নিজস্ব প্রতিনিধি :
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহানের হত্যকারীদের সাজার রায় দ্রæত কার্যকরের দাবি জানিয়েছে পরিবার। আজ সোমবার আলোচিত এই হত্যকান্ডের চার বছর পূর্তি হচ্ছে। নুসরাতে মৃত্যু নিয়ে স্বজনদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে তারা এ কথা বলেন।
নুসরাতের শয়ন কক্ষে এখনও ঘুমান তার মা শিরিন আক্তার। ওই কক্ষে শুয়ে তিনি মেয়ের শূন্যতা অনুভব করেন। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে নুসরাতের বিছানায় বসে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে মেয়ের জন্য দোয়া করেন তিনি।
শিরিন আক্তার বলেন, হাসপাতালের বিছানায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও নুসরাত বিচার চেয়ে গেছেন। নুসরাতের হত্যাকারীদের রায় কার্যকরের খবর শোনে মরে গেলেও তার কোন আক্ষেপ থাকবে না। তিনি নুসরাতের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকারি-বেসরকারিভাবে যেন ভালো একটা মহত কাজের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
নুসরাতের মা শিরিন আক্তারের কাছে মেয়ের শূন্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে’ তিনি বলেন, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায় বিচার পেয়েছি। শুনেছি উচ্চ আদালতে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আপিল করেছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসামিদের রায় দ্রæত কার্যকরের জন্য দাবি জানাচ্ছি। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, চারবছর আমি আমার মেয়ের কণ্ঠে মা ডাকটি শুনতে পাই না। রাতে ঘুম হয় না। ভাত খেতে বসলে ঠিক মত খেতে পারিনা। কারণ আমার মেয়ের হাত-পা বেঁধে যখন তারা আগুন লাগিয়েছিল, তখন আমার মেয়ে কি করেছিল? হাসপাতালে চিকিৎসকরা আমাকে বলে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ? তখন আমার মেয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিল। আমার মেয়েকে মহান আল্লাহ পাঁচ দিন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তার জবান থেকে খুনিদের নাম বেরিয়ে আসার জন্য।
বিশ্বজুড়ে আলোচিত অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতরে আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান হত্যাকান্ডের চারবছর পূর্ণ হচ্ছে আজ সোমবার। ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল শনিবার সকালে পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে আসার পর কয়েকজন সহপাঠি তাকে ডেকে মাদরাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। পরে ১০এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এবং প্লাষ্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ নুসরাত মারা যান। সেদিন রোমহর্ষক হত্যার ঘটনাটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন, পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ও মাদরাসার ইংরেজির প্রভাষক আবছার উদ্দিনসহ ১৬ আসামিকে ফাঁসির রশিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যু কার্যকর করার আদেশ দেন। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে একলাখ টাকা করে জরিমানারও আদেশ দেন। রায়ে সন্তুষ্ট হয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞা জানায় নুসরাতের পরিবার। এরপর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য উচ্চ আদালতে গিয়ে পৌছালে করোনার সংকটময় পরিস্থিতিতে নুসরাত হত্যার বিচার কাজ ব্যাহত হয় বলে জানিয়েছেন মামলার আইনজীবী শাহজাহান সাজু।
এদিকে নুসরতে পরিবার বলছে, নিম্ম আদালতে রায় ঘোষনার পর থেকে অদ্যবধি আসামি পক্ষের লোকজন ফেসবুকে নুসরাত ও তাঁর পরিবার নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও বিষোদগার করছে। সম্প্রতি হঠাৎ করে মামলার পুনতদন্ত দাবি করে আসামিপক্ষের লোকজন ফেনী ও সোনাগাজী শহরে মানববন্ধন করেছে।
সোনাগাজী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের উত্তর চর চান্দিয়া এলাকায় নুসরাত জাহানের বাড়ি। টিন সেড, চার কক্ষ বিশিষ্ট ঘরের ঢুকতেই দ্বিতীয় কক্ষে থাকতেন নুসরাত। সেই কক্ষের বিভিন্নস্থানে এখনও নুসরাতে হাতের বিভিন্ন ধরনের লেখা স্মৃতি হিসেবে রয়েছে। সেই কক্ষে তার মা ঘুমান।
গতকাল রবিবার দুপুরে নুসরাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সুনসান নিরবতা। পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তায় দুইজন পুলিশ সদস্য বাড়ির সামনে বসে আছেন। বাড়ির সবার ঘরে চলছে ইফতারের প্রস্তুতি।
নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আশা করছেন নিম্ম আদালতের হত্যা মামলার রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে। বাড়িতে পুলিশ থাকায় নিরাপদ বোধ করলেও বাইলে গেলে আসামি পক্ষের লোকজনের হুমকি-ধামকিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন।
তিনি বলেন, নুসরাত আহত হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাহসিকতার সহিত অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন। সেই নুসরাতের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সরকারি ভাবে একটি উদ্যোগ গ্রহনের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনাসহ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
মাহমুদুল হাসান নোমান আরও বলেন, ঘটনার পর থেকে আসামি পক্ষেও লোকজন ফেসবুকে তাদের নিয়ে বিষেদগার করে পোস্ট দিয়ে হুমকি দিচ্ছে। বাড়িতে পুলিশি পাহারা না থাকলে খুনিদের লোকেরা তাদের ক্ষতি করতো। তিনি পুলিশি পাহারা অব্যাহত রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেন।
মামলার আইনজীবী এম. শাহজাহান সাজু বলেন, একই বছরের ২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ডাদেশ হলে মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। সেই অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিলো। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করেছেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে শুনানী শুরু হতে দেরি হওয়ায় সে বেঞ্চ বাতিল হয়ে গেছে। এরপর আর বেঞ্চ গঠন হয়নি। তিনি আশা করছেন করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় পুনরায় বেঞ্চ গঠন করে মামলার শুনানী শুরু হবে। নুসরাত হত্যামামলার আসামীরা বর্তমানে ফেনী, কুমিল্লা, কাশিমপুর, চট্টগ্রামের কারাগারে রয়েছেন।
নুসরাত চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকিতে পরিবারের পক্ষ থেকে খতমে কুরআন ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে প্রশাসানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ আত্মীয়-স্বজনরা অংশ নেবেন।
এদিকে নুসরাত থানায় বিচার চাইতে গেলে সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মো. মোয়াজ্জেম হোসেন নুসরাতকে জিজ্ঞাবাদ করার নামে তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। তা ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেন। এ ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় ৮ বছরের সাজা হয়েছে।