ইলিয়াছ সুমন :
ফেনী জেলা শহর সহ প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। দিনদিন প্রতিষ্ঠান বাড়তে থাকলেও সেবার মান নিম্নমুখী। ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠান শাখা খুললেও ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ধরনের ডাক্তার ফেনীতে না আসায় অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেনা। এছাড়া বেশিরভাগ স্বাস্থ্য ও পরিবেশ অধিদপ্তর সহ বিভিন্ন ছাড়পত্র ছাড়াই এসব প্রতিষ্ঠান হরহামেশা চলছে স্বাস্থ্য সেবা। স্বাস্থ্য বিভাগ সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উদাসীনতা ও প্রতিষ্ঠান মালিকদের গাফিলতিতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে সববয়সী নারী-পুরুষ।
২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে শহরের শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়কের পুলিশ কোয়ার্টার সংলগ্ন কাজী ভবনের দ্বিতীয় তলায় চালু হয় ল্যাব এইড। এখানে মেডিসিন গ্যাস্ট্রোলিভার অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ ইসমাইল, ইউরোলজি অধ্যাপক ডা: এইচ আর আর হারুন, মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: মাহফুজুর রহমান, মেডিসিন ও হৃদরোগ চিকিৎসক ডা: মো: শিহাব উদ্দিন, মেডিকেল অফিসার ডা: আসিফ উদদৌলা সিফাত চেম্বার করেন। এদের মধ্যে অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ ইসমাইল রবি, সোম, বুধ ও বৃহস্পতিবার চেম্বার করার তারিখ থাকলেও একইদিন তিনি চেম্বার করেন ফেনী ক্লিনিক ও স্কয়ার ল্যাবে। অধ্যাপক ডা: এইচ আর আর হারুন প্রতি ১৫ দিন পর বৃহস্পতিবার জননী ডায়াগনস্টিক, ডা: মাহফুজুর রহমান প্রতিদিন আল-বারাকা হাসপাতাল ও স্কয়ার ল্যাবে চেম্বার করেন। ডা: শিহাব উদ্দিন কনসেপ্ট হাসপাতাল ও ছাগলনাইয়ার স্কয়ার হাসপাতালে চেম্বার করেন। রাজধানীর নামকরা এ প্রতিষ্ঠান শাখা খুললেও ঢাকা থেকে কোন চিকিৎসক আসেন না।
একইচিত্র শহরের ট্রাংক রোডের সেভরন শাখায়ও। ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে এটি চালু হয়। শুরুর দিকে চট্টগ্রামের সেভরন থেকে নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা: রেজাউল করিম, বক্ষব্যধি বিশেষজ্ঞ ডা: শিমুল কুমার বণিক চেম্বার করলেও এখন তারা ফেনী আসেন না। একাধিক চিকিৎসক প্রতিদিন চেম্বার করলেও এদের মধ্যে চট্টগ্রামের সেভরন থেকে আসেন না। সেভরনের পাশাপাশি ডা: দেওয়ান মনিরুল ইসলাম কনসেপ্ট হাসপাতাল, ডা: বাবলু কুমার বনিক ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক, ডা: জয়দেব সাহা মর্ডান ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েকদিন পরপর ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু হলেও এসব প্রতিষ্ঠানে চেম্বার করা ডাক্তারদের বেশিরভাগই ফেনী শহরের পুরোনো চেনাজানা। লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার করা ডা: আবুল কালাম মনজুর মোর্শেদ পপুলার. আমেরিকান, মেডিকেয়ার ডায়াগনস্টিক, কার্ডিয়াক হাসপাতালে চেম্বার করেন। ডা: মোহাম্মদ কামরুজ্জামান ফেনী চেম্বার ও জেড ইউ মডেল হাসপাতালে চেম্বার করেন। ডা: জাসরিন আক্তার মিলি ইবনেসিনা ও চিশতিয়া হাসপাতালে রোগী দেখেন।
এদিকে ফেনী জেলা বেসরকারি হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স এসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, জেলায় ৬০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ৪০টি হাসপাতাল রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসের কোন না কোন ছাড়পত্র ও লাইসেন্স নেই। প্রায়সময় এ সকল ক্লিনিকের পক্ষ থেকে স্থানীয় এলাকায় মাইকিং করে প্রচারণা চালানো হয়। গ্রামাঞ্চলে রোগী সংগ্রহ করতে অনেক প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করে।
সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের শাকিবুল ইসলাম নামে ১২ বয়সী এক স্কুল ছাত্র পেটের সমস্যায় ভুগছে দীর্ঘদিন। শহরের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের অন্তত ২০ জন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও তার রোগ নির্ণয় হয়নি। অথচ প্রতিটি ডাক্তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান সমূহে তাকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করিয়ে টাকা আদায় করা হয়।
একইভাবে সোনাগাজী উপজেলার চান্দলা গ্রামের সফিকুর রহমান শারীরিক সমস্যা নিয়ে শহরের একটি ক্লিনিকে নোয়াখালী মেডিকেল কলেজের সহকারি অধ্যাপক ডা: মাহফুজুর রহমানের শরনাপন্ন হয়। তার পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা করে কোন রোগ নির্ণয় হয়নি। আরেকটি ক্লিনিকে ডা: খালেদ মাহমুদ টিপুর কাছে প্রায় ১৫-১৬ বার ব্যবস্থাপত্র নিলেও সুফল মিলেনি।
পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের পেয়ার আহমেদ তার স্ত্রী আনোয়ারাকে নিয়ে শহরের জেড ইউ মডেল হাসপাতালের অর্থপেডিক্স চিকিৎসক ডা: কামাল উদ্দিনের কাছে নেন। পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বেশ কয়েকবার এসেও কোন উপকার না পেয়ে অন্যত্র চলে যান।
সোনাগাজী উপজেলার বাসিন্দা অবরসপ্রাপ্ত রেলওয়ে কর্মকর্তা সৈয়দ আহমদ জানান, ফেনী জেলায় যেভাবে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বেড়েছে সেভাবে চিকিৎসার মান বাড়েনি। এ কারনে সাধারণ রোগী ও তাদের স্বজনরা বারবার ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা করে রোগ শনাক্ত করতে পারেনা। ফলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানির শিকার হন।
ফেনী জেলা প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এন্ড ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন উর রশিদ জানান, মানুষের সেবার মান ঠিক রাখতে তাগিদ দেয়া হচ্ছে। তবে তদারকির দায়িত্ব সিভিল সার্জন কার্যালয়ের।
তার মতে, হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা বাড়লেও ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ছেনা। এজন্য জরুরী ভিত্তিতে মেডিকেল কলেজ স্থাপন সময়ের দাবী। এর মাধ্যমে ফেনীতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়বে, অন্যদিকে রোগীরা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যথাযথ সেবা পাবেন।
জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডা: মো: শিহাব উদ্দিন ফেনীর সময় কে বলেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে প্রতিটি অলিগলিতে হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক গড়ে উঠলেও কিছু করার নেই। কেউ যদি মনে করে কোন প্রতিষ্ঠানে ভালো সার্ভিস কিংবা ডাক্তার নাই তাহলে সেখানে যাবেনা।