তানভীর আলাদিন
ওরা সবাই দলিত সম্প্রদায়ের। তবে চায়ের শ্রমিক বা শ্রমিক পরিবারের সদস্য। মুখে রঙ মেখে সঙ সেজেছে কেউ-কেউ। নানান বয়েসী সবাই পুরুষ। তবে ক’জন এসেছেন শাড়ি চুড়ি পরে নারীর বেশে। ওরা পালা করেন, গান করেন, নাচও করেন, তবে একান্ত নিজেদের ঢংয়ে। এদের নাম দেয়া যায় ‘অবহেলিত শিল্পী’। এই অবহেলিত শিল্পীরা চায়ের দেশের পাহাড়গুলোতে বেড়াতে যাওয়া মানুষজনকে আনন্দ দিতে ভালোবাসেন।
ওদের বেশির ভাগের নামের সঙ্গে শব্দকর শব্দটি যোগ করেই পরিচয় দিচ্ছিলেন, আর ক’জনের নামগুলো কঠিন খুব। মনে হয় ওখানে শব্দকর আর শবর গোত্রের সম্মিলণ ছিলো।
আগেই শুনেছিলাম, শব্দকরদের পেশা বাড়িবাড়ি ঘুরে বা হাটবাজারে গানবাজনা করে দাক্ষিণা নেয়া। এই সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের বাস মৌলভীবাজার জেলায়। এই জেলায় বিভিন্ন থানায় প্রায় তিন শত ‘শব্দকর’ পরিবার রয়েছে। নামের শেষে এরা ‘শব্দকর’ পদবী ব্যবহার করে। মূলত হিন্দু ধর্মালম্বী, তবে এই ধর্মের শংকর জনগোষ্ঠিভূক্ত। শিব পূজা, চড়ক পূজা ইত্যাদির প্রচলন আছে শব্দকরদের মধ্যে। মুসলিম পীর ও দরগা সংস্কৃতির প্রতিও শব্দকরদের অনুরাগ দেখা যায়। ৭০ শতাংশ শব্দকর ভূমিহীন।
এছাড়া সিলেট অঞ্চলে বিশেষত মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোতে শবরদের বসতি রযেছে। শবরদের ভাষার সাথে বর্তমান ভারতের মুঙ্গের জেলার ভাষার মিল রয়েছে।
মনে হলো এই অবহেলিত শিল্পীদের ভাষা নিয়ে তেমন একটা মাথা ব্যাথা নেই, তবে অতিথিরদের সামনে শুদ্ধ কথা বলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় থাকেন… তারপরও শুদ্ধ, আঞ্চলিক আর নিজেদের ভাষায় মিলিয়ে ফেলেন… তবে গান গাওয়ার সময় সচেতন থাকার চেষ্টাটা বেশি… তাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যাই, শুনতে ভালোই লাগে।
ওরা ছোট বড় সবাইকে তুই সম্ভোধন করে, কানে লাগে তারপরও ভালো লাগে…। অবহেলিত শিল্পীরা অনেকগুলো গান শুনালেন।
যেমন-
‘মধু খই-খই আঁরে বিষ হাওয়াইলা, খোন খারনে ভালোবাসার দাম না দিলা।’
‘সোনাবন্ধু তুই আমারে ভোঁতা দা’ওদি কাইট্টালা, পিরীতের খেঁতা দিয়া যাইত্তা ধইরা মাইরালা।’
লাল পাহাড়ের দেশে যা-প্রজাপতির দেশে যা, ইতাক তোকে মাইছেনারে, ইক্কেবারে মানাইছেনারে।’
‘বনমালীগো তুমি পরজনমে হইও রাঁধা…।’
‘ঝুম্মা-লেকা, ঝুম্মা-লেকা, ঝুমা-ঝুমা লে…।’
এই শিল্পীরা চা শ্রমিক কিংবা শ্রমিকদের সন্তান, চায়ের দেশ-পাহাড়ের দেশ মৌলভীবাজারের শেষ প্রান্ত (ভারতের সীমান্ত) জুড়ি উপজেলার বাসিন্দা ওরা।
বছর কয়েক আগে এমন দিনে আমরা সপরিবারে ক’দিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম জুড়ি’র ডানকান গ্রæপের রাজকী টি স্টেট-এ। ম্যানেজারের বাংলোয় উঠেছিলাম। ওরা আবার কর্মকর্তাদেরকে বড় বাবু, ছোট মেঝ বাবু, ছোট বাবু বলেই ডাকেন…। প্রথম-প্রথম কানে লাগতো। ওদের আচরণ দেখে মনে হতো যেনো কোনো এক সামন্তবাদী রাজার প্রাসাদের অতিথি আমরা, বাবুরা বোধকরি রাজা-মন্ত্রী, আর ওরা নিরিহ প্রজা…। যাক ওরা ওভাবেই অভ্যস্ত..।
অবহেলিত শিল্পী ছেলেগুলো মেয়ে সেজে নাচ-গান করলো, পালা গাইলো…।
যাওয়ার আগে আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুললো, এক কিশোর বললো, বাবু তুই পেপারে লিখিস? কি লিখিস বাবু ? এই নাইচ-গানা লিয়ে লিখবিতো?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। ওরা ধিং-ধিং করে হেলে-দুলে চলে গেলো।
ওদের নিয়ে কিছু লিখবো বলেই, নাম-ধাম নিয়েছিলাম, নোটবুকে টুকেও নিয়ে ছিলাম। কিন্তু ওই সফরে থাকা অবস্থায় মৌলভীবাজার থেকে গেলাম রাঙামাটিতে। ওখানে গিয়ে শুভলং লেকে টর্নেডোর কবলে পড়ে ছোট-খাটো কিছু জিনিসের সঙ্গে নোটবুকটাও হারিয়ে ফেলি! অবহেলিত শিল্পীদের নিয়ে তাই আর লিখতে পারিনি, নোটবুকটি হারিয়ে যাওয়ায় নামগুলো মনেও রাখতে পারিনি। ক্ষমা চাইবো যে তারওতো কোনো পথ নেই। তবে ওদেরকে আমার অনেকদিন মনে থাকবে। মনে থাকবে ওদের সরলতা…। প্রার্থনা করি ভালো থাকুক আমার ভালোলাগার সেই অবহেলিত শিল্পীরা।
লেখক : সভাপতি, ফেনী সাংবাদিক ফোরাম- ঢাকা।