে আছে নানান রংয়ের ফুল বাড়ন্ত লতাপাতা এদিক ওদিক হেলেদুলে চলা ডিংগি নৌকা থেকে জাল ছড়িয়ে মাছ ধরার চেস্টা , মাঝে মাঝে দ্বীপের মত বাড়ীঘড় বাজার গন্জ পার হয়ে শ্রীমমঙ্গল এর ছোট ছোট টিলা বাগান আর চা গাছের সমুদ্র ডানে বামে ফেলে প্রায় বনান্চল ছুঁয়ে কুলাউড়া নামটি পাকা পোক্ত ভাবে সারা জীবনের জন্য মাথায় গেঁথে পুরো দিনের রেল চড়া শেষে বৃষ্টি ঝরা বর্ষার সন্ধ্যায় জেলা শহর সিলেট পৌছেছিলাম ।
ট্রেনের কামরা ছিল যাত্রীতে পরিপূর্ন সম্ভবত দ্বিতীয় শ্রেনীর , লম্বা গদিমোড়া টুল জানালা খোলা ইচ্ছেমত গালগল্প হকার সবই ছিল। কোনো এক স্টেশন থেকে উঠা ফেরিয়ালার কাছ থেকে আব্বা আমাকে ছোট একটি পাতলা বই কিনে দিলেন ইংরেজীর টেনস শেখার জন্য , মধ্যবিত্ত বাবা আমার সন্তান কে তৈরীর অদম্য স্বপ্ন আগামীর লড়াই সংগ্রামের জন্য । বইটি রেখে দিয়েছিলাম অনেকদিন কিন্তু টেনস আমার শেখা হয়নি , সময়টাকেই তো ধরতে চেয়েছি নিজের মত করে তাই আগপিছ তাকিয়ে কি হবে ।
আজ দুই হাজার তেইশ এর ডিসেম্বরের সাত তারিখ প্রায় সারাদেশে বৃষ্টি হচ্ছে গুঁড়ি গুড়ি ,বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ মিগজাউম ভারতের অন্ত:প্রদেশে আঘাত করেছে তার ধাক্কা আর আসছে শীতের আগমনী সুর এর মধ্যে নভোএয়ার এর প্রজাপতি ডানায় চড়ে উড়াল দিলাম সিলেটের পথে , কাল ভোরে ম্যারাথন ট্র্যাকে ছুটবো।
এয়ারপোর্টের ডুকলাম মাথা ভিজিয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে কিন্তু নভোএয়ার একঘন্টা দেরী করলো উড়ান দিতে, ডমেস্টিক টার্মিনাল বৃহস্পতিবার বিকেল যাত্রীতে ভর্তি তবে এখন অপেক্ষার ব্যবস্থা কিছুটা ভাল হয়েছে ।
গুঁড়ি গুড়ি নয় তার চেয়েও বেশী বৃষ্টি হচ্ছিল ভোরবেলায় । আম্বরখানা সড়কে নতুন হোটেল একদম দরগার কাছাকাছি ,চকচকে নির্মান বড় রুম প্রশস্ত করিডোর কিন্তু ব্যবস্থাপনা দূর্বল, রুমে ডুকলেই বুঝা যাবে তদারকির অভাব ,স্থায়ী বিনিয়োগের বিপরীতে ব্যবসা বোধহয় ভাল হচ্ছে না, এই এক সংকট বিনিয়োগ হয় কিন্তু পেশাদার ভাল কর্মচারী বা ম্যানেজমেন্ট গড়ে উঠে না আখেরে ফলাফল খারাপ হয় ।
দরগা গেইটে ডুকার রাস্তাটির অদ্ভুত ব্যবস্থা মাঝ বরাবর নানা কিছিমের ছোট বড় যানবাহন সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকে , এত সকালেও সিএনজি ট্য্যাক্সি সবকিছুই আছে । বৃস্টি ভিজতে ভিজতেই উঠে পড়লাম । এগারজন আছি এই দলে পঁচাত্তর বছরের অবসরপ্রাপ্ত হিসাববিজ্ঞানের অধ্যাপক , তৈরী পোষাক রপ্তানীকারক, পেশাদার ব্যাংকার, নির্মান ঠিকাদার, হাউজিং ব্যবসায়ী, তরুন আইটি উদ্দ্যোক্তা, খাতা কলম কাগজের দোকানী সবমিলিয়ে দারুন সংমিশ্রন , একসাথে প্রায় প্রতিদিন সকাল বেলায় হাঁটি।
আলোয় উজ্জ্বল আধুনিক স্থাপনার সার্কিট হাউস পাশে বয়ে চলা সুরমা নদী অন্ধ্র প্রদেশে আঘাত করা বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপের বৃষ্টি বাতাস এর মধ্যেই বৃটিশ গভর্নর মাইকেল ক্বীনের নামে তৈরী প্রাচীন লাল রংয়ের ব্রীজের নিচে সৌখিন দৌড়বিদরা জড়ো হতে শুরু করে , সময় কে পায়ে মাড়িয়ে এগিয়ে চলার উচ্ছাস অথবা দৈনিক জীবন কে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপক সুযোগ অংশিজনদের দারুন উত্ফুল্ল করে তুলে এমন জল বৃস্টির ভোরেও , মাথার উপর ড্রোন ক্যামেরা, হাতে স্মার্টফোন , রেস পরিচালকের বারবার নির্দেশনা সবকিছু কে নিয়ে অন্ধকার ভোর প্রানবন্ত আলোময় হয়ে উঠে । দুটি ক্যাটাগরীতে বারশ রেজিস্টার্ড রানার, উপস্থিত বোধহয় সকলেই, ভিড় দেখে তেমনই মনে হয়।
সুরমা পাড় থেকে দৌড় শুরু করে সরাসরি শহর পার হয়ে বিমানবন্দরের রাস্তায় ছুটে মালিনিছড়া চা বাগানের প্রায় শেষ মাথায় গিয়ে ঘুড়ে ক্রিকেট স্টেডিয়াম এর উত্তর গেট দিয়ে ডুকে শেষ হলো সিলেট রানার্স কমিউনিটির হাফ ম্যারাথনের ১০ কিলোমিটার দৌড়। এবার ফেরার পালা বিকেলেই উড়ান দিবো …আবার ঢাকা… যাদুর শহর মায়ার নগরী ।
লেখক : সভাপতি, ফেনী ডায়বেটিক সমিতি।