তানভীর আলাদিন
শৈশব থেকেই আমি জানতাম আমার বাবা একজন আয়কর আইনজীবী ও ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের নেতা। আর বড় ভাইয়াও ফেনী জেলা ছাত্রলীগের নেতা। তারপর যখন আমাদের কৈশর চলছিল, তখন স্বৈরাচার যুগ, সম্ভবত ১৯৮৬ সাল হবে, ওই সময়টা আমি যদিও জাতীয় রাজনীতির আগামাথা ঠিকঠাক বুঝতাম না, কিন্তু আমি ও আমরা পারিবারিক আবহে জেনেছিলাম- ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর, রাজধানীর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। এই বাড়ি আলোকিত করে জন্ম হলো এক শিশুর। শিশুটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বুকের ধন কনিষ্ঠ সন্তান এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদরের ছোট ভাই শেখ রাসেল। তারপর… ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মানবতার ঘৃণ্য শত্রু-খুনি ঘাতক চক্রের নির্মম বুলেটের হাত থেকে রক্ষা পায়নি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেল। পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে নরপিশাচরা নিষ্ঠুরভাবে তাঁকেও হত্যা করেছিল। মৃত্যুকালে রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিল।
এমন নির্মমতায় আমার কৈশোর সময়টায় শেখ রাসেলের হত্যার বিচারের দাবিতে মন দ্রোহ হয়ে উঠত। তাই আমার সমবয়সী একঝাঁক কিশোর মিলে আমরা ফেনী শহরতলীর তেমুহানী বাজারে গড়ে তুলেছিলাম ‘শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ’। সেখানে আমি, কাজি ছৈয়দ, মমিনুল হক, দিদার, মাস্টার কামাল, প্রয়াত ফয়েজ, ফয়েজ আহাম্মদ, ইউসুফ আহম্মদ, শহীদ ও খুরশীদ প্রমুখ। তখন জাতীয় পার্টির তৎকালীন স্থানীয় নেতৃবৃন্দের রক্তচক্ষু আর পেটুয়া বাহিনীর হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে দিন-রাত পড়েছিলাম শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ নিয়ে। অংশ নিতে লাগলাম শহরের মিছিল মিটিং ও স্থানীয় খেলাধূলার প্রতিযোগীতায়। ওই সময় একবার ঢাকার পদাতিক এসে ‘হল্লা বোল’ আবার ফেনী থিয়েটার এসে ‘স্বাধীনতা তুমি কার’ নাটক মঞ্চস্থ করেছে। ওই দিনগুলোতে আমরা শেখ রাসেলের বিষয়ে বিশদভাবে জানার সুযোগ ছিল কম। এখন আমরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণ থেকে জানতে পারছি এবং বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে পারছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেলের অজানা অধ্যায়গুলো-
শেখ রাসেলের জন্মদিনটির কথা মনে করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন: ‘১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্ম হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় আমার শোয়ার ঘরে। দোতলা তখনও শেষ হয়নি। বলতে গেলে মা একখানা করে ঘর তৈরি করেছেন। একটু একটু করেই বাড়ির কাজ চলছে। নিচতলায় আমরা থাকি। উত্তর-পূর্ব দিকের ঘরটা আমার ও কামালের। সেই ঘরেই রাসেল জন্ম নিল রাত দেড়টায়… রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিলো ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো, ফুফু বললেন তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিলো রাসেল।’
রাসেলের নামকরণের বিষয়টিও উঠে এসেছে শেখ হাসিনার লেখায়। নামকরণটা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। সেই প্রিয় লেখকের নামের সাথে মিল রেখে আদরের সন্তানের নাম রাখেন শেখ রাসেল।
‘কারাগারের রোজনামচা’তে শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মালবোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভেতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাওয়ার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।’
‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’-বঙ্গবন্ধু
তিনি লিখেছেন-১৯৬৭ সালের ১৪-১৫ এপ্রিল অন্যান্য প্রসঙ্গ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু রাসেলকে নিয়ে লিখেছেন, ‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভেতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কী?’ ওর মা বলল, ‘বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে।’ রাসেল ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দিই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার ওপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ে কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো, তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আব্বার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন। মাকেই আব্বা বলে ডাকত।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সসদ্যদের সঙ্গে ঘাতক খুনীদের হাতে হত্যার শিকার হন তিনি। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকান্ড কোথাও ঘটেনি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে আটক করা হয়। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কেঁদে-কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’ পরবর্তী সময়ে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রæসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন।’ মা, বাবা, দুইভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা কি তখন ব্যথায় কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল? যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ-আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হয়েছিল, কী কষ্টই না ও পেয়েছিল!
‘কেন কেন কেন আমার রাসেলকে এত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল? আমি কি কোনোদিন এই ‘কেন’র উত্তর পাব?’ বঙ্গবন্ধু কন্যার এই আকুতি ভরা ‘কেন’র জবাব কে দেবে? রাসেল স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবের ছেলে এটাই হয়তো ছিল তাঁর একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ। এ প্রসঙ্গে শিশু রাসেলকে নিয়ে েেলখা দুই বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিশুরক্ত’ কবিতার কয়েকটি লাইন খুব মনে পড়ছে:
‘তুইতো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে
সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি!
তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো
শিশুরক্তপানে তার গøনি নেই?
সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!
যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়
আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই।’
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা শিশু রাসেলকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাঙালি জাতি দেখেছে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীরা ফাঁসিতে ঝুলতে। এখন জাতি অপেক্ষা করছে পলাতক বাকি খুনিদের ধরে এনে ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে এই দৃশ্য দেখার।পরিশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সকল শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। [তথ্য সূত্র: সংগৃহীত]
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সংগঠক।