তরুণ ও যুবসমাজ যে কোন জাতির মূল চালিকাশক্তি। তারুণ্য জাতির ঐশ্বর্য। তারুণ্যের দুর্বার গতিময় পথচলা জাতিকে কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেয়, আবার দুর্যোগকালে জাতীয় স্বার্থে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও পিছু হটেনা। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের অভূদ্যয়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুগেযুগে কেমন দুর্দান্ত অপরিসীম সাহসী ভূমিকা রেখেছিল তরুণ ও যুবসমাজ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো জাতির এই তারুণ্য শক্তি এখন বিপদগ্রস্ত, দিশেহারা হয়ে লক্ষ্যহীন গন্তব্যে এগিয়ে চলছে। শহরের অভিজাত এলাকা,ফুটপাত, আলি-গলি থেকে শুরু করে গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের আনাচে কানাচে অবাধে গড়ে উঠেছে মাদকের অভয়ারণ্য। কৈশোর বয়সের ঊষালগ্নে ছোট শিশুরা মাদক নামক বিভিন্ন নেশার উপকরণের সাথে পরিচিত হয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে মাদক জগতে। নেশাগ্রস্ত হয়ে হারিয়ে ফেলছে নিজেদের হিতাহিত জ্ঞান। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় জনীত করণে বেপরোয়া জীবনে পা বাড়িয়ে জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসায়। কথিত প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত কেরছে মাদক সম্রাট হিসেবে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গড়ে তুলেছে মাদক সাম্রজ্য। নিজেদের তৈরিকৃত নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশের অধিকাংশ উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীাের মাঝে।
বিকার গ্রস্ত এই তরুণ-তরুণীরা নিজেদের কোমল আবেগের আহ্বানে বেছে নিচ্ছে নানা অপরাধের পথ। ফলে প্রতিনিয়ত সমাজে প্রতিযোগিতা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণ ও হত্যাসহ নানান অপরাধ। ৬৮হাজার গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি পরিবার বহমান সময়ে মাদক আতংকে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।কলিজার টুকরো তুল্য সন্তান কখন যে জড়িয়ে পড়ে মাদকসেবনে । সব মিলে জাতি একটি নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মাদক যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। মাদকের প্রতি যুবসমাজের আসক্তি হঠাৎ করে সৃষ্টি হয় নি। এর পেছনে কতগুলো মৌলিক কারণ রয়েছে।
প্রতিটি মানুষের মানসিকতায় ভালো মন্দ দুটি দিক আছে। সু-প্রবৃত্তি এবং কু-প্রবৃত্তি। নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা সু-প্রবৃত্তির বিকাশ সাধনে অনন্য ভুমিকা রাখে। নৈতিক শিক্ষার অভাবে সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। যার ফলে ব্যক্তি মানসে অপরাধ প্রবনতা স্থায়ী ভাবে আসন পাচ্ছে। আর অপরাধের প্রাথমিক উৎস হিসেবে মাদক সর্বাগ্রাসী ভূমিকা পালন করে।
ব্যক্তি জীবনের নানাবিধ হতাশা মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ হতে পারে। প্রতিটি শিশু স্বপ্ন নিয়ে বিকশিত হয়।কৈশোর বয়সে স্বপ্নগুলো রূপান্তরিত হয় এবং তারুণ্যে অনেকটা বাস্তবতা লাভ করে। কিন্তু এস্বপ্ন যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তখন অনেকেই আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে মাদক নামের নেশার উপকরণে আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে তরুণরাই এ ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় বেশি। শিক্ষিত তরুণ-যুবকেরা যথাযথ কর্মসংস্থানের অভাবে বেকার ও অলস সময় কাটায়। এক পর্যায় সমাজের চোখে ভৎসনার পাত্র হয়ে যায়। কর্মমুখী শিক্ষা বঞ্চিত তরুণেরা এক সময় হতাশা থেকে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নেশার জগতে।এবং এভাবে তারা হতাশা ভুলে থাকত গিয়ে নিজেদের নিয়ে যায় ধ্বংসের অতল গহ্বরে।
চারদিকে মাদকের অবাধ বিচরণ। এ অবস্থায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে ভালো কিছু শেখার থাকে না। কৈশোরকাল ও তরুণ বয়সে সঙ্গ দোষে নষ্ট হয়ে যায় বহু তরুণের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। পারিবারিক উদাসীনতা ও সামাজিক নির্লিপ্ততা এবং প্রশাসনিক শৈথিল্য এমন পরিস্থিতি তরান্বিত করার জন্য সর্বাংশে দায়ী।
*বয়ঃসন্ধিকালের উষ্ণ আমেজে অনেক তরুণ পরম কৌতুহলে প্রথমে ধুমপানের সাথে পরিচিত হয়। পরে অনেকেই আর এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, ধীরে ধীরে হাতের নাগালে পাওয়া গাঁজা,ইয়াবা,হেরোইন,
ফেন্সিডিলের মতো বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়ে বিপন্ন করে নিজেদের সম্ভাবনাময় তারুণ্য। ধুমপানের স্বাদ গ্রহণের জাতির তারুণ্য নেশাগ্রস্ত হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হয়।
কিউবার বিপ্লবী নেতা, প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ফিদেল কেস্টো এর ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পেরে বলেছিলেন, আমি অনেক আগেই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, কিউবার জনস্বাস্থ্যের জন্য আমার সর্বশেষ ত্যাগ হিসেবে ধুমপান বন্ধ করবো। সিগারেটের বাক্সের সবচয়ে ভালো ব্যবহার হতে পারে শত্রুর হাতে দিয়ে দেওয়া।
আমাদের রাষ্ট্র নায়ক যদি বিষয়টির ভয়াবহতা এমন করে অনুধাবন করতেন আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের তারুণ্য মাদকে আক্রান্ত হওয়ার সুজোগ পেতো না।
বাংলাদেশে মাদকের প্রভাব আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের তরুণরা ভয়াবহভাবে মাদকাসক্তের শিকার। অবৈধভাবে সীমান্তের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিরামহীন নানান ধরণের নেশার উপকরণ বন্যার স্রোতধারার মতো প্রবেশ করছে। দেশের অভ্যন্তরে নিমিষে ছড়িয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। যত্র তত্র বিক্র হচ্ছে জীবন বিনাশী ইয়াবা।
কিছু সংখ্যক অসৎ ব্যক্তি মাদক বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে। অর্থের প্রলোভনে পড়ে প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজের শপথ বাক্য ভুলে গিয়ে দেশ বিরোধী এই ঘৃণ্য কাজে জড়িত হয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের সহায়তা করার প্রমাণ্য অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা কিছু দুর্নীতিবাজের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে অপরাধীরা রাতারাতি প্রবল শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। ফলে মাদক ব্যবসায়িরা কাউকে তোয়াক্কা না করে দোর্দণ্ডপ্রতাপে অপরাধ সাম্রাজ্য বিস্তার করার জন্য প্রতিযোগিতা নেমে পড়ে।এতে করে মাদক সম্রাট নামে পরিচিত ব্যক্তিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। মাঝে মাঝে কিছু সৎ সাহসী পুলিশ অফিসার কর্তৃক কিছু অপরাধী ধরা পড়লেও জীবনের বিনিময়ে ছেড়ে দিতে হয় এবং মাদকাপরাধীর হাতে লাঞ্ছিত ও হতে হয়। এমন অসংখ্য নজির আছে মাদকের বিরূদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে বহু যুবক, বহু তরুণ মেধাবী ছাত্র মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীচক্রের হাতে জীবন দিতে হয়েছে। এর বিচারিক কার্যক্রম কত দূর এগিয়েছে তা জাতি জানতে পারে না।
মাদক ব্যবসায়ী দেশের শত্রু, জাতির শত্রু। কারণ তারা জাতির তারুণ্যশক্তিকে সমূলে নিধন করার কাজে লিপ্ত। আজকের তরুণরাই আগামীর দেশ, জাতি এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেবে। সেই তারুণ্যকে ধ্বংস করা মানে আমাদের দেশকে নেতৃত্ব শূন্য করে দেওয়া। দেশকে,দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে পঙ্গু করে দেওয়া। তরুণ মেধাবী ছাত্র সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে জীবন থেকে ছিঁড়কে পড়া মানে জাতি মেধাশূন্য হয়ে যাওয়া। মাদক হলো ক্যান্সারের মতো নীরব ঘাতক। যার উপস্থিতি সহজে টের পাওয়া যায় না। তেমনি নেশাগ্রস্ত তারুণ্যের ক্ষতিকর প্রভাব দেখতে অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তখন আর কিছুই করার থাকবে না। জাতীয় জীবনে তারুণ্যের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব জাতীয় সংকট ছাড়া সহজে অনুধাবন করা যায় না। যে তারুণ্য ভেতরে ভেতরে মৃত সে তারুণ্যের ওপর তখন নির্ভর করা যাবে না। তারুণ্যের শক্তি আঠারো বছর বয়সের মতো দুর্বার এবং প্রবল।
তাদের পদাঘাতে পাথরবাঁধা ও ভেঙ্গে যায়। যে জাতি তারুণ্য শক্তিতে দুর্বার সে জাতি বিজয়ী জাতি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ তার প্রমাণ এখনো বহণ করে।
মাদকের সাথে যারা জড়িত আর যাই হোক তারা দেশ প্রেমিক হতে পারে না,তাদের মুখে দেশ প্রেম মানায় না। দেশ বিরোধী, দেশের গণমানুষের স্বার্থ বিরোধী এই চক্র নি:সন্দেহে ‘দেশদ্রোহী’। সুতরাং এদের বড় বড় সব কয়টাকে ধরে মুক্তাঙ্গণে, মুক্তমঞ্চে, জন সম্মুখে একযোগে ফাঁসি দেওয়া উচিত। তা করতে পারলে মাদক নামক ‘বিষবৃক্ষটি’ সমাজ থেকে সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে। আর এ কাজটি করতে হলে হৃদয়ে দেশপ্রেম থাকতে হবে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে থেকে কোন রাষ্ট্রনায়কের জাতির এই ক্রান্তি কালে উদাসীন থাকা শেভা পায় না। মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে স্বজনপ্রীতি, দলমত ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে থেকে মাদকের সাথে সম্পৃক্ত যারা, তাদের রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার পাশ পাশি অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত। রাষ্ট্রের কল্যাণে এখনি সময় বিষয়টি বিবেচনায় এনে গভীর ভাবে ভেবে দেখা। যারা গোটা জাতিকে মরন নেশা মদকের শিকারে পরিণত করতে চায় সেসব বড় বড় মাদক কিংদের খুঁজে জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা এখন সময়ের দাবী। তবে তা হতে হবে জাতীয় স্বার্থে, রাগ-অনুরাগ কিংবা ব্যক্তি স্বার্থ এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে থেকে।
দেশব্যাপী যেভাবে মাদকদ্রব্যের বিস্তার ঘটেছে তা এক দিনে হয়নি। পরিবার এবং সামাজিক উদাসিনতা, রাষ্ট্রিয় শৈথিল্যতা ও দেউলিয়াপনা এবং নির্লিপ্ততা মাদকতার অবয়বকে প্রসারিত ও বিকশিত হতে সাহায্য করেছে। মানুষ নানাবিধ বৈশিষ্ট্যময় সামাজিক জীব। একজন মানুষের মনোজগতে ভালো-মন্দ উভয় দিকের প্রভাব রয়েছে। যে ধরনের পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়, ব্যক্তির মাঝে সে শিক্ষাই স্থায়িত্ব লাভ করে। এক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা মনুষ্যেতর বিকাশ ঘটাতে ভূমিকা রাখে। যে সমাজে মানুষ মনুষ্যত্বহীন, সেখানে উন্নত ও কল্যাণময় চিন্তা ধারা অসম্ভব। তাই ব্যক্তি ও সমাজের সুন্দর ভবিষ্যৎ এর লক্ষ্যে মনুষ্যত্ববোধ একান্তই জরুরী। এজন্যে প্রয়োজন ধর্মীয় ও নৈতিকতা সমন্বিত সুশিক্ষা। সামগ্রিকভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চলে আসছে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিস্বার্থ, সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ান্ধতা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক সংকীর্ণতা আমাদের তরুণ্য ও যুব সমাজের বেড়ে ওঠার প্রধান অন্তরায়। যার ফলশ্রুতি স্বরূপ দেখতে পাচ্ছি স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও জাতিকে আমরা একটি স্থায়ী কাঙ্খিত শিক্ষানীতি উপহার দিতে পারিনি। লক্ষ্যহীন বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতি গড়ে ওঠেছে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে। নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়ে একমুখী শিক্ষা জাতির জন্য অপরিহার্য। যার মাধ্যমে দেশের শিক্ষিত তরুণ, আপামর ছাত্রজনতা খুঁজে পাবে পথের দিশা।
কর্মমুখি শিক্ষা অর্জন করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে লক্ষ লক্ষ তরুণ।তখন কর্মজীবনের ব্যস্ততায় অপরাধ জগতে প্রবেশের অবকাশ পাবে না তরুণ ও যুব সমাজ। বেকারত্বের অবসরে, হতাশাময় গ্লানিতে মাদকদ্রব্য সেবন করে বহু তরুণ-যুবক সন্ত্রাস, ধর্ষণ,খুনসহ নানাবিধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে সমাজ ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এভাবে চলতে দিলে রাষ্ট্রের মূল সঞ্জিবনী চালিকাশক্তি তারুণ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। অমানিশার অতল গহ্বরে হারিয়ে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে গোটা জাতি। যোগ্য নেতৃত্বের সংকট ও অর্থনৈতিক পরাধীনতায় ক্ষতবিক্ষত হবে পুরো দেশ। মাদকসেবী তরুণ -তরুণীরা মাদকাসক্ত হওয়ার ফলে সাময়িক উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে বহুগামিতার পথে অগ্রসর হয়। এতে করে মরণব্যাধি এইডস এর জীবাণু নিজের অজান্তে শরীরে প্রবেশ করিয়ে থাকে। নীরব ঘাতক এইডস এর জীবাণু দীর্ঘ দিন ঘুমন্ত অবস্থায় থেকে ধীরে ধীরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে নিয়ে যায়। ততো দিনে তিনি সামাজিক জীব হিসেবে পারিবারিক বাঁধনে জড়িয়ে পড়েন এবং সন্তানের জনক হিসেবে পরিচিতি পান। দুঃখের বিষয় হলো এই যে, এইডস আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসে যে নিষ্পাপ নারী অথবা পুরুষ ভাইরাসের শিকার হন তারা আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন, কারো ভাই কারো বোন। রক্ত, বীর্য ও মায়ের দুধ এই তিন ধরণের তরল পদার্থের মাধ্যমে এইডসের জীবাণু ছড়ায়। সুতরাং তাদের ঔরসে যে প্রাণের অস্তিত্বের আগমন ঘটে তারা এইডসের জীবাণু শরীরে বহন করে পৃথিবীতে আগমন করে থাকে। এটি মানব সভ্যতার জন্য ভয়াবহ সংকেত। তাই আমাদের তরুণদের মাদকের পথ থেকে চিরতরে ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ এই তারুণ্যের হাতেই নির্ভর করছে জাতির ভবিষ্যৎ।
মাদকের প্রভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় হচ্ছে। মাদক আমাদের মেধাগুলোকে গুনপোকার মতো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মাদক আাসক্ত স্বামী কর্তৃক যৌতুকের বলী হচ্ছে তাদের স্ত্রীগণ। একই করণে আহরহ ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। বাড়ছে নারী ও শিশু পাচার, প্রতিনিয়তই ঘটছে অপহরণ আর মুক্তিপণ আদায়ের মতো ঘটনা। হরহামেশা চলছে খুনখারাবী। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা মাদকের টাকা সংগ্রহের জন্য চুরি- ডাকাতি,হাইজ্যাক,পেকেটমারের মতো নানান অপরাধ ঘটিয়ে থাকে।মাদকের প্রভাব নিঃসন্দেহে ধ্বংসাত্মক। এর ফলে মানসিক বৈকল্য সৃষ্টি হয়। যুবসমাজ কর্মক্ষমতা হারিয়ে অবচেতন ও অকর্মণ্য হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়ে।
এই চরম সংকট থেকে মুক্তি পেতে অবশ্যই সর্ব মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদকের চোরা কারবারিদেরকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। মাদক বিরোধী গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। একাজে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সকলস্তরের গণমাধ্যমগুলোর অগ্রণী ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অপসংস্কৃতির আগ্রাসন প্রতিরোধ করে সুস্থ ধারার শিক্ষণীয় সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে তরুণ-যুবসমাজের বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের আকৃষ্ট করতে হবে। যবসমাজের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তাদের হতাশা থেকে মুক্তি দিতে হবে। মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোকে মাদক মুক্ত রেখে মাদকাসক্তদের নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। কর্মমুখী, যুগোপযোগী স্থায়ী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করে শিক্ষার্থীদের সামনে জীবনের সুনির্দিষ্ট ও সঠিক রূপরেখা তুলে ধরতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে তারুণ্যের স্বার্থে, আগামীর দেশ-কাল, জাতির স্বার্থে। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এর কোনো বিকল্প নেই।
তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তারা মদকাসক্ত হওয়া মানে জাতি ও দেশ মাদকাসক্ত হওয়া। তারুণ্য পঙ্গু হওয়া মানে দেশ পঙ্গু হয়ে যাওয়া। কেবল সুস্থ জাতিই পারে কোন দেশের উজ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে। এই বাস্তব সত্যকে সামনে রেখে মাদক নেশার রাহুগ্রাস থেকে তারুণ্য বনাম জাতিকে রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে জাতির স্বার্থে সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ, মান-অভিমান,রাজনৈতিক সংঘাত ভুলে যেতে হবে। দেশের সব রাজনৈতিক দল, সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক, কলামিস্ট, সমাজকর্মী, আইনজীবী, ছাত্রসমাজ, শিক্ষক সমাজসহ সকলস্তরের প্রশাসন নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে জাতির এই ক্রান্তি লগ্নে ‘মাদকের নীল ছোবল’ থেকে জাতিকে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হবে বাঙালী জাতির আঠারো বছরের মতো উদ্যম যৌবনদীপ্ত তারুণ্যকে। আর আমরা যদি এই কাজটি একতাবদ্ধ হয়ে করতে ব্যর্থ হই তাহলে ‘বাংলাদেশ চিরতরে গন্তব্য হারাবে’।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক।