মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম :
দাম্পত্য জীবন সুখকর ও মধুময় করার জন্যে স্বামী স্ত্রী একের প্রতি অন্যের কি কি হক বা অধিকার রয়েছে তা জানা এবং পালন করা আবশ্যক। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে যেমন তাদের উপর পুরুষদের হক রয়েছে (সূরা আল বাকারা-২২৮)। আল্লাহ তা’য়ালা পুরুষ ও নারীকে তাদের নিজ নিজ ব্যক্তিত্ব, যোগ্যতা ও সামর্থ্যানুযায়ী দায়িত্ব প্রদান করেছেন। তিনি যেমন নারীদেরকে (স্বামীর) আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন, তেমনিভাবে পুরুষদেরকে দয়া ও ক্ষমার দৃষ্টিতে কর্ম সম্পাদনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং নারীর যাবতীয় প্রয়োজন পুরণের দায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পণ করেছেন। পারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকারের দৃষ্টিকোন থেকে উভয়ের মর্যাদা সমান। আর দায়িত্ব ও অধিকার আদায়ে উভয়েই সমান যিম্মাদার। উভয় উভয়কে সম্মান, আদর স্নেহ, প্রেম-প্রীতি ও ভালাবাসা দেবে। একে অপরের মঙ্গল কামনা করবে। সুখে-দুঃখে সঙ্গ দেবে, যত্ন ও সেবা করবে। একে অপরের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করবে। স্বামী যখন বাহ্যিক জগতের চাপে থাকে, তখন স্ত্রী কোমলতা ও প্রেম-ভালবাসা দিয়ে প্রশান্তি দেবে। তা’ছাড়া পারলৌকিক জীবনের শান্তির জন্যে একে অপরকে উৎসাহিত করবে। স্বামী স্বীয় স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের সকলের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেবে। পক্ষান্তরে, স্ত্রী ঘরের সব কিছু সুন্দরভাবে দেখাশুনা করবে। পুরুষ তথা স্বামী থাকবে নেতৃত্বের আসনে। পরিবারের প্রতিরক্ষা, রক্ষণাবেক্ষণ, ভরণ-পোষণ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হবে। কেননা, দৈহিক শক্তি, মেধা ও মনোবলের দিক দিয়ে সে অধিকতর যোগ্য। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- নারীদের উপর রয়েছে পুরষদের শ্রেষ্ঠত্ব (সূরা আল বাকারা-২২৮)। আরো ইরশাদ করেন- পুরুষগণ নারীদের কর্তা ও রক্ষক (সূরা আন নিসা-৩৪)। আরো ইরশাদ করেন- (পুরুষ-নারীদের কর্তা) যেহেতু আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এ কারণে যে, পুরুষ তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে (সূরা আন নিসা-৩৪)।
স্বামীর হক : দাম্পত্য জীবন সুখকর ও আনন্দঘন করার জন্যে স্ত্রীর স্বীয় স্বামীর প্রতি কিছু হক রয়েছে। যেমন-
সতীত্ব রক্ষা করা : সুসন্তান লাভ ও পারিবারিক সুখ-শান্তি স্ত্রীর সতীত্ব, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও পবিত্রতার উপর নির্ভরশীল। একজন সতী-সাধ্বী স্ত্রী স্বামীর জন্য বড় নেয়ামত। মহানবী সা. বলেছেন- পৃথিবীর সবকিছু উপভোগের জিনিস, তবে পৃথিবীর উপভোগের জিনিসের মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ হলো সতী-সাধ্বী স্ত্রী। সুতরাং স্ত্রীর স্বীয় সতীত্ব রক্ষা করা আবশ্যক।
আনুগত্যশীলা হওয়া : স্ত্রীকে অবশ্যই স্বামীর আনুগত্যশীলা হতে হবে। পারিবারিক ব্যবস্থাপনা সঠিক ও সুন্দর রাখার জন্য স্বামীর আনুগত্য করা স্ত্রীর জন্য আবশ্যক। মহানবী সা. বলেছেন- আমি যদি কাউকে সিজদা করার হুকুম করতাম তা’হলে স্ত্রীকে আদেশ করতাম, তার স্বামীকে সিজদা করার (জামে তিরমিযী, রিয়াদুস সালিহীন পৃ. ১৪২)।
আমানতের হিফাযত করা : স্বামীর আমানতের হিফাযত করা স্ত্রীর অন্যতম কর্তব্য। যেমন- ধন-সম্পদ, সতীত্ব, ইযযত-আবরু, স্বামীর গোপনীয় বিষয়, কথাবার্তা, অঙ্গীকার ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণ করা স্ত্রীর দায়িত্ব। হাদীসে উল্লেখ রয়েছে- মহানবী সা. কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, কোন নারী উত্তম? মহানবী সা. প্রত্যুত্তরে বলেন, যে নারীরর প্রতি স্বামী নজর করলে সে স্বামীকে আনন্দ দান করে, স্বামীর কথামত চলে, নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে স্বামীর বিরুদ্ধাচারণ করে না এবং স্বামীর মতের বিরুদ্ধে তার সম্পদ ব্যয় করে না (সূনানে নাসাঈ পৃ. ১৪২)।
স্ত্রীর হক : স্ত্রীর যেমন স্বামীর প্রতি দায়িত্ব রয়েছে তদ্রƒপ স্বামীরও স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর হক হলো-
সদাচারণ করা : আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- আর (হে স্বামীরা) তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সৎভাবে জীবন-যাপন করবে (সূরা নিসা-১৯)। মহানবী সা. বলেন- সাবধান! তোমরা স্ত্রীদের সাথে সদাচারণ রক্ষা করে চলবে। কারণ তারা তোমাদের সাহায্যকারী। তোমরা তাদের মালিক নও। তারা তোমাদের স্পষ্ট অবাধ্যতা অবলম্বনের পূর্বে তাদের উপর কঠোরতা আরোপের কোন অধিকার তোমাদের নেই। সাবধান! তোমাদের উপর তোমাদের স্ত্রীদের হক রয়েছে। তোমাদের উপর তাদের পাওনা হক হলো, তোমরা তাদেরকে সুন্দররূপে পানাহার ও পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করবে (জামে তিরমিযী, রিয়াদুস সালেহীন, পৃ. ১৩৯)।
ধৈর্য্য ধারণ : যদি স্ত্রীর কোন অভ্যাস কিংবা আচরণ অপছন্দ হয় অথবা সুন্দর না হয় তবে ধৈর্য্য ধারণ ও সহনশীল হতে হবে। স্ত্রীর অন্যায় ও অসুভ আচরণকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। সামান্য ভূল-ক্রুটির কারণে তালাক বা সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত হবে না। যেমন রাসুল সা. বলেছেন- কোন মুমিন স্বামী মুমিন স্ত্রীকে ঘৃণা করতে পারে না। যদি তার একটি অভ্যাস অপছন্দ হলেও অন্য আরেকটি পছন্দ হয় এবং তাকে খুশি করে। (মুসলিম)
ক্ষমার দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখা : আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন- হে মুমিনগণ! তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক থাকো। তোমরা যদি তাদেরকে মার্জনা করে দাও, তাদের দোষ-ক্রটি উপেক্ষা কর এবং তাদেরকে ক্ষমা কর, তবে জেনে রাখ, আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু (সূরা তাগাবুন-১৪) মহানবী সা. বলেন- তোমাদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী তারা, যারা তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ চরিত্রবান এবং তোমাদের মধ্যে উত্তম মানুষ তারা, যারা স্বীয় স্ত্রীদের দৃষ্টিতে উত্তম বলে বিবেচিত (জামে তিরমিযী-২৮৩)। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী সা. বলেন- তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা, তোমরা আল্লাহর আমানত স্বরূপ তাদেরকে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বানীর মাধ্যমে তাদের যৌনাঙ্গের বৈধতা লাভ করেছ। তোমাদের জন্য তাদের দায়িত্ব হলো তারা তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে ¯’ান দেবে না, যা তোমরা অপছন্দ কর। যদি তারা এরূপ করে, তবে তাদেরকে হালকা প্রহার কর। আর তোমরা যথাযথভাবে তাদের অন্ন, বস্ত্র প্রদান করবে। জনৈক সাহাবী মহানবী সা. কে প্রশ্ন করেন- আমাদের উপর স্ত্রীদের হক কী? রাসূল সা. বলেন- তুমি খাইলে তাকেও খাওয়াবে, তুমি পরিধান করলে তাকেও পরিধান করাবে। চেহারায় প্রহার করবে না এবং ঘরে রাখবে, ঘর থেকে বের করবে না। রাসূল সা. আরো বলেছেন- স্ত্রীদেরকে প্রহার করবেনা। যারা স্ত্রীদেরকে প্রহার করে তারা ভাল স্বভাবের মানুষ নয় (আবু দাউদ)। মহানবী সা. অপর হাদীসে বলেছেন- যদি কারো দু’জন স্ত্রী থাকে এবং তাদের প্রতি ন্যায় বিচার না করে, তবে সে বিচার দিন অর্ধদেহ হয়ে উঠবে (তিরমিযী)।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।