দৈনিক ফেনীর সময়

রাজনীতিতে গর্জনদৃষ্টে বর্ষণের সম্ভাবনা কতটুকু

রাজনীতিতে গর্জনদৃষ্টে বর্ষণের সম্ভাবনা কতটুকু

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের অস্থিরতা ভর করেছে। বাড়ছে অস্থিতিশীলতা, সংঘাত-সহিংসতা। শুধু প্রতিদ্বন্ধী বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই নয়,এই অস্থিতিশীলতা আর অস্থিরতা রয়েছে কয়েকটি ছোট দলের ভেতরে এবং জোটের রাজনীতিতেও।
দলে ও রাজনীতির মাঠে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকেই এসব অস্থিরতা-অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। এ পরিস্থিতি দেশ ও জনগণের জন্য মোটেও সুখকর নয়।

বৈশ্বিক বাস্তবতায় এমনিতেই সময়টা বড় সঙ্গীন, সঙ্গে ভিড়ছে স্থানিক নানা উপাদান। মানবসৃষ্ট বিপর্যয়, তার ওপর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা। বিপদের মধ্যেই আপদ। যাই যাই করেও যায়নি মহামারী করোনা। খতরনাক চরিত্রে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। রাজধানীর পাশাপাশি বিস্তার ঘটছে মফস্বল শহরেও। এর মধ্যেই সামনের মাসে অর্থাৎ বিজয়ের ডিসেম্বরে বঙ্গোসাগর হয়ে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কা।

দৃশ্যত বিএনপি ১০ ডিসেম্বরে এই সরকারের পতন বা ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে দেশ চালানোর কামান দাগানো থেকে সরে এসেছে বিএনপি। বলছে, সেদিন ঢাকার সমাবেশ থেকে এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হবে। তাদের সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। কিন্তু বিএনপি গোঁ ধরেছে নয়াপল্টনে পার্টি অফিসের সামনে সমাবেশ করে ছাড়বে বলে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন- পল্টন নয়, উদ্যানেই যেতে হবে তাদের। ধারণা করা যায়, শেষ পর্যন্ত তাদের সমাবেশটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই হবে। একসময় রাস্তাতেই নামতে না পারা দলটি এখন সমাবেশ করে চলছে। তা একেবারে কম কথা নয়। সমস্যা অন্যখানে। বিএনপির কাঁধে ভর করে অস্বাভাবিক সরকার প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র আঁচ করছে সরকার- যাতে দেশে রাজনৈতিক দুর্যোগ ডেকে আনার শঙ্কা ভর করেছে। যেকোনো মূল্যে তা রুখে দেওয়ার হুঙ্কার আছে সরকারি মহল থেকে। প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ফের আগুনসন্ত্রাস করলে ‘একটাকেও’ ছাড়া হবে না।

সরকারের সতর্কতা এবং বিএনপির কিছুটা ডিফেন্সের নমুনায় আশা করা যায় ডিসেম্বরে রাজনীতির সম্ভাব্য ঝড়টির গর্জনদৃষ্টে বর্ষণ হবে না। খাদ বা সুড়ঙ্গের শেষ কিনারেও আলোর দেখা মিলবে। এর আগে সিত্রাংয়ের মতো অল্প ধকলে চলে যাবে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের কাছে তৈরি ঝড় ম্যানদৌসও। ৭ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এটি নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। আঘাত হানতে পারে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের মধ্যবর্তী কোনো জায়গায়। ম্যানদৌস নামটি দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলের বরাত দিয়ে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিদদের তথ্য হচ্ছে, ঘুর্ণিঝড়টির গতিবিধি নির্ভর করবে ভারতীয় উপমহাদেশের ঊর্ধ্বাকাশের পশ্চিম দিক থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত জেট স্ট্রিমের অবস্থান ও বাতাসের শক্তির ওপর।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে বাংলাদেশসহ দেশে দেশে এখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। আর এ ধরনের বিপর্যয় সচরাচর কাউকে ছাড় দেয় না। প্রকৃতি প্রদত্ত মহামারী করোনার পর মানবসৃষ্ট রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে চলমান স্নায়ুচাপ আগের সব ইতিহাস পাল্টে দিতে বসেছে। স্নায়ুযুদ্ধ সব সময় পরাশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হলেও দেশে দেশে সরকার আক্রান্ত হয়, ঘটে পটপরিবর্তন। আন্তর্জাতিক শক্তি ও দাতারাও এ সময়টায় পেয়ে বসার মতো জেঁকে ধরে। এ স্নায়ুচাপ কেবল রুশ-ইউক্রেন নয়, বিশ্বের সব মেরুকেই কমবেশি উতলা করে দিয়েছে। ওই প্রান্তের উগান্ডা-রুয়ান্ডা থেকে এই প্রান্তের নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশ কারোরই এর ছাপমুক্ত থাকার জো নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে তেল-গ্যাসের বিশ্ববাজার অস্থির। নানা সূচকে শ্রীলংকার আলামত না থাকলেও অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়ে বাড়তি যন্ত্রণায় বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সরকার থেকে আশা করা হচ্ছিল নানা ইস্যু চাপা পড়ে যাবে। বাস্তবে তা হয়নি। হঠাৎ লোডশেডিংয়ের আপদ হানা দেয়। তা সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্যভরা প্রচারকে মাঠে মার খাইয়েছে।
কালো মেঘের গর্জন অর্থনীতির প্রায় সব শাখা-প্রশাখায়। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। সিন্ডিকেটের ফ্রি স্টাইল দাপট। ডলার সংকট। প্রবাসী আয়ে খরা। সামনের দিনগুলোয় তা আরও কমার শঙ্কা। দুর্নীতির লাগাম টানার চেষ্টা মার খাচ্ছে। পাচারও থেমে নেই। রিজার্ভ নিয়ে নানা মন্দকথা। বেকারত্ব বাড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। সব মিলিয়ে ধেয়ে আসা অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারি গাড়ি কেনা কমানো, বিদ্যুৎসাশ্রয়ের পদক্ষেপ, ব্যয় সংকোচনসহ বিভিন্ন কৌশল হালে পানি পাচ্ছে না। তার ওপর কয়েকদিন পর পরই নানা উটকো ঘটনা দেশকে টালমাটাল করে দিচ্ছে। আগে যেভাবে ঝটপট এই ধরনের অঘটন সামলে ফেলা হয়েছে, সম্প্রতি তা করা যাচ্ছে না। দলের হেভিওয়েট ও মাঠ-ঘাটে শক্তিমান কয়েক নেতা সাইডলাইনে দর্শকের কাতারে গিয়ে তামাশা দেখার ভূমিকায়। আবার অনেক প্রাপ্তির পরও অপ্রাপ্তি প্রচার করা আলামতের দর্শক অনেকে। সব কথার জবাব প্রধানমন্ত্রীকেই দিতে হচ্ছে। এর মধ্যেই গুজব ভর করেছে গজবের মতো। বাংলাদেশ শ্রীলংকার দশায় চলে গেছে বলে ধুয়া চলেছে কয়েকদিন। কার্যত বাংলাদেশ তা হয়নি। গুজবের বর্তমান অ্যাপিসোড- রিজার্ভ শেষ, বাংলাদেশ দেউলিয়ার পথে, ব্যাংকে টাকা নেই, গ্রাহকরা জমাকৃত টাকা ফেরত পাচ্ছে না, কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৩ নভেম্বর জরুরি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরে কোনো ব্যাংক বন্ধের রকর্ড নেই।’

গুজবকে বাঙালি জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলা হয়েছে গদ্য-পদ্যসহ বিভিন্ন লেখনীতে। গুজবে সত্য-মিথ্যা থাকে, সঙ্গে থাকে বিনোদনও। তবে বিনোদিত করা আসল উদ্দেশ্য নয়, মূল মতলব মানুষকে আতঙ্কিত ও বিভ্রান্ত করা। কুশীলবরা গুজব-গুঞ্জন রটানোর সুযোগটা নেয় কোনো সংকটকে পুঁজি করে। হালে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে তা করছে বিদ্যমান অর্থনৈতিক টানাপড়েনের সুযোগে। ব্যাংক খাত অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ নিয়ে অর্থনীতিকদের চেয়ে বেশি কথা বলছেন রাজনীতিকরা। তারা কেউ বাংলাদেশকে শ্রীলংকা বানিয়ে ছাড়েন, কেউ সিঙ্গাপুর বানিয়ে ফেলেন। বিদেশি নানা সংস্থা বাংলাদেশকে ‘চাপে আছে কিন্তু ঝুঁকিতে নেই’ পজিশনে দেখছে। তবে বাংলাদেশে ঘুরছে ‘সকালে ঘুম থেকে জেগে আর বাংলাদেশ না দেখা, ব্যাংকগুলো হাওয়া হয়ে যাওয়ার’ শঙ্কাবার্তা।
মূল্যস্ফীতি, বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া দাম, ব্যাংকে খরার টান বা ডলার ঘাটতি অবশ্যই সত্য। কিন্তু তা কোন পর্যায়ে? চাইলেই এখন আগের মতো ফ্রি স্টাইলে এলসি খোলা যাচ্ছে না। নিট হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের ঘরে। ডলারে ভর করে ১৩ মাস আগেও যে রিজার্ভের রমরমা অবস্থা ছিল, সেখানে এখন খরার টান। ব্যাংকিং খাত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অবস্থান জানিয়ে বলেছে, ব্যাংকিং খাতে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য আছে। ব্যাংকে জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ আছে জানাতে গিয়ে এমনও বলেছে, কোনো ব্যাংক টাকা না দিতে পারলে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দেবে। অঙ্কসহ এমন হিসাব জানানোর পরও মানুষের শঙ্কা-অবিশ্বাস কাটানো যাচ্ছে না।
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, জলাবদ্ধতা, নদীর নাব্য হ্রাস, পানির স্তর নেমে যাওয়া, ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা প্রতিনিয়ত হুমকিতে পড়ছে। এর সমান্তরালে ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ শিরোনামে হুঙ্কার-পাল্টা হুঙ্কার চলতে থাকলেও বাস্তবে খেলা চলছে পুরোদমে। এ খেলার রেফারি-আম্পায়ারও এখনো অচেনা। প্লেয়ার অনেক। আন্দোলন-সমাবেশ-বিক্ষোভ ইত্যাদি কারও দান বা দয়া-দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়। এক সময় তা করতে চাইলেই করা যেত। সারাবিশ্বে, এমনকি বাংলাদেশেও তার শত শত উদাহরণ ছিল। সমাবেশ বা মিছিল করা এক সময় ছিল পুলিশকে অবহিত করার বিষয়। সেই ‘অবহিতকরণ’ গত বছর কয়েক উপনীত হয়েছে ‘অনুমতিতে’। বিএনপি সরকারই সেটিকে পুলিশের অনুমতি নেওয়ার পর্যায়ে এনেছে। সেটির ষোলো আনা সুফল নিচ্ছে টানা তিন মেয়াদের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তার ওপর বিএনপি বাড়াবাড়ি করলে খালেদা জিয়াকে আবার জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপিকে ডিসেম্বরে আসল খেলা দেখিয়ে ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন তার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বাড়তি হিসেবে বলেছেন, ‘প্রয়োজনে জেলে যাবেন। কিন্তু পালাবেন না।’ জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন- “তারা নন, ‘বাড়াবাড়ি’ করছে সরকার। এ জন্য সরকারকেই পালাতে হবে। কিন্তু পালানোর পথ পাবে না সরকার।” পাল্টাপাল্টি এই ধাঁচের হুমকি-হুঙ্কার বেশ অ্যালার্মিং। এত খেলার মধ্যে অপখেলা ঢুকে বিপর্যয় ডেকে আনার ঘটনা বাংলাদেশে অনেকবার ঘটেছে। এবারের বৈশ্বিক ও বর্তমান বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন এবং কষ্টদায়ক। যদিও ক্ষমতাসীন সরকার বলছে,জনগণকে শান্তি ও নিরাপত্তা দেয়া সরকারের প্রধানতম দায়িত্ব যা তারা যথাযথ ভাবেই পালন করছে।
তথ্যের অবাধ প্রবাহের এই যুগে দেশের জনগণ ভালো করেই জানে, শান্তি-নিরাপত্তার পাশাপাশি চলমান বৈশ্বিক সঙ্কটের মধ্যে তারা কতটা স্বস্তিতে রয়েছে! বাস্তবতা হচ্ছে, বৈশ্বিক এই সঙ্কট পুঁজি করে দেশে চলছে অরাজকতা আর সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত হচ্ছে দ্বিধাগ্রস্থ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কন্টেন্ট সুরক্ষিত!!