অনলাইন ডেস্ক:
শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোয় আগুন লাগে এবং একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।ঘটনাস্থলে আসেন বিবিসি বাংলা,ঢাকা’র সংবাদদাতা আকবর হোসেনসহ বিবিসির একটি টীম।তাঁর দেখা ঘটনাস্থলের বর্ণনা আজ বিবিসি বাংলায় পরিবেশিত হয়।ফেনীর সময় এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল:
ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে চট্টগ্রামের আগে সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম আমরা বিকাল পাঁচটার দিকে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বিএম কন্টেইনার ডিপোটি তৈরি করা হয়েছে। মহাসড়ক থেকে হেটে সেখানে যেতে পাঁচ থেকে সাত মিনিট সময় লাগে। এই ডিপোয় যাওয়ার জন্যই রাস্তাটা তৈরি করা হয়েছে।
সেখানে যখন যাচ্ছি, দেখলাম অনেক অ্যাম্বুলেন্স, র্যাবের গাড়ি, পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে মোতায়েন রয়েছে।
তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। মাঝে মাঝেই দেখতে পাচ্ছিলাম, ভেতর থেকে ধোঁয়া উঠছে। মাঝে মাঝে সেই ধোঁয়ার তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে।ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি দমকল কর্মী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে কর্মীরা কাজ করছিলেন, তারা নিরাপদ দূরত্বে থেকে কাজ করার চেষ্টাটা করছিলেন। কারণ তখন একটা আশঙ্কা ছিল যে, আরও কোন বিস্ফোরণ হয় কিনা।
ডিপো এলাকার ভেতরে ঢোকার কোন সুযোগ ছিল না, নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমি নিজেও ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করিনি। কারণ দমকল বাহিনীর কর্মী এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের আশঙ্কা ছিল যে, হয়তো আরও কোন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড কন্টেইনার থাকলেও থাকতে পারে এবং আরও বড় বিস্ফোরণ হতে পারে। সুতরাং ভেতরে যাওয়াটা একেবারে নিরাপদ ছিল না।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল যে কন্টেইনারগুলো তখনও পুড়েছে। কিন্তু ভেতরে কতটা বীভৎস অবস্থা তৈরি হয়েছে, সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না, যদিও একটা যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে।
ভেতরে যে বিস্ফোরণ বা আগুনের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রভাব পড়েছিল আশেপাশের এলাকাতেও। ওই ডিপোর দেয়াল ঘেঁষে যে এলাকা আছে, আমি সেখানে গেলাম। ওখানে একটা মসজিদও আছে।
সেই মসজিদের জানালার কাঁচ বিস্ফোরণের পর ভেঙ্গে পড়েছে। আশেপাশের অনেক বাড়িতে কন্টেইনারের টুকরো স্পিন্টারের মতো বাড়িতে পড়েছে, টিন ছিদ্র হয়ে গেছে, অনেকে বাড়ির জিনিসপত্র ভেঙ্গে পড়ে গেছে। বিশেষ করে যেসব দোতলা, তিনতলা ভবন ছিল, সেখানে কম্পনটা বেশি টের পাওয়া গেছে।
সেখানকার একজন স্থানীয় বাসিন্দা ৬০-বছর বয়সী মোস্তফা কামাল ডিপো থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে বাস করেন। তিনি আমাকে বলছিলেন, বিস্ফোরণের তীব্রতা এতো বেশি ছিল যে, উনি নিজে প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না এটা কী ঘটছে। প্রথম ১০ মিনিট তিনি কানে আর কিছু শুনতে পাননি। তার বাড়ির সবাই তখন বাইরে বের এসে বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে, বিস্ফোরণের শব্দ কোথায় থেকে আসছে? তাদের মধ্যে একটা ভয় জেঁকে বসেছিল। একপর্যায়ে তারা ডিপোর দিকে কয়েকশো ফিট উঁচু আগুন জ্বলতে দেখতে পান।
পাশের একটি চা দোকানের কর্মী একজন তরুণ বলছিলেন, যখন প্রথম বিস্ফোরণ হয়, তখন তিনি দোকানেই ছিলেন। এতো বেশি শব্দ হয়েছিল যে, তিনি দোকানের ভেতরেই হতভম্ব হয়ে বসে ছিলেন। তিনি অন্য কোন শব্দ আর কানে শুনছিলেন না।
আমরা যখন গিয়েছি, তখন প্রায় ২৪ ঘণ্টার কাছাকাছি হয়ে গেছে, কিন্তু তখনো আগুন নেভেনি। সেজন্য এলাকাবাসীর আতঙ্ক আরও বেশি ছিল।
ওই এলাকার আশেপাশে সারারাত-সারাদিন ধরেই অনেক মানুষ ঘিরে ছিল। যদিও ডিপোর কাছে কাউকে যেতে দেয়া হয়নি। সবাই মহাসড়কের ওপর ভিড় করে ছিলেন। সে কারণে মহাসড়কের ওপরেই একটা দীর্ঘ যানজটের তৈরি হয়েছিল।
যেখানে ডিপোটি তৈরি হয়েছে, পুরো এলাকাটি একটা শিল্পাঞ্চল, নানা ধরণের কারখানা রয়েছে।
আজ (সোমবার) সকালের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তবে এখনো ডিপোর ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এখনো সেখানে প্রবেশ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ।
আজ সারাদিন আমি কাটিয়েছি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বার্ন ইউনিটে।
এই ইউনিটে ১৫০ জনের মতো গুরুতর আহত মানুষকে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানেও রোগীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
তবে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেটের সামনে অনেকেই আহত স্বজনদের জন্য ভিড় করছিলেন। আবার অনেকে ছবি হাতে তাদের স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
যাদের স্বজনরা নিখোঁজ রয়েছেন, তারা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সিআইডির বুথের সামনে লাইন ধরেছিলেন। সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে আমার কথা হয়।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ খালেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এখন পর্যন্ত ১৭ জনের মরদেহ এখনো শনাক্ত করা যায়নি। তাদের পরিচয় বের করার জন্য দুপুর পর্যন্ত ২৩ জনের নমুনা নেয়া হয়েছে।
প্রতিটি পরিবারের দু’জনের কাছ থেকে নমুনা হিসাবে রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে একমাস সময় লাগতে পারে বলে তিনি জানান।