নাজমুল হক
উপমহাদেশের মধ্যে একমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বত্র বিরাজমান নাগরিক বৈষম্য, রাজনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার বৈষম্য, আয় রোজকারের বৈষম্য, বিভিন্ন ভাতার বৈষম্য, চাকুরির কোটা পদ্ধতির বৈষম্য, ধনী গরীবের সুযোগ সুবিধা ভোগ করার বৈষম্য, আইনের শাসন ও সুশাসন এর বৈষম্য, সরকারী বেসরকারি চাকুরির বৈষম্যে। ব্যাংক বীমা কোম্পানি থেকে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যে। ১৮ কোটি মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বৈষম্য ইত্যাদি।
একটি শিশু স্বাধীন দেশে জন্মড়্র্রহণ করে মাথাপিছু কোটি কোটি ডলার বিদেশি লোনের বোঝা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অথচ শিশুদের একটি অংশের বসবাস বস্তিতে, হাওর বাওরে, চরাঞ্চলে, নদ নদী খাল বিলের পাড়ে, পাহাড়ি এলাকায়। ৮৫শতাংশ বসবাস করে অনুন্নত পল্লীতে। যেখানে নেই মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। খাদের বাজারে আগুন, খাদ্য ও পুস্টির অভাব। একজন শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। যে সকল নাগরিক বৈষম্যের কবলে বাংলাদেশ তার বিবরন নিম্নরূপ।
আবাসন ব্যবস্থায় বৈষম্য : ১৮ কোটি মানুষের জীবন যাপন করার জন্য পরিবেশ বান্ধব আবাসনের সুব্যবস্থা নেই। কিন্তু আমলা বা সরকারী কর্মচারীদের জন্য বিভিন্ন আবাসন বা গৃহ লোনের ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা চট্টগ্রাম সিলেট বগুড়া রাজশাহী খুলনা শহরে আবাসিক এলাকায় উন্নত পরিবেশে বসবাসের সুযোগ পেয়েছে সরকারী কর্মকর্তাদের পরিবার ও ছেলে-মেয়েরা। সংবিধান মোতাবেক দেশের মালিক ও নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি শিশুর।
শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য : টাকা আছে যার মানসম্মত শিক্ষা ক্রয়ের অধিকার আছে তার। ঢাকা চট্টগ্রাম এবং সিটি কর্পোরেশন এলাকা আছে নটেরডেম কলেজ ভিকারুননিসা, সেন্ট যোসেফ, শাহীন স্কুল, মনিপুর স্কুল, ক্যান্ট পাবলিক স্কুল, পাইলট স্কুল, জেলা স্কুল ইত্যাদি। সেখানে ৮০শতাংশ সাধারণ নাগরিকদের সন্তানের জন্য লেখাপড়ার সুযোগ নেই। অনেক স্কুল আছে অভিভাবকদের আয়-রোজগার যাচাই করে শিশুদের স্কুলে ভর্তি করে। দরিদ্র মানুষের কোচিং সেন্টারের খরচ বহন করতে না পারলে শিশুটি মানসম্মত লেখাপড়ার সুযোগ পাবে না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভতিতে কোটা বৈষম্য : সরকারী কর্মকর্তাদের ছেলে-মেয়ের জন্য সরকারী স্কুলে ভতির অবারিত সুযোগ। সেনাবাহিনীর অধীনে স্কুল ও কলেজ সামরিক বাহিনীর ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার সুযোগ ১০০শতাংশ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচ্যান্সেলর অধ্যাপক মালী পিয়ন ও কর্মচারীদেও ছেলে-মেয়ের ১০০শতাংশ ভর্তির সুযোগ রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনি বি.এ (সন্মান) ও এম.এ ডিগ্রি পেয়েছেন কিন্তু আপনার ছেলে মেয়ের ভর্তির কোন কোটা নেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালির ছেলে-মেয়ের ভর্তির কোটা আছে। সেনাবাহিনী পরিচালিত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ এ ভর্তির জন্য সামরিক বাহিনীতে চাকুরীজীবির ছেলে-মেয়ের ভর্তির জন্য ১০০শতাংশ কোটা আছে। সরকারী কর্মকর্তা বদলী হয়ে বাংলাদেশের যে প্রান্তে যাবে সেখানে তাদের ছেলে-মেয়ের ভর্তির কোটা আছে। যে নাগরিক রাস্ট্রকে টেক্স প্রদান করে তাদের জন্য কোন শিক্ষার কোটা সুযোগ নেই।
স্বাস্থ্যসেবা খাতে বৈষম্য : বাংলাদেশের সরকারী বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বৈষম্য। দুপুর ২টার পরে কোন চিকিৎসক নেই। ডাক্তারও নেই বিনামূল্যের ঔষুধ নেই। পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টাফ নেই। যন্ত্রপাতি আছে কিন্তু সিরিয়াল ২ মাস পরে। গরীব রোগী মারা যাবে, বেঁচে থাকলে চিকিৎসা পাবে। যদি বড় ভাইদের নিয়ে আসতে পারেন অথবা বড় বকশিশ দিতে পারেন অথবা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় সিরিয়াল নিতে পারেন তাহলে কিছুটা চিকিৎসা পাবেন। সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য জন্য জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রতি মাসে একদিন করে ভিজিট করতো তাহলে অনিয়ম, অষুধ পাওয়া এবং চিকিৎসক ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত হতো। স্বাস্থ্যসেবা খাতকে ২ বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিকিৎসা বিভাগের অধীনে রাখা হলে চিকিৎসকদের মাঝে মানবিক মর্যাদা মূল্যবোধ জাগ্রত হতো।
রাস্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সেবা থেকে বৈষম্য : বিদ্যুৎ, টেলিফোন, পানি খাজনা গ্যাস, কাস্টমস আয়কর বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর, সাব রেজিষ্ট্রেশন অফিস, ভূমি অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন ইত্যাদি থেকে টাকা ছাড়া কোন সেবা পাওয়ার সুযোগ নেই। জিডি, মামলা, আসামি গ্রেফতার, পুলিশ ক্লিলিয়ারেন্স, জন্মনিবন্ধন, জমির মালিকানা বদল, ওয়ারিশ সনদ, এনআইডি সংশোধন, পাসপোর্ট তৈরি রেজিষ্ট্রেশন, নামজারি করতে অবশ্যই টাকা দিতে হবে। এখন জাতির প্রশ্ন হলো সরকারী কর্মচারীরা বেতন বোনাস প্রমোশন পেনশন অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এবং ঘুষ বানিজ্য একসাথে করবে। ঘুষখোর দুনীতিবাজ সরকারী কর্মকর্তাদের চাকুরী থেকে অব্যাহতি দিয়ে এসকল রাস্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে নাগরিকদের সকল সেবা নিশ্চিত করা যায় এবং রাস্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় রোধ করা যায়।
দিবস পালনের জন্য ভাতা বৈষম্য : জাতীয় দিবস ও সামাজিক উন্নয়ন দিবস, আন্তর্জাতিক দিবস, যুব দিবস, সমাজসেবা দিবস, পরিবেশ দিবস, নারী দিবস, নারী উদ্যোক্তা দিবস ইত্যাদি মোট ৩৭ দিবস পালন করা হয়ে থাকে, সেখানেও বিভিন্ন ভাতা প্রদান করা হয়ে থাকে। নো পেমেন্ট নো প্রোগ্রাম।
একজন সংসদ সদস্যের মাসিক সুযোগ সুবিধা : ১. মাসিক বেতন ৫৫,০০০ টাকা। ২. নির্বাচনী এলাকার ভাতা প্রতিমাসে ১২,৫০০ টাকা। ৩. সম্মানী ভাতা প্রতিমাসে ৫,০০০ টাকা। ৪. শুল্কমুক্তভাবে গাড়ি আমদানির সুবিধা। ৫. মাসিক পরিবহন ভাতা ৭০,০০০ টাকা। ৬. নির্বাচনী এলাকায় অফিস খরচের জন্য প্রতিমাসে ১৫,০০০ টাকা। ৭. প্রতিমাসে লন্ড্রি ভাতা ১,৫০০ টাকা। ৮. মাসিক ক্রোকারিজ, টয়লেট্রিজ কেনার জন্য ভাতা ৬,০০০ টাকা। ৯. দেশের অভ্যন্তরে বার্ষিক ভ্রমণ খরচ ১২০,০০০ টাকা। ১০. স্বেচ্ছাধীন তহবিল বার্ষিক পাঁচ লাখ টাকা। ১১. বাসায় টেলিফোন ভাতা বাবদ প্রতিমাসে ৭,৮০০ টাকা। ১২. সংসদ সদস্যদের জন্য সংসদ ভবন এলাকায় এমপি হোস্টেল আছে। এছাড়া একজন সংসদ সদস্য প্রতিবছর চার কোটি টাকা করে থোক বরাদ্দ পাবেন। এই থোক বরাদ্দের পরিমাণ আগে ছিল দুই কোটি টাকা। সদস্যদের পেছনে রাষ্ট্রের এই খরচটা আমাদের দেশের মানুষের রক্ত পানি করা টাকা। এভাবে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাস্ট্রের টাকায় চিকিৎসা সুবিধা ভোগ করে আসছে।
খাদ্যের লাগামহীন মুল্য বৃদ্ধি : রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি, বেকার সমস্য, অর্থ পাচার, ব্যাংকের টাকা লুটপাট ও দুর্নীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বাদ দিয়ে রাজনৈতিক বিষাদাগার নিয়ে চলছে বাংলাদেশ। খাদ্যের লাগামহীন মুল্য বৃদ্ধি রোধে সরকারী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের লিডারদেও কোন ভূমিকা নেই।
দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোন প্রোগ্রাম নেই : হাজার হাজার কোটি কালো টাকা সাদা করার জন্য প্রতিটি বাজেটে ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে পরিশুদ্ধির বিধান রাখা হয়েছে। ৭ শতাংশ টাকা রাস্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে দুনীতিবাজরা দুর্নীতির কলংকমুক্ত হয়ে ভিআইপি সিআইপি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। এই দুনীতিবাজদের সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি এতই শক্তিশালী যে মুনিয়াদের রক্ষিত রেখে ধর্ষন হত্যা করে পার পেয়ে যায়। ওদের টাকার হাত এতটা শক্তিশালী সেখানে আইন শৃংখলা বাহিনী অসহায়। জে: এরশাদ সরকারের শাসনকালে আলোচিত শারমিন রিমা হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে সাংবাদিকদের আন্দোলনের মুনিরের ফাসী এবং মুনিরের প্রেমিকা খুকুমণি যাবজ্জীবন শাস্তি হয়েছিল। আইন শৃংখলা বাহিনীর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং সাংবাদিকদের প্রতিবাদ এর মুখে ঢাকার মনোয়ারা হাসপাতালের মালিক ডাক্তার দম্পতির বখাটে ছেলে মুনিরের ফাসী কাযকর হয়েছে। মুনিয়া হত্যাকারীরা আইন শৃংখলা বাহিনীর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, হলমার্ক, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বড়পুকুরিয়া কয়লা চুরি, রেলপথ মন্ত্রনালয়ে কালো বিড়াল দুর্নীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিসহ বড় বড় দুর্নীতি করে যারা অঢেল ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, যারা টাকায় রাজনৈতিক দলের আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেয়ে দুর্নীতির হাজার হাজার কোটি টাকায় শিল্প কারখানা- বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ ও বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং যাদের দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পদ রয়েছে, বাসায় অনেক চাকর-বাকর ও অনেকগুলো গাড়ির মালিক তারই তো ধনী।
সমাজে বিশেষ একশ্রেণির মানুষ রয়েছে যাদের অর্থবিত্তের পরিমাণ আমাদের ধারণারও বাইরে। তাহারা নিজেদেরকে তুলনা করে টাটা, বিড়লা ও বিল গেটসের সাথে। মেধা-যোগ্যতা ও পরিশ্রম দিয়ে তারা নিজেদেরকে আজ এ পর্যায়ে উন্নীত করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের ধনীরা জনগণ ও রাষ্ট্রের অর্থ লুটেপুটে বড় হতে চায়। সমাজের অধিকাংশ সম্পদশালী মানুষের অবস্থা এমনই। সম্পদশালী মানুষের একটি বড় অংশ ঋণখেলাপী। এদের মধ্যে অনেকে ঋণ মওকুপের জন্য রাজনৈতিক শক্তির দাপট দেখায়। এইসব লোকেরা আবার শ্রমশোষণকারীও। নিজেদের শিল্পকারখানার শ্রমিককে ন্যায্য মজুরি না দিলেও তারা দেশ-বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণে খুবই আগ্রহী। ইসমাইল হোসেন সিরাজী কতো চমৎকারভাবেই না বলেছেন- ‘যে লোক বছর বছর হাওয়ায় জাহাজে করে হজ করে আসেন, তিনি যদি তাঁর কারখানার শ্রমিককে ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেন এবং মৃত্যুর পর তার কবরে সোনার চাবি রেখে দিয়ে আসলে সে চাবি দিয়ে বেহেশতের কোনো দরজাই খুলতে পারবে না’। মানুষের প্রতি জুলুম করে কেউ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললে সে মোটেই ধনী নয়; বরং এই সম্পদ তার জন্য বিপদের কারণ হবে এবং আখিরাতে মজলুমের পাওনা পরিশোধ করতে গিয়ে সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়বে।
বৈষম্যের কবলে বাংলাদেশ। নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শ্রেণি-বৈষম্যে দূর করতে হলে কোটা পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। বিভিন্ন ভাতা বাতিল করে এসএমই উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য উদ্যোক্তা লোন দিতে হবে। দেশের মালিক নাগরিকদের শিক্ষা স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। লুটপাট করে কোটি কোটি টাকার মালিকদের বিরোদ্ধে আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। খাদ্যের লাগামহীন মুল্য বৃদ্ধি রোধে সরকারী দল এবং বিরোধী দল এবং সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। ধনী ও দারিদ্রের ব্যবধান কমানোর জন্য ভারসাম্যহীন আইন কানুন বাতিল করতে হবে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।