নিজস্ব প্রতিনিধি :
দাগনভূঞা উপজেলা ভূমি অফিস পরিপূর্ণ একটি সরকারি সেবাখাত ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হলেও এর কর্মকর্তা কর্মচারীদের খাই খাই আচরণ সরকারি সেবাখাতের পর্যায়ে থাকছেনা বলেই বাস্তবতায় প্রতীয়মান হচ্ছে। টেবিলে টেবিলে টাকা না পৌঁছালে হয়রানি আর মাসেরপর মাস ঘুরতে হয় ফাইলের পেছনে। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
দাগনভূঞা উপজেলা ভুমি অফিসের আওতাধীন ভুমি মালিক বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কার্যদিবসগুলোতে জমা খারিজ, নামজারি, ভুমিকর ও নানাবিধ সমস্যার সমাধান, অভিযোগ ও প্রতিকারের জন্য আবেদন নিবেদন নিয়ে হাজির হন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। সংশ্লিষ্ট কাজ ও কাজের অগ্রগতি খোঁজখবর নিতে লোকজন অফিসে এলে সুনির্দিষ্ট কোন ডেস্ক না থাকায় এই কক্ষে ওই কক্ষে ঢু দিয়ে মানুষকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বলে অভিযোগ। জমির খাজনা প্রদান থেকে শুরু করে জমাখারিজ, নামজারি প্রায় সব ধরনের কাজ ডিজিটাল অনলাইন পদ্ধতিতে চালু হবার ফলে গ্রাহক পর্যায়ে এর কাঙ্ক্ষিত সুফল পেতে আর্থিক চাপ ও বিড়ম্বনা বেড়েছে বলে ভূমি মালিকদের অভিযোগ। ভূমি অফিস থেকে অনলাইনে আবেদন করতে চাইলে কখনো নেট সমস্যা, কখনো লোক থাকেনা এমন অবহেলাপূর্ণ বার্তা দিয়ে লোকজনকে পিরিয়ে দেয়ার অভিযোগ আছে। দীর্ঘ নয়মাস ঘোরাঘুরি করে জমা খারিজের কপি হাতে পেলেও তাতে জমির মোট পরিমানের যোগের ভুল নিয়ে অভিযোগ জানাতে এলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লোকজন এটেবিল থেকে ঐ টেবিলে ভুক্তভোগিকে ঠেলে দিতে দেখা গেছে। ভুক্তভোগীর নাম মিজান।
জায়লস্কর ইউনিয়নের উত্তর জায়লস্কর গ্রামের বাসিন্দা মিজান অফিসের কৃত ভুলের জন্য সংশোধনী চাইতে গিয়ে হয়রানির স্বীকার হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ভূমি অফিসে খাজনা দিতে গেলেও বিড়ম্বনার শেষ থাকেনা। বারাহীগুনী গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল হক জায়লস্কর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে দীর্ঘ দিনের পুরনো খাজনা দিতে গেলে ইউনিয়ন সহকারী ভুমি কর্মকর্তা দীলিপ কুমার (বর্তমানে বদলী হয়ে সোনাগাজীতে আছেন) তার কাছে ২৪ হাজার টাকা খাজনা দাবী করেন। সর্বশেষ নানান দফা রফায় সেটি ১০ হাজার টাকায় নেমে আসে এবং খাজনার রশিদ দেয়া হয় সাড়ে সাত হাজার টাকার।
ভুক্তভোগীকে দীলিপ কুমার বলেন, সবতো আমরা নিতে পারিনা, উপরে নীচে সব হাতে কিছু দিতে হয়। দঃ জায়লস্কর গ্রামের বাসিন্দা বেলাল বলেন একটা নামজারীর আবেদনের বিপরীতে এই অফিস থেকে পাস করিয়ে নিতে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে এক হাজার টাকা উপরি দিতে হয়। একই অভিযোগ সোনাপুর গ্রামের বাসিন্দা মশিউর রহমানের। দীলিপ কুমার বর্তমানে জায়লস্কর ইউনিয়ন ভুমি অফিসে কর্মরত না থাকলেও ফোনে তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন- এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন, তবে কেউ খুশি করে কিছু দিলে সেটি ভিন্ন কথা।
সোনাপুর গ্রামের মশিউর রহমান বলেন- জমাখারিজ বা নামজারির আবেদন অনলাইনে করার পর দোঁড়াতে হয় ফাইলের পিছনে। তদবির না করলে পদে পদে হয়রানি। প্রত্যেক ভূমি অফিস দালাল চক্র বেষ্টিত। দালালদের জন্য সব দরজা খোলা।
মশিউর বলেন- ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে ফাইল যাচাই-বাচাই হয়ে উপজেলা অফিসে গেলে সেখানে কম্পিউটারে ফাইল পুটাপ দিতে পিয়নের মাধ্যমে দিতে হয় উপরী। সেখানে কাজ করেন ফাতেমা নামের এক মহিলা কর্মকর্তা। তিনি সরাসরি কোন উপরি নেননা। পিয়ন দিদার ঐ কক্ষের উপযুক্ত মাধ্যম। কক্ষের বরাদ্দ ফি ছাড়া ব্যক্তিগত ভাবে পিয়নকেও খুশি করতে হয়। ঐ কক্ষে পিয়নের মাধ্যমে দিতে হয় ১৫০০ টাকা। এটি হল তাদের ভাষায় এলারট ফি। সরকারী কোন নথিপত্রে এর নাম না থাকলেও তারা এই আজগুবি নামের উদ্ভাবক। এই টাকা কক্ষের সবার মধ্যে বন্টন হয় বলে একজন ব্রোকারের অভিযোগ। এরপর সার্ভেয়ার কক্ষে দৌঁড়ঝাপ। সার্ভেয়ার সাহেবও ভালো মানুষ, তিনিও সরাসরি কিছু নেননা। সহকারী আফসারের মাধ্যমে দফারফা হলে তারপর ফাইল টেবিলে উঠে। অনেক ভুমি মালিকের সাথে কথা বললে তারা আর্থিক লেনদেনের কথা স্বীকার করলেও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। সকলেরই ভয় জমিজমার কাজে বিভিন্ন সময় এখানে আসতে হবে একবারেই তো শেষ নয়। তখন ওরা নানান ছুতায় ফাইল আঁটকে দিবে। ফাইল আটকানোর ভয় থেকে মানুষকে শুদ্ধি আশ্বাস দেবে কে? দালাল চক্র এবং ভুমি অফিস সমূহের সরকারী বেতনভুক্ত অসাধু লোকদের লোভের থাবা থেকে সাধারণ ভূমি মালিকদের হয়রানি ও পকেট কাটার ফাঁদ থেকে রক্ষা করবে কে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্রোকার ও ভেন্ডর জানান, ভূমি মালিকদের আবেদন নিবেদন ফাইলাপ করার পর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের দ্বায়িত্বশীল কর্মকর্তা সঠিক ভাবে যাচাই বাচাই না করে টাকা নিয়েই সাইন করে ফাইল পাঠিয়ে দেন। অর্থাৎ কোন নামজারি, জমাখারিজের আবেদন ও সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টসাদি ভেন্ডর বা দালাল ব্রোকাররা যেভাবে ফাইল করে জমা দেয় সে ফাইল ভূমি কর্মকর্তারা যতার্থ ভাবে যাচাই বাচাই না করে দালাল বা ভেন্ডরদের জ্ঞান দক্ষতার উপর ভরসা রেখে ফাইল সাইন করে দিয়ে থাকেন। এরপর জমা খারিজ বা নামজারিতে ভূল তথ্য এলে এর দায় কেউ নিতে চায়না। ভুলের খেসারত কার্যত ভূমি মালিককেই গুণতে হয়। এই রকম খামখেয়ালী ভুলের অভিযোগ বিস্তর।
সংশ্লিষ্ট দফতরের অনিয়ম দূর্ণীতি বিষয়ে কথা হয় দাগনভূঞা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহরাজ শারমিনের সাথে। তার দফতরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের অনিয়ম দূর্ণীতি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে তিনি নির্ভয়ে জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন আমার দরজা সর্বসাধারণের জন্য সব সময় খোলা। জনগণের সেবা করার জন্য এসেছি। নামে কালিমা লেপন করার জন্য আসিনি। দাগনভূঞা উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস ঘিরে দালাল চক্র ও অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের হয়রানি, ঘুষ বাণিজ্যের থাবা কিভাবে বন্ধ হয়ে ভূমি মালিকরা নির্বিঘ্নে নিরাপদে কাজ করতে পারবে সে পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দ্বায়িত্ব উর্ধ্বতনের উপরই বর্তায় বলে সচেতন মহল মনে করেন।